গাজায় নেমে এসেছে মহাপ্রলয় -চারদিকে শুধু লাশ

মসজিদ, জাতিসংঘের আশ্রয়কেন্দ্র, স্কুল, লোকালয়- সর্বত্র বোমা হামলায় ফিলিস্তিনের গাজায় যেন নেমে এসেছে মহাপ্রলয়। চারদিকে শুধু লাশ। লাশের গন্ধে বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। এত লাশ, এত ধ্বংসযজ্ঞ দেখে শিহরিত বৃটিশ চিকিৎসক ডেভিড নট। তিনি বলেছেন, এ তো হামলা নয়, যুদ্ধ নয়- এ এক বীভৎস ধ্বংসযজ্ঞ। তিনি আন্তর্জাতিক সেবা সংস্থা রেডক্রসের হয়ে বর্তমানে রয়েছেন গাজায়। এর আগে যুদ্ধকবলিত বসনিয়া, ইরাকে দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু গাজার সঙ্গে কোন স্থানের ভয়াবহতাকে মেলাতে পারছেন না। গতকালও অব্যাহতভাবে গাজায় বোমা হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। ভীতসন্ত্রস্ত সাধারণ মানুষ জাতিসংঘের আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েও রেহাই পাচ্ছে না। এরই মধ্যে জাতিসংঘ পরিচালিত বেশ কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্রে হামলা চালিয়ে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়েছে ইসরাইল। গতকালও তারা জাতিসংঘ পরিচালিত আরেকটি স্কুলে হামলা করেছে। এতে তাৎক্ষণিকভাবে কমপক্ষে ১০ শরণার্থী নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে বেশির ভাগই নারী ও শিশু। তারা যখন খাদ্যের জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছিল ঠিক তখনই সেখানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইসরাইল। এ হামলায় আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৩৫ জন। এ নিয়ে জাতিসংঘ পরিচালিত কমপক্ষে ৬টি আশ্রয়কেন্দ্রে এমন হামলা চালালো তারা। গাজা হামলার ২৭তম দিন অতিবাহিত হয়েছে গতকাল। এ সময়ে কমপক্ষে ১৭০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এর বেশির ভাগই সাধারণ নারী ও শিশু। পক্ষান্তরে ইসরাইলে নিহত হয়েছে ৬৭ জন। এর ৬৪ জনই সেনা সদস্য। গাজায় ইসরাইলের নৃশংস হামলায় যে পরিমাণ মানুষ নিহত হয়েছেন তাদের লাশ রাখার এখন আর কোন জায়গা নেই। মর্গে ঠেসে ঠেসে রাখা হয়েছে মৃতদেহ। তারপরও স্থান সঙ্কুলান হচ্ছে না। ফলে লাশ রাখা হচ্ছে এখন ফ্রিজে স্তূপ করে। এ এক ভয়াবহ দৃশ্য। গতকাল রাফা এলাকায় জাতিসংঘের আশ্রয়কেন্দ্রে হামলার পর সেখানে রাস্তায় দেখা যায় শুধু রক্ত আর রক্ত। মরে পড়ে আছেন অনেক মানুষ। তাদের দেহ থেকে রক্ত গড়িয়ে যাচ্ছে বহমান নদীর মতো। এ অবস্থায় ইসরাইলকে নিবৃত করতে বিশ্ব বিবেক যথার্থ পদক্ষেপ নিচ্ছে না। ফলে দিনকে দিন বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। এক পর্যায়ে গাজা উপত্যকা থেকে ইসরাইলি ট্যাংক প্রত্যাহারের দৃশ্য মিডিয়ায় দেখানো হয়। কিন্তু গতকালই তারা নতুন করে হামলা চালায়। এমন বর্বর হামলায় বিস্মিত বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফিলিপ হ্যামন্ড। তিনি এ পরিস্থিতিতে চুপ থাকতে পারেননি। বলেছেন, গাজার এ পরিস্থিতি অসহনীয়। এটা আর সহ্য করা যায় না। আমাদেরকে এই হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে হবে। তবে যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করেছে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু। ওবামা প্রশাসনকে তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন-তাকে যেন দ্বিতীয়বার যুদ্ধবিরতির জন্য চাপ দেয়া না হয়। তার এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য গতকাল বিভিন্ন মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার হয়। ওদিকে জাতিসংঘের শরণার্থী শিবিরে গতকালের হামলার বিষয়ে কোন মন্তব্য করেনি ইসরাইলের সেনাবাহিনী। ওদিকে মিশরের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে সংলাপে যোগ দিতে হামাসের কর্মকর্তারা কায়রোতে পৌঁছেছেন। ইসরাইল ঘোষণা করেছে তাদের যে সেনা সদস্য লেফটেন্যান্ট হাদার গোল্ডিনকে অপহরণ করা হয়েছে তাকে হত্যা করা হয়েছে। ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনী থেকে এ কথা জানিয়ে দেয়া হয়েছে তার পরিবারকে। এর আগে গাজা থেকে ট্যাংক প্রত্যাহার করা হলেও ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, ইসরাইলের নিরাপত্তার জন্য ফের সেনা মোতায়েন করা হবে। ওদিকে গতকাল সকালে ইসরাইল গাজার দক্ষিণে রাফায় জাতিসংঘের স্কুলে বোমা হামলা চালালে সেখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। রক্তে ভেসে যায় এলাকা। মৃত ও জীবিতদের উদ্ধার করতে গিয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন রেডক্রসের উদ্ধারকর্মীরা। তারা একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। এক ফিলিস্তিনির হাত-পা রক্তে ভেজা। সে অবস্থায় তিনি দৌড়াচ্ছেন আহত এক শিশুকে উদ্ধারে। আশ্রয়কেন্দ্রের বাইরে স্বজন হারানো নারীদের কান্নায় আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠছিল। তারা চিৎকার করে বলছিলেন- জাতিসংঘের আশ্রয়কেন্দ্রেও যদি আমরা নিরাপদ না থাকি, আমাদের ওপর বোমা হামলা করা হয়, আমাদের সন্তানদের হত্যা করা হয়, নিরপরাধ স্বামীকে হত্যা করা হয়- তাহলে আল্লাহর দুনিয়ায় আমরা যাবো কোথায়? আমাদের জন্য নিরাপদ স্থান কি দুনিয়ায় নেই? তার কান্নায় যেন স্তব্ধ হয়ে যায় প্রকৃতিও। কিন্তু নির্বিকার মনোভাব ইসরাইলের। তাদের অভিযোগ, হামাস ইসরাইলের দিকে রকেট ছুড়ে মেরেছে। তারা টানেল ব্যবহার করে ইসরাইলের ভিতরে হামলা চালাচ্ছে। তবে প্রশ্ন এসে যায়- তাহলে এর জবাবে ইসরাইল কি সম-শক্তি ব্যবহার করছে? তারা গাজায় এক হাজার ৭ শতাধিক বেসামরিক মানুষকে হত্যা করেছে। পক্ষান্তরে হামাসের হামলায় নিহত হয়েছে ৬৭ জন। তারা সাধারণ নাগরিক নয়, সেনা সদস্য। তাহলে কি করে সম-শক্তির ব্যবহার হলো! গাজায় এই হত্যাযজ্ঞ দেখে বৃটিশ চিকিৎসক ডেভিড নট বলেন, আহত গাজাবাসীকে চিকিৎসা দিতে গিয়ে তার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠেছে। তিনি গাজা শহরে আল শিফা হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটারে আহতদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। কোনদিন ১২ ঘণ্টাও তাকে সেখানে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। এতে তিনি বিরক্ত নন। তিনি শুক্রবারের হতাহতের দিনকে একটি জটিল দিন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। একটি ৮ বছরের শিশুর শরীর বিস্ফোরিত বোমায় মারাত্মক জখম হয়েছে। তার পাকস্থলী, শরীরের পশ্চাৎদিকে, বুকে ও কোলনে ফুটো হয়ে গেছে। ডেভিড নট বলেন, সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ। আমরা ওই শিশুটির জীবন বাঁচাতে পেরেছি। তার ভাষায়- আমরা যেসব অপারেশন করছি তার বেশির ভাগই শিশু, যুবক। তাদেরকে মারাত্মক জখম অবস্থায় আমাদের কাছে আনা হচ্ছে। তাদের শরীরে বিদ্ধ হয়ে আছে বোমার টুকরো, বিধ্বস্ত ভবনের নির্মাণ সামগ্রী। তিনি বলেন, আমরা বিকালে শুনতে পাই হাসপাতালে বোমা হামলা করা হতে পারে। ওই সময় আমি অপারেশনে ব্যস্ত। ফলে ওই রোগীদের ফেলে সরে যেতে পারিনি। পুরো হাসপাতালের সবাই তখন চলে গেছেন ভয়ে। শুধু আমি আর আমার এক সহকর্মী অপারেশন থিয়েটারে ব্যস্ত। আমরা এ কাজে অভিজ্ঞ। তাই আমরা অপারেশন থিয়েটারের পাশে লুকিয়ে রাখি। সেখানেই অপারেশন চলতে থাকে। শুক্রবার রাতে আমি ২৫ বছর বয়সী এক যুবকের অপারেশন করছিলাম। কিন্তু অপারেশনের ৬ ঘণ্টা পরে তিনি মারা যান। তার ক্ষত ছিল প্রাণঘাতী।

ওদিকে গাজার জনগণের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডি। গতকাল এক বিবৃতিতে বলা হয়, গতকাল ঢাকাস্থ ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত শাহের মোহাম্মদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বর্তমান দুর্যোগপূর্ণ সময়ে সেখানকার জনগণের প্রতি সিপিডির পক্ষ থেকে সংহতি ও একাত্মতা প্রকাশ করা হয়। এ সময় সিপিডির পক্ষ থেকে গাজার জনগণের জন্য রাষ্ট্রদূতের কাছে এ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দু’দিনের বেতনের সমপরিমাণ দুই লাখ টাকার একটি চেক হস্তান্তর করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.