উত্তপ্ত নগরে চাই স্বস্তির সবুজ

সূর্যোদয়ের সময় ঢাকাকে দুচোখ মেলে দেখার জন্য নির্বিঘ্নেই ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম যানজটমুক্ত রাস্তার পর রাস্তা দিয়ে। ধানমন্ডির ল্যাবএইড হাসপাতালের পাশেই সায়েন্স ল্যাবরেটরির সীমানাপ্রাচীরের বিপরীতের সড়কদ্বীপে এক চিলতে উদ্যান দৃষ্টি আকর্ষণ করল। এত পরিচ্ছন্ন দৃষ্টিনন্দন একটি সড়কদ্বীপ ঢাকা শহরে আছে, ভাবতেই মনটা ভালো হয়ে গেল। উদ্যানে পরিচর্যারত ধানমন্ডি নিবাসী রাফেয়া আবেদিন আমাকে ভেতরে ডেকে নিয়ে যত্ন করে ছাঁটা নরম ঘাসের চাদরে খানিকক্ষণ বসে থাকার অনুমতি দিলেন। কত যে দেশি-বিদেশি গাছ আর ফুলের সমাহার এই ছোট্ট ছিমছাম জায়গাটার ভেতরে, না বসলে কোনো দিন জানাই হতো না। ভেতরে কৃত্রিম লেক ও দুটি ছোট্ট জলাধারও আছে। সেখানে ফুটে আছে পদ্ম, শাপলা, ওয়াটার লিলিসহ নানান জলজ উদ্ভিদ। কৃত্রিম লেকে কিলবিল করছে ব্যাঙ, ব্যাঙাচি, শামুক, ঝিনুকসহ ছোট ছোট দেশি মাছ। উদ্যানের মাথায় কৃত্রিম পাহাড়সারির একদিকে কবুতরের ঘর বানিয়ে দেওয়া। কোথা থেকে যে একের পর এক কবুতর সেখানে এসে বসছে, আবার কোথায় যে চলে যাচ্ছে! পাহাড়ের পাথরের ওপরে বসে পাখনায় মুখ ঘষছে কয়েকটা হাঁস। পাহাড়ের পেছনে বিরাট এক জামগাছ। সেখানে শত পাখির কিচিরমিচির। ঢাকার মতো অপরিকল্পিত নগরে পাখির ডাকে ভোর হয়! ঘুঘু, শালিক, চড়ুই, দোয়েল আর ফিঙ্গেদের চিনতে পারলাম। ঘাসের ওপর থেকে উঠে গিয়ে কৃত্রিম পাহাড়ের নিচে যখন বসলাম, গায়ে লাগল পরম শািন্তর শীতল বাতাস। এই শািন্তর পরশ কোনো দিন দিতে পারবে না শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র। এখানে কাঞ্চন, জাপানি কাশিয়া, চেরি, গোল্ডেন শাওয়ার, টাইগার লিলিসহ নানা প্রজাতির দেশি-বিদেশি লিলি, বাগানবিলাস, রক্তকরবী, দোপাটি, বকুল, রঙ্গন, জবা, টগর, হাসনাহেনা, কয়েক জাতের কাঠগোলাপ, লাউ, চিচিঙ্গা ইত্যাদি গাছের ফাঁক-ফোকর দিয়ে ফুটে থাকা বর্ণিল আভাময় ফুলের সমাহার এক মুহূর্তেই মনের স্বাস্থ্য চাঙা করে দিতে পারে। উদ্যানের চারদিকের ফুটপাতও সাজানো হয়েছে টবের গাছ দিয়ে।
ঢাকার মতো জনাকীর্ণ নগরের ফুটপাত তো তাহলে চাইলেই পরিচ্ছন্ন রাখা সম্ভব। চাই কেবল একটুখানি যত্নশীল নজরদারি। উদ্যানের ভেতরে কালো টাইলসে নির্মিত ভাস্কর্য ছাড়াও আছে ছোট ছোট কয়েকটি ভাস্কর্য। রাফেয়া আবেদিন জানালেন, এ রকম আরেকটি উদ্যান তিনি রচনা করেছেন পুরান ঢাকার তাঁতীবাজারে; সিটি করপোরেশনের অনুমতি নিয়ে সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে। রাফেয়ার উদ্যানের পাশেই আরেকটি উদ্যান করার চেষ্টা করেছে ল্যাবএইড কর্তৃপক্ষÿ। গাছগুলো ধূলিমলিন। ভেতরে ছড়িয়ে আছে পথচারীদের ছুড়ে ফেলা অপাচ্য বর্জ্য। একটি ডেরাও দেখা গেল, কোনো এক গৃহহীন নারীর আশ্রয়। কেবল উদ্যান তৈরি করাই যথেষ্ট নয়, যত্নও নিতে হবে নিয়মিত। রাফেয়া অভিজ্ঞতা থেকে বললেন, দেশের সব নগরের সব সড়কদ্বীপে এ রকম উদ্যান তৈরি করা অনায়াসেই যায়, কিন্তু যত্ন না নিলে তা কোনোভাবেই টিকে থাকবে না। এর পেছনে খরচও কম নয়। রাফেয়া নিজের খরচেই করছিলেন যত্ন নেওয়ার কাজ। একসময় অপারগ হয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে সহায়তা কামনা করেন। অবশেষে এনসিসি ব্যাংক ব্যয় বহন করতে রাজি হয়। ঢাকা শহরে পার্ক বলতে রমনা পার্ক আর চন্দ্রিমা উদ্যান। নগরে সুস্থ জীবনমানের জন্যই অন্তত ২৫ ভাগ জায়গায় সবুজায়ন থাকতে হবে। ঢাকা শহরের ১০ ভাগেরও কম জায়গা সবুজ, যা বর্ধিত জনসংখ্যা ও নীতিহীনতার আগ্রাসনে ক্রমহ্রাসমাণ। অন্যদিকে লেক, নদী দখল করেও তৈরি হচ্ছে ন্যাড়া অবকাঠামো। তদুপরি বাড়ছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের অবাধ ব্যবহার। কেবল জলবায়ু পরিবর্তনকে দুষলেই চলবে কেন, নগরে কেন্দ্রীভূত শিল্পপ্রতিষ্ঠান, গাছপালার বিলুপ্তি আর বাড়িতে-গাড়িতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ব্যবহার ঢাকার বাতাসকে উত্তপ্ততর করে তুলছে।
স্বল্প আয়ের মানুষ বাধ্য হচ্ছে অস্বস্তির জীবন কাটাতে। বিশ্বের বসবাস-অযোগ্য নগরের তালিকায় ঢাকা ইতিমধ্যেই অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সরকার জাতীয় নগর নীতিমালা, ২০১৪ প্রণয়ন করতে যাচ্ছে। এই নীতিমালায় অবশ্যই সবুজায়নকে গুরুত্ব দিতে হবে। এমনকি বিল্ডিং কোডে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে ভবন সবুজায়নের বাধ্যবাধকতা। সুস্থ নগরের ভবন যেমন পরিকল্পিত হওয়া দরকার, তেমনি উন্মুক্ত স্থানও অত্যাবশ্যক। কিন্তু যে নগরের প্রতি বর্গকিলোমিটারে কুড়ি হাজার মানুষের বাস, সেখানে উন্মুক্ত স্থান নিশ্চিত করা সহজ হবে বলে মনে হয় না। কর্মসংস্থানের বিকেন্দ্রীকরণ তাই হতে হবে অন্যতম নগরনীতি। এ দেশে নগরায়ণ যেভাবে দ্রুত বিস্তৃত হচ্ছে, তাতে আগামী ৫০ বছরে গ্রামবাংলা বলে কিছু থাকবে না। সে ক্ষেত্রে নগর নীতিমালায় অদূর ভবিষ্যতের কৃষি ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে দিকনির্দেশনা থাকা জরুরি৷ রাফেয়া আবেদিনের মতো অভিজ্ঞ মানুষেরা থাকতে এ রাষ্ট্রের নগর কেন বৃক্ষশূন্য, পাখিশূন্য হবে! রাফেয়া বলেন, রাস্তার পাশে বা সড়ক বিভাজকে সব ধরনের গাছ লাগানো যাবে না। উপযুক্ততা বিবেচনা করেই লাগাতে হবে। তবে গাছ লাগানো অনেক সহজ, রক্ষা করার জন্য চাই নিরন্তর যত্ন। এ রকম সক্ষম ব্যক্তি-উদ্যোক্তাদের সরকার নগরের সবুজায়ন ও সৌন্দর্যবর্ধনের কাজে সম্পৃক্ত করতে পারে। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে রাফেয়া বলেন, নীতিমালাই যথেষ্ট নয়, সবুজ স্বস্তিদায়ক নগর গড়তে হলে নগর উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে জনগণকে সম্পৃক্ত করতেই হবে। প্রচারাভিযানের মাধ্যমে জনগণের শিক্ষা, সচেতনতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারলে নগরবাসী নিজেরাই নিজেদের চারপাশ সাজিয়ে নেবে, সিটি করপোরেশনের কেবল দিকনির্দেশনা প্রদান ও তত্ত্বাবধান করলেই চলবে।
শান্ত নূরুন্নবী: উন্নয়নকর্মী।
shantonabi@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.