সংলাপ, না অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণাম by বদিউল আলম মজুমদার

প্রথম আলো থেকে কয়েকটি উদ্ধৃতি
‘আমি সংবিধানে বিশ্বাস করি। যা হবে সংবিধান মোতাবেক হবে। তার থেকে একচুলও নড়া হবে না’—প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (১৮/০৮/১৩)।
‘তাদের সঙ্গে কিসের সংলাপ? যারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাতবার্ষিকীতে কেক কেটে ফুর্তি করে, তাদের সঙ্গে আপস হবে না’—আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম (১৫/০৮/১৩)।
‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আগামী নির্বাচন নিয়ে জানানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন, তা-ও তাঁদের বলা হয়েছে। আমরা তাঁদের জানিয়েছি সবকিছুই হবে সংবিধানের আলোকে’—পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি (১৯/০৮/১৩)।
‘আলোচনাই সমাধানের একমাত্র পথ, এর বিকল্প যুদ্ধ’—আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম (১৮/০৬/১১)।

এটি সুস্পষ্ট যে নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা সম্পর্কে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটি ঐকমত্যে পৌঁছার ব্যাপারে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তার মত পরিবর্তন করেছে, যদিও সংলাপ ও সমঝোতার পক্ষে সারা দেশে ব্যাপক জনমত বিরাজ করেছে। অতীতে সরকারি দল ও বিরোধী দলের মধ্যে সংলাপ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিরোধ নিরসনের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ আগ্রহী ছিল। এমনকি কয়েক মাস আগেও সরকারের পক্ষ থেকে সংলাপের আহ্বান জানিয়ে বিরোধী দলকে চিঠি দেওয়ার বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়ের মাত্র কয়েক মাস আগে কেন হঠাৎ করে এই মত পরিবর্তন? এটি কি শুধু সৈয়দ আশরাফের বক্তব্য অনুযায়ী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাতবার্ষিকীতে খালেদা জিয়ার কেক কেটে জন্মদিন পালনের জন্য? নাকি অন্য কোনো কারণে?
নিঃসন্দেহে বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতবার্ষিকীতে ঘটা করে বিরোধী দলের নেতার জন্মদিন উদ্যাপন অন্তত অশোভন ও দৃষ্টিকটু। এর মাধ্যমে জাতির জনকের প্রতি চরম অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হয়, যা আমাদের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে কাম্য নয়। আশা করি, তিনি এবং তাঁর সহকর্মীরা বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভাববেন এবং ভবিষ্যতে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত কর্ম থেকে বিরত থাকবেন।
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়: খালেদা জিয়ার এমন আচরণের প্রতিক্রিয়ায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং সৈয়দ আশরাফ কি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে অনিশ্চয়তা দূর করার লক্ষ্যে সংলাপে বসার সম্ভাবনাকে পুরোপুরি উড়িয়ে দিতে পারেন? জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেখানে জড়িত, সেখানে সংলাপের সম্ভাবনাকে সম্পূর্ণরূপে নাকচ করে দেওয়া তাঁদের বক্তব্য কি যৌক্তিক? এ ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে সংলাপের সঙ্গে জন্মদিন পালনের সম্পর্কই বা কী? খালেদা জিয়ার ওপর রাগ করে কি তাঁরা পুরো জাতির ভবিষ্যৎকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দিতে পারেন? এটি কি তাঁদের নিজেদের এবং তাঁদের দলের পক্ষ থেকে দায়িত্বশীল আচরণ?
যথাসময়ে ও সবার অংশগ্রহণে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান জাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচন যথাসময়ে না হলে—যে আশঙ্কা নিয়ে নাগরিকদের বিরাট অংশের মধ্যে ইতিমধ্যেই সংশয় সৃষ্টি হয়েছে, কিংবা এতে প্রধান বিরোধী দল অংশ না নিলে, সারা দেশে সংঘাত অনিবার্য। এমনি পরিস্থিতিতে অতীতের মতো আমাদের গণতান্ত্রিকব্যবস্থা আবারও ভেঙে পড়তে পারে। আবারও অনির্বাচিত ব্যক্তিরা ক্ষমতা দখল করতে পারে, যা আমাদের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করবে। অতীতে আমরা দেখেছি যে এ ধরনের সরকার জাতির জন্য দীর্ঘমেয়াদি কল্যাণ বয়ে আনেনি। ভবিষ্যতেও এর ব্যতিক্রম হবে বলে আমাদের মনে হয় না। তাই অনেকের মনে প্রশ্ন, খালেদা জিয়ার ওপর অভিমান করে আওয়ামী লীগ কি পুরো জাতিকে ভয়াবহ সংকটের দিকে ঠেলে দেওয়ার মতো বিরাট ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত?
এ ছাড়া খালেদা জিয়া তো এ বছরই প্রথম ১৫ আগস্ট তাঁর জন্মদিন পালন করছেন না। প্রায় গত দুই দশক থেকেই তিনি এই কাজটি করে আসছেন। তাই এ অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়টি নতুন নয়। এই ইতিহাস জেনেই আওয়ামী লীগ তার ‘দিনবদলের সনদ’ শীর্ষক নির্বাচনী ইশতেহারে ‘সংঘাতময় রাজনীতির ঐতিহ্য পেছনে ফেলা’ এবং ‘সংকটের আবর্তে’ নিমজ্জমান অবস্থা থেকে দেশকে পুনরুদ্ধার করে একটি উন্নত-সমৃদ্ধ, সুখী-সুন্দর জীবন গড়ে তোলাই...বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একমাত্র ব্রত হিসেবে ঘোষণা করে। দিনবদলের সনদে আরও সুস্পষ্টভাবে অঙ্গীকার করে যে ‘রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে শিষ্টাচার ও সহিষ্ণুতা গড়ে তোলা হবে।’
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরও ৩১ ডিসেম্বর ২০০৮ অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দল সম্পর্কে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেন: ‘অবশ্যই খালেদা জিয়ার সহযোগিতা চাইব। কারণ, তিনিও প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, দেশ চালিয়েছেন। তাঁর অভিজ্ঞতা আছে। সংসদে সকলের অভিজ্ঞতা নিয়েই চলতে হবে...বিরোধী দল সম্মত থাকলে মন্ত্রিত্ব দেব...বিরোধী দলকে সংখ্যা দিয়ে বিচার করব না।’ সংবাদ সম্মেলনে তিনি বিরোধী দল থেকে জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার নিয়োগ দেওয়ারও অঙ্গীকার করেন।
লক্ষণীয় যে সংবাদ সম্মেলনে দলীয় নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেন, ‘যেহেতু বিজয় অর্জন করেছি, তাই সবকিছু ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে হবে।’
শেখ হাসিনা বিরোধী দলের প্রতি আহ্বান জানান: ‘আসুন, সব ভেদাভেদ ভুলে দেশের মানুষের জন্য একসঙ্গে কাজ করি। সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দলও রাষ্ট্র পরিচালনার অংশীদার। বিরোধী দলের ইতিবাচক সমালোচনা, পরামর্শ এবং সংসদকে কার্যকর করতে তাদের ভূমিকা ও মর্যাদা সমুন্নত রাখব।’
তিনি জাতিকে আশ্বস্ত করেন: ‘আমরা প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না। হানাহানির রাজনীতি পরিহার করতে চাই। দেশে নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি উপহার দিতে চাই’ (প্রথম আলো, ১ জানুয়ারি ২০০৯)।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদি তাঁর এসব অঙ্গীকার রক্ষা করতেন, তাহলেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন ঘটত এবং সমাজে সত্যিকারের দিনবদলের সূচনা হতো। আমাদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন আরও ত্বরান্বিত হতো। জনগণও হাঁফ ছেড়ে বাঁচত, কারণ, তারা অতীতের অপশাসন ও সংঘাতের রাজনীতি নিয়ে অতিষ্ঠ এবং এখন তা আবারও ফিরে আসার আশঙ্কায় আতঙ্কগ্রস্ত। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে হানাহানির রাজনীতির অবসান তথা দিনবদলের প্রত্যাশায় জনগণ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটকে ২০০৮ সালে ভূমিধস বিজয় উপহার দিয়েছিল।
এটি সুস্পষ্ট যে গত নির্বাচনে জেতার পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সবার, বিশেষ করে প্রধান বিরোধী দলের সহযোগিতা নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করার জন্যও বদ্ধপরিকর ছিল। এখন মেয়াদের শেষ দিকে এসে তারা বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপেও বসতে চায় না। এমনকি এটা করতে গিয়ে তারা রাষ্ট্রকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিতেও দ্বিধান্বিত নয়! কিন্তু কেন? অনেকের আশঙ্কা যে এ ধরনের আচরণ পরিবর্তনের পেছনে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সম্ভাব্য পরাজয়ের ভয়ই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। একের পর এক সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার প্রেক্ষাপটে এ ভয় স্বাভাবিকভাবেই আরও তীব্র হয়েছে।
প্রসঙ্গত, আওয়ামী লীগ এখন সংবিধান সমুন্নত রাখার কথা বলছে এবং এ জন্য যেকোনো মূল্য দিতেও যেন তারা প্রস্তুত। ১৯৯৫-৯৬ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াও একইভাবে সংবিধান মানার কথাই বলেছিলেন। বস্তুত, আওয়ামী লীগ-বিএনপি নির্বিশেষে সব সরকারি দলের আচরণই এক—ক্ষমতায় থাকলে তারা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়। আর বিরোধী দলে গেলে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে। আর এ ধরনের সুবিধাবাদের রাজনীতিই আমাদের বর্তমান সংকটের অন্যতম কারণ।
লক্ষণীয় যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রায় প্রতিনিয়তই জাতিকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আবার ফিরিয়ে আনলে তারা আর সহজে ক্ষমতা ছাড়বে না এবং তাদের পেছনের সামরিক শক্তি দীর্ঘমেয়াদিভাবে আমাদের ওপর জেঁকে বসবে। কিন্তু সমঝোতার ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে তার পেছনে সামরিক শক্তি থাকতে হবে কেন? এ ছাড়া আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা কিন্তু ভিন্ন। ২০০৭ সালে সংবিধানে যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান না থাকত, তাহলে মহাজোটের নির্বাচন বর্জনের ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ভেঙে পড়ার পর আমাদের দেশে সামরিক শাসন জারি হতো। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতির জন্যই কি আজ আমাদের অপেক্ষা করতে হবে?
পরিশেষে, খালেদা জিয়াকে অতীতে আমরা বলতে শুনেছি, ব্যক্তির চেয়ে দল বড় এবং দল থেকে দেশ বড়। তাঁকে আজ জাতির সামনে প্রমাণ করতে হবে যে এ কথা তিনি আসলেই বিশ্বাস করেন। একইভাবে প্রধানমন্ত্রীকেও জাতির সামনে দৃশ্যমান করতে হবে যে ব্যক্তিগত আবেগ ও দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জাতির বৃহত্তর কল্যাণে তিনি কষ্টকর সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
কারণ, ব্যক্তি শেখ হাসিনা এখন সরকারপ্রধান এবং তাই তাঁকে শুধু পরিবার ও দলের নয়, এ দেশের ১৬ কোটি মানুষের স্বার্থের কথা ভাবতে হবে। এ ছাড়া সংলাপ ও সমঝোতা করতে হয় প্রতিপক্ষের সঙ্গে, সুহূদদের সঙ্গে নয়।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।

No comments

Powered by Blogger.