একতরফা নির্বাচন করার ক্ষমতা নেই সরকারের by মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন

ইতিহাসের নজিরবিহীন কূটনৈতিক তৎপরতা ও দেশের সুধীসমাজের প্রাণান্তকর চেষ্টার পরও নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে বিরোধী দলের কোনো সংলাপ ও সমঝোতার সম্ভাবনা দৃশ্যমান হচ্ছে না। দু’পক্ষই পয়েন্ট অব নো রিটার্নের রাজনীতির দিকে অগ্রসর হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়। ক্ষমতাসীন দল হয়তো মনে করছে, বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনায় বসলেই তাদের রাজনীতির বারোটা বেজে যাবে; মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা রাজপথ ছেড়ে ঘরে ঢুকে যাবে, ফলে নির্বাচনে তাদের করুণ পরাজয় ঘটবে। যার জন্য তারা কোনো সংলাপ-সমঝোতায় আগ্রহ দেখাচ্ছে না। একটা একতরফা নির্বাচনের পথে ক্ষমতাসীন দল হাঁটছে। কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় একতরফা নির্বাচন করার মুরোদ ক্ষমতাসীন দলের নেই, ক্ষমতার একবারে শেষ পর্যায়ে তারা নির্দ্বিধায় রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ হারাবেন। বাংলাদেশের অনেক জেলায় তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না, যেমনটা থাকেনি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার রায়ের পর। ওই সময় বাংলাদেশের প্রায় ৪০টি জেলা প্রশাসন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল। বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও রাজশাহীসহ আরও অনেক জেলা বলতে গেলে বেশ কয়েক দিন রাজধানী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। ওই সব জেলার সরকারদলীয় কর্মী তো বটেই, জেলা প্রশাসকরা পর্যন্ত তাদের নিরাপত্তা চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। কাজেই বিরোধী জোট ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুললে, অন্তত ওই সব জেলায় একতরফা নির্বাচন করা সরকারের জন্য নিঃসন্দেহে দুরূহ হবে।
বিরোধী দল মনে করছে, সংলাপ-সমঝোতার মাধ্যমে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার না হলে শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে গিয়ে তারা কোনো সুবিধা করতে পারবে না। কাজেই চূড়ান্ত আন্দোলনে যাওয়া ছাড়া তাদের সামনে বিকল্প কোনো পথ আর খোলা নেই। তাতে আগামী দিনে দেশের রাজনীতিতে এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে- এতে কোনো সন্দেহ নেই। রাজনীতিকে পয়েন্ট অব নো রিটার্নের দিকে ঠেলে দেয়া ক্ষমতাসীনদের কোনোভাবেই সমীচীন হবে না। কেননা এ থেকে চূড়ান্তভাবে তারা কোনো সুবিধা পাবেন বলে মনে হয় না। উপরন্তু তারা চরম বেকায়দায় নিপতিত হবে। কারণ রাজনৈতিকভাবে তারা ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন সময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। একমাত্র সমঝোতার রাজনীতিই এ বেকায়দা থেকে তাদের বের করে আনতে পারে। ২০০৬ সালে বিএনপি যদি সমঝোতার রাজনীতির পথে হাঁটত, বিরোধী দলের দাবি মেনে নিত; তাহলে তারাই আবার হয়তো ক্ষমতায় যেত; ওই সময় সমঝোতা ও বিরোধী দলের দাবি না মেনে বিএনপি ইতিহাসের নজিরবিহীন বেকায়দায় নিপতিত হয়েছে। নিকট অতীতের এমন একটি দৃষ্টান্ত ক্ষমতাসীনদের সামনে দৃশ্যমান থাকলেও, তারা এ থেকে কোনো শিক্ষা নিচ্ছেন না। তারা রাজনীতিকে অনিশ্চয়তার পথে ঠেলে দিচ্ছেন। তারা কি একবার ভেবে দেখেছেন তাদের চার পাশের চিত্র? তাদের মন্ত্রী-এমপিরা জনরোষের শিকার হচ্ছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এবং বিদেশেও।
১০ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্যে আক্রমণের শিকার হন তখ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, ২৮ ডিসেম্বর নৌমন্ত্রী শাজাহান খান বায়তুল মোকাররম মসজিদে জুতা-বৃষ্টির শিকার হন, ৮ সেপ্টেম্বর টাঙ্গাইলের ভাসানী হলে পাটমন্ত্রী লতিফ ছিদ্দিকী দলীয় কর্মীদের তোপের মুখে পড়েন, ২৮ জানুয়ারি রাজধানীর কারওয়ান বাজারে শিবির কর্মীদের হামলার মুখে পড়েন অর্থমন্ত্রীর গাড়িবহর, এতে এক পুলিশ সদস্য মারাত্মকভাবে আহত হন, ১৪ নভেম্বর আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের গাড়িবহরে হামলা চালায় শিবির কর্মীরা, এ হামলায় মন্ত্রীর গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, পানিসম্পদ মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেনের বাড়িতে হামলা চালায় স্থানীয় জনতা, শ্রম ও কর্মসংস্থানমন্ত্রী রাজু উদ্দিন আহাম্মেদ রাজু ও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেন নিজ দলের বিক্ষুব্ধ কর্মীদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন। তা ছাড়া বেশ কয়েকজন এমপিও জনতার হাতে লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, বরিশালের ২ আসনের এমপি মনিরুল ইসলাম, কুষ্টিয়া ১ আসনের এমপি আফসার উদ্দিন আহাম্মেদ, নারায়ণগঞ্জের এমপি কবরী সারোয়ার ও নজরুল ইসলাম বাবু, ঢাকার এমপি সানজিদা খানম, নড়াইলের এমপি ফজিলাতুন্নেছা, গফরগাঁওয়ের এমপি গিয়াসউদ্দিন, যশোরের এমপি আঃ ওহাব প্রমুখ। সুতরাং এসব বিবেচনায় নিলে কোনোভাবেই রাজনীতিকে অশ্চিয়তায় ঠেলে দেয়ার যুক্তি খুঁজে পাওয়া যাবে না; বরং দল ও দেশের স্বার্থে, সমঝোতার রাজনীতিই ক্ষমতাসীনদের জন্য অধিকতর মঙ্গল বয়ে আনবে। বিএনপির আন্দোলন করার মুরোদ নেই, বিএনপি সরকার উৎখাতের শক্তি রাখে না- এসব অযাচিত ও অনাকাক্সিক্ষত মন্তব্য করাও সমীচীন নয়। বিএনপি সরকার উৎখাত করতে যাবে কোন দুঃখে? বিএনপি বর্তমান সরকারের প্রথম থেকেই ইতিবাচক রাজনীতির পথে হাঁটছে। সরকার অগণিত ইস্যু তৈরি করলেও বিএনপি এগুলোকে রাজনৈতিক ইস্যু বানিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলেনি। উদাহরণ দিতে গেলে এমন বহু দেয়া যাবে। একমাত্র শেয়ার মার্কেট বিপর্যয়কে বিএনপি যদি রাজনৈতিক ইস্যু বানাত, তাহলে অবধারিত বেকায়দায় পড়ত সরকার। বর্তমান সরকারের সময়ে বিএনপির এ ইতিবাচক রাজনীতি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গণতন্ত্রের জন্য মাইলস্টোন হয়ে থাকবে। কিন্তু বর্তমানে পয়েন্ট অব নো রিটার্ন আন্দোলনে যাওয়া ছাড়া বিএনপির সামনে বিকল্প পথ কী? ক্ষমতাসীনরা জাতিসংঘের আবেদনে সাড়া দিচ্ছেন না, আমেরিকার আবেদনে সাড়া দিচ্ছেন না, ইউরোপীয় ইউনিয়নের আবেদনও প্রত্যাখ্যান করছেন। তা ছাড়া চীন, ভারত, কানাডা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশসহ ইতিহাসের এক নজিরবিহীন কূটনেতিক তৎপরতার পরও সরকারের বোধোদয় হচ্ছে না, তাদের টনক নড়ছে না।
বিরোধী দলের চাওয়াটা কি বড় কিছু? তারা একটা সুষ্ঠু নির্বাচন চাচ্ছেন মাত্র। এটা দেয়ার মতো মনমানসিকতা যাদের নেই, তাদের দ্বারা দেশের কী উপকার আশা করা যায়? যারা শুধু ক্ষমতাকেই বড় করে দেখেন, জনগণের চাওয়া-পাওয়ার কোনো মূল্য দেন না বা দিতে জানেন না, তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। রাজনৈতিক সংকটের সমাধান না হলে দীর্ঘমেয়াদি অনিশ্চয়তার পাশাপাশি অযাচিত হস্তক্ষেপ ও সার্বভৌমত্ব হুমকির মধ্যে পড়তে পারে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন। প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করতে চান কেন? এবং বিরোধী দলকে অলআউট আন্দোলনের দিকে ঠেলে দিচ্ছেনই-বা কেন? এ প্রশ্ন আজ সমগ্র জাতির। প্রধানমন্ত্রী আজ কথায় কথায় সংবিধানের দোহাই দিচ্ছেন। কিন্তু ১৯৯৫ সালে তার তত্ত্বাবধায়ক দাবিও তো অসাংবিধানিক ছিল। দেশের স্বার্থে বিএনপি কি সেই অসাংবিধানিক দাবি মেনে নেয়নি? তাহলে আজ এত প্রশ্ন কেন? প্রশ্ন এ জন্য যে, আওয়ামী লীগ নিজেকে ছাড়া অন্য কাউকে চেনে না। অন্যের চাওয়া-পাওয়ার মূল্য আওয়ামী লীগের কাছে গৌণ।
রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া থাকে। এসব দাবি নিয়ে বিতর্কও থাকে। কিন্তু বিরোধী দলের নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবি নিরেট গণতান্ত্রিক ও সর্বজনীন দাবি। এ দাবি না মানলে সরকার অনিবার্য বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে। প্রধানমন্ত্রীকে মনে রাখতে হবে, ২০০৬ সালে একজন বিচারপতিকে নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধান হিসেবে মেনে নেয়া হয়নি; তাহলে একজন দলীয় প্রধানকে বিরোধী দল মেনে নেবে কোন যুক্তিতে? সে যুক্তিটা জাতির সামনে দাঁড় করানো প্রধানমন্ত্রীর অবশ্যই দায়িত্ব। পাঁচ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে হারার পর আগামী জাতীয় নির্বাচন দলীয়ভাবে অনুষ্ঠিত করাই যদি ক্ষমতাসীন দল একমাত্র সান্ত্বনা মনে করে, তাহলে করও কিছু বলার নেই। কিন্তু পরিস্থিতি পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয়, ওই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল ছাড়া অন্য কোনো দল অংশ নেবে না। এরই মধ্যে মহাজোটের শক্তিশালী শরিক জাতীয় পার্টি ঘোষণা দিয়েছে সব দল নির্বাচনে না এলে তারাও নির্বাচনে অংশ নেবে না। আর কিছু দিন ক্ষমতার স্বাদ ভোগ করার পর ইনু-মেননরাও হয়তো উল্টো সুরে কথা বলবেন। তখন হয়তো দেখা যাবে ক্ষমতাসীনদের বাগাড়ম্বর ফুটো বেলুনের মতো চুপসে গেছে। তখন তাদের বোধোদয় হলে হতেও পারে। কিন্তু এতে তাদের লোকসানের পাল্লাটা অনেক ভারী হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কেননা বাংলাদেশের বাস্তবতায় বিরোধী দলে যারা থাকেন, তারা এমনিতেই একটা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকেন; আর সরকার যদি তাদের উস্কে দেয়, তাহলে তো কোনো কথাই নেই।
নির্বাচনে জয়পরাজয় অনিবার্য, অবিশ্যম্ভাবী; এ বাস্তবতা মেনেই রাজনীতি করতে হয়। নির্বাচনে হারব বলে সংলাপ করব না, সমঝোতা করব না, তা হতে পারে না। রাজনীতিতে পরাজয়কে সহজভাবে মেনে নিতে হবে এবং বিজয়কে সহিষ্ণুতার সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে। আপনি কত বড় রাজনীতিবিদ সেটি বড় কথা নয়, আপনার কর্মকাণ্ড ও দৃষ্টিভঙ্গি দেশের জন্য কতটা ইতিবাচক ও মঙ্গলজনক জাতির কাছে সেটিই বড় বলে বিবেচ্য। কেউ যদি বিশ্বের সব ক্ষমতা পেয়ে যান আর আত্মাকে হারান তাতে কোনো প্রশান্তি নেই। শুধু ক্ষমতার জন্য বন্ধু, শুভাকাক্সক্ষী ও উন্নয়ন সহযোগী রাষ্ট্রের মতামতকে অগ্রাহ্য ও দেশের সুধীসমাজ এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গকে অপমান-অপদস্থ করা কোনো বড় মনের পরিচয় হতে পারে না। কোনো পেশাদার রাজনীতিক এমন জঘন্য ভুল করতে পারেন না। এটার একটা নেতিবাচক ফল রাজনীতির জন্য অবশ্যই আছে, যার শিকার হতে হবে সব রাজনীতিবিদের।
পরিশেষে বলতে চাই, বর্তমান সরকার একদলীয় ও একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে একটি ভুল গল্পের নাটক মঞ্চস্থ করতে যাচ্ছে। এটা দেশের জন্য, তাদের দলের জন্য, সর্বোপরি দেশের গণতন্ত্র, সাংবিধানিক শাসনব্যবস্থা ও সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্য কোনোভাবেই ভালো ফল বয়ে আনবে না। এর ফলে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হবে, তাতে নিঃসন্দেহে ফায়দা লুটবে ওৎ পেতে থাকা দেশী-বিদেশী অপশক্তি।
মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন : রাজনৈতিক বিশ্লেষক

No comments

Powered by Blogger.