প্রতিরক্ষা বাজেট: বর্মি-পাকিস্তানি পাঠ

মিয়ানমারের পার্লামেন্টেও প্রতিরক্ষা বাজেট নিয়ে যখন ভোটাভুটি হলো, পাকিস্তানের  মতো দেশেও যখন প্রথমবারের মতো সামরিক বাজেটের খরচাপাতি বিস্তারিত তুলে ধরা হলো, তখন আমাদের অর্থমন্ত্রী প্রতিরক্ষা বাজেটের জন্য মাত্র সাতটি বাক্য খরচ করেছেন৷ একটি প্রাচীন প্রবাদ আছে, ‘দ্য ডেভিলস ইন দ্য ডিটেইলস৷’ আমেরিকায় এ নামে চলচ্চিত্রও হয়েছে৷ এর মানেটা দাঁড়ায়, সং‌েক্ষপের মধ্যে সরষের ভূতটা লুকিয়ে থাকে, বিস্তারিত হলে ভূতটা বেরিয়ে পড়ে৷ ১৯৮৮-পরবর্তী ২৩ বছরে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাজেট প্রায় ১২ গুণ বেড়েছে৷ কিন্তু সেই শুরুতে যেভাবে দু-এক ছত্রে প্রতিরক্ষা বাজেটের ‘বিবরণ’ লেখা ​হতো, এখনো তা-ই চলছে৷ অথচ দেশে একটি তথ্য অধিকার আইন আছে৷ গত অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাজেট ছিল ১৫,১৮০ কোটি টাকা৷ এবারে শতকরা ৬ দশমিক ৬ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ১৬,৪৬২ কোটি টাকা (২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার)৷ ‘শিক্ষা খাতে ব্যয় বাড়াও, সামরিক খাতে ব্যয় কমাও’—এমন দেয়াললিখন এখন তেমন দেখা যায় না৷ এবারের অনুন্নয়ন বাজেট ১,৬৮,৬৯৯ কোটি টাকার৷ এতে ঘোষিত মতেই শিক্ষা-প্রযুক্তি ও স্বাস্থ্য বাজেট একত্র করলে তবে তা প্রতিরক্ষা বাজেটকে মাত্র ৬ শতাংশ টপকাতে পারে৷ ২০০৩ সালে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন দিল্লিতে ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যয় বৃদ্ধির নিন্দা করেছিলেন৷ বলেছিলেন, ‘এটা এতটাই বেশি যে, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষায় যেখানে ব্যাপকতর বিনিয়োগ দরকার, সেখানে উপযুক্ত বিনিয়োগ করা সম্ভব হচ্ছে না৷’ সামরিক ব্যয়ের তুলনা করাটা দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার৷ কে, কেন, কখন, কীভাবে করছেন, সেটা মুখ্য৷ অমর্ত্য সেন বলেছিলেন, এটা ঠিক যে, পাকিস্তানসহ অনেক দেশের মাথাপিছু সামরিক ব্যয়ের তুলনায় ভারত পিছিয়ে৷ কিন্তু সামগ্রিক প্রতিরক্ষা বাজেট এখনো ঢাউস৷ ‘মাথাপিছু ব্যয় মনে রেখে আপনার যুদ্ধ করার দরকার নেই৷ পাকিস্তানের চেয়ে ভারতের সামরিক ব্যয় অনেক বেশি৷ কনভেনশনাল অস্ত্রে ভারতের শ্রেষ্ঠত্ব থাকাটা ইসলামাবাদের উদ্বেগ বৃদ্ধি করেছে৷’
অমর্ত্য সেন সেই সঙ্গে স্মরণ করেছিলেন, ‘আমরা বিশ্বের প্রথম দরিদ্র দেশ, যারা গণতন্ত্র বরণ করেছে৷ এবং মোটামুটি চালিয়ে নিচ্ছে৷’ বাংলাদেশকে এখনো বিশ্বের দরিদ্রদের (১৭ শতাংশ লোক চরম দরিদ্র) অন্যতম ধরা হয়৷ কিন্তু মূল প্রতিরক্ষা নিরাপত্তাবর্ম গণতন্ত্র কতটা আছে, তা তর্কসাপেক্ষ৷ বাংলাদেশের দুই নিকটতম প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমার৷ একটিতে গণতন্ত্র ও সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব দুই–ই আছে৷ আর সেনাশাসিত মিয়ানমারও গণতন্ত্রের পথে হাঁটতে শুরু করেছে৷ ১ মার্চ ২০১৩ থাইল্যান্ডভিত্তিক দি ইরাবতি সাময়িকীর অনলাইন প্রতিবেদন দেখে থ হওয়ার জোগাড়৷ বলে কী, অং সান সু চি না আসতেই পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে ১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলারের প্রতিরক্ষা বাজেট পাস হয়েছে৷ উচ্চ ও নিম্নকক্ষের যৌথ অধিবেশনে ৪৪৫ জন এমপি প্রস্তাবিত বাজেটের পক্ষে, ৬০ জন বাজেট কমাতে এবং সাতজন ভোটে অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকেন৷ সেখানে বিরোধী দল প্রতিরক্ষা বাজেটের সমালোচনা করেছে৷ (মিয়ানমারে মোট বাজেটের মধ্যে শিক্ষায় মাত্র ৪ দশমিক ৪ শতাংশ এবং স্বাস্থ্যসেবায় ৩ দশমিক ৯ শতাংশ {বাংলাদেশের সমান}) ব্যয় বরাদ্দ মিলেছে৷ উপরন্তু, এয়ারক্র্যাফট কিনতে ২০০ মিলিয়ন ডলার, হালকা অস্ত্র কিনতে এক মিলিয়ন ডলার খরচেরও নির্দিষ্ট তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে৷ আমাদের এখানে ‘গৃহপালিত’ বা সরকারের চরম বিরোধী দলও ভাশুরের নাম মুখে আনে না৷ বাংলাদেশে আবুল মাল আবদুল মুহিত কেবল বলেছেন, ‘প্রয়োজনীয় যুদ্ধাস্ত্র ও আধুনিক রণসরঞ্জাম সংগ্রহ করা হবে৷’ এটা তো স্বচ্ছতা নয়৷ মিয়ানমারের ২০০৮ সালের সংবিধানমতে পার্লামেন্টের শতকরা ২৫ ভাগ আসন সামরিক বাহিনীর৷ এটা দেখে কোনো বঙ্গদেশীয় গণতন্ত্রীদের আফসোস করার কিছু নেই৷ কারণ, মিয়ানমারে বিরোধী দলের একজন এমপি বলেছেন, কতিপয় সামরিক এমপি তাঁদের এই বলে একা‌েন্ত অনুরোধ করেছেন যে, ‘আপনারা সামরিক বাজেট হ্রাসে চাপ দেবেন না৷ কারণ, প্রতিবেশীদের তুলনায় ইতিমধ্যে এটা কমে গেছে৷
 এর অর্থ বর্মি সামরিক বাহিনীও বোঝে আজকের যুগে এটা আলাপ-আলোচনার বিষয়৷ লুকোছাপার বিষয় নয়৷ পাকিস্তান সিনেটের প্রতিরক্ষাসংক্রান্ত কমিটি গত ২০ মে সামরিক বাজেট সম্পর্কে একটি মিডিয়া ব্রিফিংয়ের আয়োজন করে৷ ইতিহাসে এই প্রথম৷ সেখানে এমন সব খুঁটিনাটি তথ্য বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়, যা এত দিন জাতীয় নিরাপত্তার নামে গোপন রাখা হতো৷ বাংলাদেশের সামরিক খাতে ব্যয় নাকি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যদের তুলনায় কম৷ কারও মতে, এটা তাদের তুলনায় অর্ধেকের চেয়েও কম৷ এবারে দেখলাম, পাকিস্তানি মুখপাত্র দাবি করেছেন যে ‘পাকিস্তানের সামরিক ব্যয় এই অঞ্চলের মধ্যে সর্বনিম্নে৷’ কে, কীভাবে তুলনা করে মাথা চাপড়াবে, তা সত্যি এক ধাঁধা৷ ভারতের এবারের সামরিক বাজেট ৩৭ বিলিয়ন ডলার৷ এই টাকাটা বাংলাদেশের এবারের উচ্চাভিলাষী কিংবা লক্ষ্য​িবলাসী বাজেটের চেয়ে প্রায় পাঁচ বিলিয়ন ডলারের বেশি৷ বাংলাদেশের মোট জাতীয় বাজেটের অঙ্কটা ৩২ বিলিয়ন ডলারের কম৷ আবার চীনের প্রতিরক্ষা বাজেট ভারতের তুলনায় তিন গুণের বেশি৷ এটা ১১৫ বিলিয়ন ডলার৷ পাকিস্তান সেই দেশ, যারা গণতন্ত্র ভুলে ছিল৷ ‘ঘাস খাওয়ার শপথ’ নিয়ে পারমাণবিক বোমা বানিয়ে শৌর্যবীর্যে মজে ছিল৷ তারা এখন বলছে, ‘সামরিক স্থাপনা যেখানে যেমন আছে, তার রক্ষণাবেক্ষণ করতেই টাকা ফুরায়৷ আমরা এত অল্প টাকায় যুদ্ধজাহাজ, যুদ্ধবিমান, সাবমেরিন ইত্যাদি কিনতে পারি না৷’ গত মাসে ঘোষিত পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বাজেট প্রায় ৫ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার৷ এটা তুরস্কের বাজেটের এক-চতুর্থাংশ৷ পাকিস্তানি মুখপাত্রের কথায় এবারে তাঁদের ‘লেজ’ দীর্ঘতর হয়েছে৷ কিন্তু দাঁত খর্ব হয়েছে৷ দাঁত হলো যুদ্ধাস্ত্র৷ মোট প্রতিরক্ষা বাজেটের ২২ শতাংশ দিয়ে গত বছরে তারা অস্ত্র কিনেছিল৷ বাকিটা ছিল অন্যান্য খরচ৷ এবারে এটা ১ শতাংশ কমে ২১ শতাংশ হয়েছে৷ সেনাবাহিনী  (নৌ ও বিমান ব্যতিরেকে) মোট প্রতিরক্ষা বাজেটের ৭০ শতাংশ পায় বটে; কিন্তু ৬৩ শতাংশই খরচ করে বেতন-ভাতায়৷
আমাদের প্রতিরক্ষা বাজেটের কত শতাংশ ‘দাঁতে’ আর কতটা ‘লেজে’ খরচ হবে, তা বোঝার উপায় নেই৷ রাশিয়ার কাছ থেকে আট হাজার কোটি টাকার সমরাস্ত্র কেনা হলো৷ কিন্তু তার অর্থসংস্থান কোথায়, কীভাবে হবে, আমজনতা সেটা বাজেটের পাতা উল্টিয়ে হদিস পাবে না৷ ভারতের বাজেটেও ওই ‘দাঁত’ ও ‘লেজের’ তথ্য পরিষ্কার৷ ‘দাঁতে’ ব্যয় আগের বছরের চেয়ে এবারে ৩ দশমিক ১৮ শতাংশ বাড়িয়ে ৭৫ হাজার ৭৭৯ কোটি রুপি ধার্য করা হয়েছে৷ সবচেয়ে লক্ষণীয় হলো, কোন বাহিনী কী ধরনের সমরাস্ত্রে কত খরচ করবে, তাও প্রকাশ করা হয়েছে৷ যেমন এয়ারক্র্যাফট কিনতে এই অর্থবছরে সেনাবাহিনী প্রায় ২,১২৮ কোটি রুপি, নৌবাহিনী ৩,৩৩০ কোটি রুপি ও বিমানবাহিনী ১৬,২৭১ কোটি রুপি ব্যয় করবে৷ এভাবে খাতওয়ারি অনেক কিছুই স্পষ্ট৷ এবারে অর্থমন্ত্রী নির্দিষ্টভাবে একটি ভালো তথ্য দিয়েছেন৷ বলেছেন, ‘প্রতিরক্ষানীতি বর্তমানে চূড়ান্তকরণের জন্য প্রক্রিয়াধীন আছে৷’ কিন্তু এটা তো ঠিক গোপনীয় বিষয় হওয়ার নয়৷ সরকারি ঘোষণার বিষয় নয়৷ জনগণের একধরনের কার্যকর অংশগ্রহণ তো লাগবে৷ আমাদের অনেক বিশেষজ্ঞ মুখে বলেন ঠিকই পাল্লা দেওয়া পোষাবে না, কিন্তু টাকার অঙ্কের দিকে চোখ বড় করে তাকালে, প্রধানত আশপাশের দেশের দিকে দ্রুত মনোযোগ আকর্ষণ করাতে তাঁদের বাধে না৷ আমরা এটাও দেখব যে ভারত তার প্রতিরক্ষা বাজেট জিডিপির ১ দশমিক ৭৯ শতাংশে সীমিত রেখেছে৷ এটা গত তিন দশকের মধ্যে সর্বনিম্নে৷ (নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ১০ মার্চ ২০১৩) আওয়ামী লীগের প্রবণতা হলো প্রতিরক্ষা বাজেটকে শুধুই ঊর্ধ্বমুখী করা৷ এবারে প্রস্তাব করা হয়েছে জিডিপির ১ দশমিক ৪ শতাংশ৷ পাকিস্তানের সামরিক ব্যয়ের অনুপাত যদি তাদের জিএনপির (গ্রস ন্যাশনাল প্রোডাকশন) হিস্যার সঙ্গে তুলনা করা হয়, তাহলে সেটা হবে অবশিষ্ট বিশ্বের গড় সামরিক ব্যয়ের দ্বিগুণ৷ বহুকাল ধরে পাকিস্তান এ ক্ষেত্রে বিরুদ্ধ স্রোতের যাত্রী৷ তার অর্থনীতিতে এই গোঁয়ার্তু​িম কুলায় কি না, সেটা বুঝতে তারা মগজ খাটাতে চায়নি৷
পাকিস্তান জিএনপির ৬ শতাংশ ও ভারত তার জিএনপির ৩ শতাংশ প্রতিরক্ষায় খরচ করে৷ পাকিস্তানি গবেষকসোহেল মাহমুদ ২০০৭ সালে প্রকাশিত তাঁর বইয়ে (গুড গভর্ন্যান্স রিফর্ম এজেন্ডা ইন পাকিস্তান) মন্তব্য করেন যে, ‘দুটি দেশই সামরিক খাতে অনেক বেশি এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ঢের কম খরচ করে৷ মানব উন্নয়নের তুলনায় এই অবস্থা তাদের, এমনকি আফ্রিকার অনেক দেশের চেয়ে পিছিয়ে দিয়েছে৷’ মাহবুব উল হক বলে গিয়েছিলেন, যেহেতু পাকিস্তান সব সময় ভারতের প্রতিক্রিয়ায় সামরিক ব্যয় বাড়ায়, তাই তারা এটা থেকে সহজে বেরোতে পারবে না৷ ইদানীং উল্লিখিত ‘দ্য ডেভিলস ইন দ্য ডিটেইলস’ কথাটির ভিন্ন সংস্করণ বেরিয়েছে৷ এখন বলা হচ্ছে, গভর্নিং ইজ ইন দ্য ডিটেইলস৷ কিংবা দ্য ট্রুথ ইজ ইন দ্য ডিটেইলস৷ এবারের বাজেট ডকুমেন্টসের ওজন সাত কেজির বেশি৷ এতে প্রতিরক্ষা বাজেটের জন্য অর্থমন্ত্রী তাঁর ১৬৩ পৃষ্ঠার বক্তৃতায় সাতটি বাক্য খরচ করেছেন৷ সাতটি বাক্য প্রতিরক্ষা খাতের স্বচ্ছতা সূচক কি না, সেটা মনে প্রশ্ন জাগায়৷ বাজেট-পরবর্তী সাংবাদ সম্মেলনে এ রকম চেপে যাওয়ার প্রশ্ন তোলা হলে তিনি উত্তরটাও চেপে যান৷ খুব সরল প্রশ্ন করব, পাকিস্তান ও মিয়ানমার যদি তাদের সামরিক বাজেটের বিস্তারিত তথ্য জনগণের কাছে প্রকাশ করতে পারে, সংসদে ভোটাভুটি করতে পারে, তাহলে বাংলাদেশের কী হয়েছে? আশা করব, প্রতিবেশীদের দেখে হলেও অবিলম্বে প্রতিরক্ষা বাজেটের বিষয়ে একটি ব্রিফিংয়ের আয়োজন করা হবে৷ সংসদে প্রতিরক্ষা বাজেট প্রশ্নে বিস্তারিত আলোচনা হবে৷
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.