জিয়ার চোখে তখন অশ্রুবিন্দু

বাহার, বাচ্চু, মাসুদ ও হারুনের মৃতদেহ পুলিশের জিম্মায় দেয়া হয়। ভারতীয় দূতাবাসের পেছনে ৩ নম্বর সড়কে ধানমন্ডি থানার পোর্টিকোর নিচে একটি ভ্যানে  মৃতদেহগুলো রাখা ছিল। বেলা ১১টার একটু পরে সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান সেখানে আসেন। মৃতদেহগুলোর পাশে তিনি বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার চোখে অশ্রুবিন্দু। বাহারের সঙ্গে তার সখ্য ছিল। প্রকৃতপক্ষে তাহেরের সঙ্গে তার দীর্ঘদিনের ব্যক্তিগত সম্পর্ক। ছুটির দিনে তিনি প্রায়ই নারায়ণগঞ্জে তাহেরের বাসায় চলে যেতেন। বাহার ছিলেন জিয়ার খুবই প্রিয় এবং ভাইদের মধ্যে সবচেয়ে সৎ ও সাহসী। জিয়া ও বাহার পরস্পরকে ‘দোস্ত’ বলে সম্বোধন করতেন। অসম বয়সী এই বন্ধুর মৃত্যুতে জিয়া খুবই ব্যথিত হয়েছিলেন।
১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বরের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদের প্রকাশিতব্য গ্রন্থে এসব কথা বলা হয়েছে। দৈনিক প্রথম আলোর ঈদ সংখ্যায় ‘৭ই নভেম্বরের সাত-সতেরো’ শিরোনামে বইটির নির্বাচিত অংশ প্রকাশিত হয়েছে। এতে কর্নেল তাহেরকে মুক্ত করতে ভারতীয় কমিশনারকে জিম্মি করার অভিযানের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ঢাকা নগর গণবাহিনীর কমান্ডার আনোয়ার হোসেন একটি পরিকল্পনা আঁটেন যা এ দেশে আগে কখনও ঘটেনি। ছয় জনের একটি সুইসাইড স্কোয়াড তৈরি হয়। এর সদস্যরা হলেন- সাখাওয়াত হোসেন বাহার, ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল, মীর নজরুল ইসলাম বাচ্চু, মাসুদুর রহমান, হারুনুর রশীদ ও সৈয়দ বাহালুল হাসান সবুজ। প্রথমে মতিঝিলে আদমজী কোর্টে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস রেকি করা হয়। পরে সিদ্ধান্ত বদল করে ধানমন্ডির ২ নম্বর সড়কে ভারতীয় হাইকমিশন রেকি করা হয়। ঠিক হয়, গণবাহিনীর একটি দল হাইকমিশনারকে জিম্মি করে তাহেরের মুক্তি এবং আরও কিছু দাবিদাওয়া উপস্থাপন করবে। তারা খোঁজ নিয়ে জেনেছে হাইকমিশনার সমর সেন সকাল সাড়ে নয়টায় অফিসে আসেন। ২৬শে নভেম্বর সময়মতো ছয়জন অকুস্থলে হাজির। দলের নেতা বাহার। তিন জন অবস্থান নিলেন রাস্তার দক্ষিণ পাশে জার্মান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের চত্বরে। তিনজন অপেক্ষা করতে থাকলেন ভারতীয় ভিসা অফিসের সামনে। সবাই সশস্ত্র। এমন সময় হাইকমিশনার এসে গাড়ি থেকে নামলেন। সঙ্গে সঙ্গে বাহারদের দলের দুই জন তার দুই হাত ধরে বললেন, আপনি এখন আমাদের হাতে জিম্মি। আপনার ঘরে চলুন। আপনার সঙ্গে আমাদের কিছু কথা আছে। সিঁড়ি দিয়ে একতলা থেকে দোতলায় যাওয়ার পথে উপরে অপেক্ষমান নিরাপত্তারক্ষীরা ব্রাশফায়ার করলে ঘটনাস্থলেই বাহার, বাচ্চু, মাসুদ ও হারুন নিহত হন। হাইকমিশনারের কাঁধে গুলি লেগেছিল। চোখের পলকে ঘটনা ঘটে গেল। রেকি করার সময় ক’জন নিরাপত্তারক্ষী ঠিক কোন কোন জায়গায় ডিউটি করেন, তা তারা জেনে গিয়েছিলেন। কিন্তু তারা জানতেন না, একদল ভারতীয় নিরাপত্তারক্ষী দোতলায় পাহারায় থাকেন। তিতুমীর কলেজ ছাত্রসংসদের সহ-সভাপতি কামালউদ্দিন আহমেদ এই অভিযানে অংশগ্রহণকারী ছয়জনের জন্য মগবাজারের নয়াটোলায় একটা শেল্টারের ব্যবস্থা করেছিলেন। ছাত্রসংসদের সহ-সম্পাদক ফোরকান শাহর বাড়িটি শেল্টার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। সেখান থেকেই এই স্কোয়াডের ছয় জন ২৬শে নভেম্বর সকালে রওনা হয়েছিলেন। ঘটনার পর ফোরকানের পিতা ইসরাফিল সাহেবকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। সংবাদ পেয়ে সেনাবাহিনীর নবনিযুক্ত চিফ অব জেনারেল স্টাফ ব্রিগেডিয়ার আবুল মঞ্জুর এলেন। তিনি আহত বেলাল ও সবুজকে গাড়িতে উঠিয়ে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। ভারতীয় হাইকমিশনে এই অভিযানের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। প্রায় সব রাজনৈতিক দলের নেতারা এক সুরে এর সমালোচনা করতে শুরু করলেন। ডান-বাম কোন ভেদাভেদ থাকলো না। ঢাকার পূর্বপাশে বেরাইদ গ্রামে ঢাকা নগর গণবাহিনীর একটা জরুরি সভায় আনোয়ার হোসেন এ ঘটনার সব দায় স্বীকার করেন। সভায় শরীফ নুরুল আম্বিয়া এবং ঢাকা নগর গণবাহিনীর অন্য নেতারা উপস্থিত ছিলেন। বেশির ভাগ সদস্য আনোয়ারের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করে তাঁকে ফায়ারিং স্কোয়াডে পাঠানোর দাবি জানান। শেষমেষ তাকে লঘু শাস্তি দেয়া হয়। তাকে নগর গণবাহিনীর কমান্ডারের পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। আনোয়ারের ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকার ‘অপরাধে’ রাজনৈতিক কমিশার রফিকুল ইসলামকে ভৎর্সনা করা হয়।
৭ই নভেম্বরের অভ্যুত্থানের পরের ঘটনা প্রবাহ নিয়ে মহিউদ্দিন আহমদ আরও লিখেছেন, ঢাকা নগর গণবাহিনীর উদ্যোগে সকাল ১০টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশের ঘোষণা দেয়া হয়েছিল এবং জিয়া ও তাহেরের সেখানে উপস্থিত হওয়ার কথা ছিল। জিয়া সেনানিবাসের বাইরে আসতে অস্বীকার করেন। তিনি জানান, একজন সৈনিক হিসেবে তিনি কোন জনসমাবেশে গিয়ে বক্তৃতা দেয়ার পক্ষপাতি নন। ততক্ষণে জিয়ার আশপাশে অনেক সেনাকর্মকর্তা উপস্থিত হয়েছেন। জিয়া তখন অনেকটা স্বচ্ছন্দ এবং ভারমুক্ত। ৭ই নভেম্বর রাষ্ট্রপতি সায়েম বেতার ও টেলিভিশনে একটা ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতির পদে জনাব খোন্দকার মোশ্‌তাক আহ্‌মাদের পুনর্বহালের পক্ষে স্বতঃস্ফূর্ত দাবি সত্ত্বেও তারই অনুরোধক্রমে আমি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব চালিয়ে যেতে সম্মত হয়েছি। বিচারপতি সায়েমের ভাষণের পরপর খোন্দকার মোশ্‌তাক আহ্‌মাদের একটি ভাষণ প্রচার করা হয়। ভাষণে তিনি দেশের সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, সকল নিরাপত্তা বাহিনী ও সর্বস্তরের জনগণকে ‘স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অক্ষুন্ন রাখার জন্য যে অভূতপূর্ব বিপ্লব সংগঠিত হয়েছে, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। তাহের জিয়াকে বেতারকেন্দ্রে নিয়ে আসতে এবং তাকে দিয়ে একটি ভাষণ দেওয়াতে চেয়েছিলেন। জিয়া তাহেরের সঙ্গে কোথাও যেতে চাননি। কয়েকজন সেনাকর্মকর্তা পরামর্শ দেন, সেনাপ্রধানের বেতার কেন্দ্রে যাওয়ার কি দরকার? ভাষণ তো এখানেই রেকর্ড করা যায়। শেষ পর্যন্ত জিয়ার ভাষণ সেনানিবাসেই রেকর্ড করা হয়। ৭ই নভেম্বর সন্ধ্যায় এই ভাষণ প্রচার করা হয়। জিয়ার এই ভাষণে কোথাও জাসদ, গণবাহিনী বা তাহেরের উল্লেখ নেই। সকালেই ‘সিপাহী বিপ্লবের’ ঘণ্টা বেজে গিয়েছিল। এই ভাষণ ‘বিপ্লবের’ কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দিলো। উল্লেখ্য, ৩রা নভেম্বরের অভ্যুত্থানের কুশীলবদের অনেকেই যে যেখানে পারেন, গা ঢাকা দেয়ার চেষ্টা করেন। অনেকেই গ্রেপ্তার হন। শাফায়াত জামিল পালিয়ে যাওয়ার সময় আহত হন এবং পরে নারায়ণগঞ্জ থানায় আত্মসমর্পণ করেন। তাকে ঢাকায় এনে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। ৭ই নভেম্বর ভোরে খালেদ মোশাররফ তার দুই সহযোগী কর্নেল হায়দার ও কর্নেল হুদাকে নিয়ে শেরেবাংলানগরে সেনাবাহিনীর একটি ইউনিটে যান। সেখানেই তাদের হত্যা করা হয়। কার নির্দেশে তাদের হত্যা করা হয়েছিল, তা আজও অজানা। কেউ বলেন তাহের, কেউ বলেন জিয়া। কয়েক মাস পরে ঢাকার মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে মেজর হাফিজের সঙ্গে আ কা ফজলুল হকের দেখা হয়। হাফিজ তখন সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত। মোহামেডান ক্লাবের ফুটবল টিমের তিনি অধিনায়ক ছিলেন। তিনি জিয়ার ওপর ক্ষুদ্ধ ছিলেন। তার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেল, ‘জিয়াকে গৃহবন্দি করে রাখার পরিকল্পনাটি ছিল হাফিজের। আবার হাফিজের কারণেই জিয়া কিলড হননি। এতে মনে হতে পারে জিয়াকে আটক রাখার ব্যাপারটা ছিল সাজানো।’ অভ্যুত্থানকারীরা জিয়াকে তার বাসভবনে অন্তরীণ করার সময় ড্রইং রুমের টেলিফোন লাইন কেটে দিয়েছিলেন। কিন্তু তার শয়নকক্ষের টেলিফোন লাইনটি সচল ছিল। এই টেলিফোনের মাধ্যমেই জিয়া তাহেরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছিলেন। ৮ই নভেম্বর রাতে রাজশাহী কারাগার থেকে জাসদের সভাপতি মেজর জলিল ও সাধারণ সম্পাদক আসম আবদুর রব ছাড়া পান। পরদিন তারা ঢাকায় আসেন। এর আগে ৭ই নভেম্বর বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার একটি দল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ফটক খুলে দিলে জাসদের নেতা এম এ আউয়াল, মোহাম্মদ শাজাহান ও মির্জা সুলতান রাজা বেরিয়ে আসেন। তারা সবাই তখন হতবিহবল। ৮ই নভেম্বর চিত্রপট একটু বদলে যায়। রাষ্ট্রপতি সায়েম নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং তিন বাহিনীর প্রধানদের উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ঘোষণা দেন। তাহেরের সঙ্গে জিয়ার যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে আসে এবং ১২ই নভেম্বর থেকে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। জাসদের নেতাদের একটা গোপন সভা ১৭ই নভেম্বর রায়েরবাজারে একটা কাঠের আড়তে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় তারা বলেন, জিয়া বিট্রে করেছে। জলিল বলেন, ভয়ের কোন কারণ নাই। বঙ্গভবনের সামনে যে সব ট্যাংক আছে, ওরা আমাদের সঙ্গে কথা বলে গেছে। নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে শাজাহান সিরাজের শ্বশুরবাড়িতে জলিলের সঙ্গে সাংবাদিক আমানউল্লাহ দেখা করতে যান। আমানউল্লাহর বর্ণনামতে: ‘জলিলকে খুব অস্থির মনে হচ্ছিল। জিয়া সম্পর্কে বলল, বেজন্মাটা বেঈমানি করেছে।’ ইতিমধ্যে সৈনিকেরা বেশির ভাগই সেনানিবাসে ফিরে গেছেন। তাহের বিভিন্ন সেনানিবাসে তার অনুগত লোকদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন। ২৩শে নভেম্বর এলিফ্যান্ট রোডে শাজাহান সিরাজের শ্বশুরবাড়ি থেকে জলিল ও রবকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। একই দিনে আবু ইউসুফ খান ও ইনু গ্রেপ্তার হন। ২৪শে নভেম্বর বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার কয়েকজনকে নিয়ে তাহের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ হলের আবাসিক শিক্ষক ও পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের লেকচারার মোস্তফা সরোয়ার বাদলের বাসায় সভা করার সময় নিরাপত্তা বাহিনী তাদের ঘিরে ফেলে। তাহের কয়েকজন সহযোগীসহ গ্রেপ্তার হন।

No comments

Powered by Blogger.