স্বতঃসিদ্ধ ​বিষয় হয়ে উঠছে ব্যতিক্রমী

নারায়ণগঞ্জ–৫ উপনির্বাচনে বৃহস্পতিবার
বেলা ১১টায় একটি ফাঁকা ভোটকেন্দ্র
জাতীয় সংসদের নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের উপনির্বাচনের ফলাফল যে রকম হবে বলে অনুমান করা হয়েছিল, তা থেকে ভিন্ন হয়নি। এক অর্থে ৫ জানুয়ারির সঙ্গে এই ফলাফলের অসংগতি নেই। এই নির্বাচনের আগে সংঘটিত ঘটনাবলি, বিশেষ করে সাত খুনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট পরিস্থিতির কারণে কারও কারও মনে এই আশা তৈরি হয়েছিল যে সেখানকার সাধারণ ভোটাররা সম্ভবত ভিন্ন কোনো ফল তৈরিতে অগ্রণী হবেন। এই আশার পেছনে অতীতে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীকে হারিয়ে সেলিনা হায়াৎ আইভীর বিজয়ের বিষয়টিও কাজ করেছে।
কিন্তু ফলাফল এবার আর নাটকীয় হয়নি। সাধারণভাবে এই নির্বাচনের বড় দিক হলো এই যে সেখানে সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি। ভোটে কারচুপি হয়েছে বলে পরাজিত প্রার্থীর বক্তব্যকে আমরা যদি ধর্তব্যের মধ্যে না-ও নিই, তাও বলতে হবে যে এই নির্বাচনের ফলাফল ভিন্ন রকম হওয়ার প্রত্যাশা বিরাজমান রাজনৈতিক অবস্থার সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রী নিজে যেখানে একটি পরিবারের প্রতি তাঁর অকুণ্ঠ সমর্থন ব্যক্ত করেছেন, সেখানে এই পরিবারের কোনো সদস্যের পরাজয়ের প্রত্যাশা কতটা বাস্তবোচিত তা কম-বেশি সবাই বুঝতে পারেন। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফলের চেয়ে বেশি যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠেছে তা হলো একজন পুলিশ অফিসারের বক্তব্য। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী ‘ভোটকেন্দ্র দখলের সুযোগ না দেওয়ায়’ নারায়ণগঞ্জের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মো. বশিরউদ্দীনকে মুঠোফোনে হুমকি ও গালিগালাজ করেছেন সরকারদলীয় সংসদ সদস্য শামীম ওসমান। তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নাম ব্যবহার করে পুলিশ কর্মকর্তাকে কাবু করার চেষ্টা করেন বলেই পুলিশ কর্মকর্তার ভাষ্যে মনে হয়। এই ধরনের চাপের মুখে এএসপি বশিরউদ্দীন তাঁর অবস্থান থেকে সরে যাননি। তিনি যে ভূমিকা নিয়েছেন তা এখন অনেকের আলোচনার বিষয়, সামাজিক মাধ্যম বা সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁকে বিস্তর প্রশংসাও করা হচ্ছে। সরকারি দলের সংসদ সদস্য তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ কেবল যে অস্বীকারই করেছেন তা-ই নয়, তিনি জানিয়েছেন যে ওই পুলিশ কর্মকর্তার ‘অনৈতিক কাজের’ ব্যাপারে তিনি পুলিশের ঊর্ধ্বতন মহলকে জানিয়েছেন। সাংসদের ভাষ্য অনুযায়ী, ‘তাঁর বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই ডিপার্টমেন্টাল ইনকোয়ারি শুরু হয়েছে এবং তারা মনে হয় কিছু প্রমাণও পেয়েছে।’ বাংলাদেশে পুলিশের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের ব্যাপারে এত দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের উদাহরণ আর কতটা আছে তা খুঁজে দেখা যেতে পারে। পুলিশ কর্মকর্তার ভাষ্য অনুযায়ী তিনি যে কথাগুলো বলেছেন তার মধ্যে তিনটি বিষয় রয়েছে, যা সবার ভালো করে লক্ষ করা দরকার; কেননা এর মধ্যেই আছে সবার গ্রহণযোগ্য এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের সূত্র।
প্রথমত, তিনি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে বলেছেন যে নির্বাচনের দিনে তিনি একজন ভোটার এবং এর বেশি কিছু নন। তাঁর ভোটাধিকার প্রয়োগে যেমন কেউ বাধা দিতে পারেন না, তেমনি তিনিও অন্য কারও ভোটাধিকার প্রয়োগে বাধা দিতে পারেন না। নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছাড়া আর সব নাগরিকের পরিচয় যে ভোটারের চেয়ে বেশি কিছু নয়, সেটা হচ্ছে সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রথম শর্ত। এর ব্যত্যয় মানেই হলো নির্বাচনের ওপরে শক্তিশালী গোষ্ঠীর প্রভাব বিস্তার; সেখানে ক্ষমতাসীনেরা বেশি সুবিধা পাবেন, এটাই স্বাভাবিক। দ্বিতীয়ত, তিনি সংসদ সদস্যকে বলেছেন যে তিনি নির্বাচন কমিশনের অধীন, ফলে অন্য কারও আদেশ-নির্দেশ শুনতে তিনি বাধ্য নন। স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের অধীনে প্রশাসনকে নির্বাচনের দায়িত্ব পালনের দায়িত্ব দিলে যে চিত্রটি দাঁড়াবে আমরা তাঁর বক্তব্য থেকে বুঝতে পারি। তৃতীয়ত, তিনি বলেছেন আমি প্রজাতন্ত্রের চাকরি করতে এসেছি। সরকারি কর্মকর্তারা যে আসলে কোনো দলের নন; এমনকি নির্বাচিত সরকারের অন্যায্য কাজেরও তল্পিবাহক নন, সেটা নিশ্চিত করা গেলে কেবল সুষ্ঠু নির্বাচন নয়, সুশাসনও নিশ্চিত হবে। এই তিনটি বিষয়কে আলাদা আলাদাভাবে বিবেচনা না করে এগুলোকে একত্রে বিবেচনায় নিয়ে একবার ভেবে দেখুন একটি নির্বাচনের কী রূপ দেখতে পাবেন। অনেকেই বলবেন যে এগুলো কোনো নতুন বিষয় নয়; আমরা সবাই তা জানি। এটাই বলবেন যে এমন অবস্থা বাংলাদেশে যে ছিল না তা-ও নয়। নিঃসন্দেহে এগুলো সবার জানা বিষয়। যেকোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এগুলো স্বাভাবিক বলেই বিবেচিত হওয়ার কথা। কিন্তু পরিহাসের বিষয় হলো এই, যা হওয়ার কথা অতি-স্বাভাবিক, সেই কথা বলার জন্যই এখন একজন সাধারণ পুলিশ কর্মকর্তা খবরে পরিণত হয়েছেন এবং সবার প্রশংসা কুড়াচ্ছেন। যা হওয়ার কথা স্বতঃসিদ্ধ, তা হয়ে উঠেছে ব্যতিক্রমী; এতেই বিরাজমান পরিস্থিতির চিত্রটি বোঝা যায়। তার চেয়েও বড় বিষয় হলো যে ভবিষ্যতে যদি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য এবং সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে হয়, তবে এই তিনটি বিষয় নিশ্চিত করার আর কোনো বিকল্প নেই। ৫ জানুয়ারিতে যেমন তা নিশ্চিত হয়নি, তেমনি একটি উপনির্বাচনেও তার অনুপস্থিতি লক্ষণীয়। এই বৃত্তচক্র থেকে বেরোবার পথ কী—সেটা যেমন প্রশ্ন, তেমনি প্রশ্ন হলো, এই অবস্থার সুবিধাভোগীরা তা থেকে বেরোতে দিতে চান কি না।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।

No comments

Powered by Blogger.