হামিদ মিরের ভাবনা ও আমরা by আলী ইমাম মজুমদার

হামিদ মির পাকিস্তানের প্রগতিশীল সাংবাদিক হিসেবে বহুলভাবে পরিচিত৷ মাত্র ৪৮ বছর বয়সী এই সাংবাদিকের জীবন ঘটনাবহুল৷ আর নানা কারণে ব্যাপকভাবে সমালোচিত ও সমাদৃত তিনি৷ বর্তমানে জিয়ো টিভির নির্বাহী সম্পাদক৷ অনেক চাঞ্চল্যকর টক শো সঞ্চালনা করে চলেছেন৷ তিনি একজন খ্যাতনামা নিরাপত্তা বিশ্লেষকও৷ আবার এই সময়ের অনেক আলোচিত ব্যক্তির সাক্ষাৎকার গ্রহণের সুযোগও লাভ করেছেন তিনি৷ টিভি অনুষ্ঠানের পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন সংবাদপত্রের জন্য লিখেও থাকেন৷ এসব লেখার কোনো কোনোটি বিতর্কও সৃষ্টি করেছে৷ তবে পাঠকের ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে তঁার লেখা ও বক্তব্যের প্রতি৷ বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারসংক্রান্ত বিষয়ে তঁার মতামত আমাদের জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রতিকূলে গেছে৷ তাই সেসব মতামতের বিপরীতে আমাদের শক্ত অবস্থানও জানান দেওয়া হয়েছে৷ অন্যদিকে, তঁার বহু লেখা মৌলবাদ ও অস্ত্রের রাজনীতির বিরুদ্ধে৷ সেগুলো অনেকটা আমাদের লালিত বিশ্বাসের কাছাকাছি৷ ঠিক তেমনই একটি লেখা ‘আমি কি একজন বিশ্বাসঘাতক’ প্রকাশিত হয়েছে প্রথম আলোয়৷ নিবন্ধটি আমাদের চেতনার জগৎকে নতুনভাবে আলোড়িত করেছে৷

উল্লেখ করতে হয়, হামিদ মির অতিসম্প্রতি রাজপথে জঙ্গি হামলার শিকার হন করাচিতে৷ ছয়টি গুলি লাগে তঁার শরীরে৷ প্রাণে বেঁচে গেছেন৷ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকাকালে তঁার পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, এ হামলার পেছনে ছিল পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা, যা সংক্ষেপে আইএসআই নামে পরিচিত৷ আক্রান্ত হওয়ার আগে হামিদ মিরও জিয়ো টিভির কর্তৃপক্ষের কাছে আইএসআইয়ের মদদে তঁার প্রাণনাশের চেষ্টার আশঙ্কার কথা জানিয়েছিলেন৷ এ ধরনের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আইএসআই জিয়ো টিভি বন্ধ করে দিতে সরকারের কাছে প্রস্তাব দেয়৷
বিস্ময়ের ব্যাপার যে, নিষিদ্ধঘোষিত কতিপয় ধর্মীয় মৌলবাদী সংগঠন রাজপথে মিছিলও করতে থাকে হামিদ মিরকে বিশ্বাসঘাতক আখ্যায়িত করে৷ জিয়ো টিভি বন্ধের প্রস্তাবটি গৃহীত হয়নি৷ তঁাকে বিশ্বাসঘাতক আখ্যায়িত করায় হামিদ মির স্বভাবত ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ হয়েছেন৷ তিনি অবশ্য উল্লেখ করেছেন, তঁার দেশে অনেক দেশপ্রেমিককেই সেরূপে আখ্যায়িত করা হয়েছিল৷ কাউকে হত্যা করা হয়েছে আর কেউ বা হয়েছেন নির্যাতনের শিকার৷ তঁাদের অনেকের নাম তিনি উল্লেখ করেছেন আলোচিত নিবন্ধে৷ বলেছেন, সেসব ব্যক্তির অনেকেই ১৯৭৩ সালে বর্তমান পাকিস্তানকে একটি রাজনৈতিক কাঠামোয় আবদ্ধ করতে সংবিধান রচনায় সহায়তা করেছিলেন, তঁাদের মধ্যে তিনি উল্লেখ করেছেন ওয়ািল খান, নওয়াব বুগতিসহ কয়েকজনের নাম৷ সে তালিকায় তিনি এনেছেন জুলফিকার আলী ভুট্টোর নামও৷ হামিদ মির আরও ক্ষুব্ধ যে, যঁারা পাকিস্তান সৃষ্টিতে অবদান রেখেছিলেন, তঁাদের কাউকে সময়ে সময়ে বিশ্বাসঘাতক বলা হয়েছে দেশটিতে৷ পরিশেষে তিনি লিখেছেন, তঁারা বিশ্বাসঘাতক বলে আখ্যায়িত হলে তিনিও তা হতে রাজি আছেন৷
হামিদ মির বাংলাদেশের মানুষের কাছে সুপরিচিত৷ আলোচিত নিবন্ধে তিনি পাকিস্তানে কোন কোন দেশপ্রেমিককে বিশ্বাসঘাতক বলা হয়েছিল, তঁাদের অনেকের নাম উল্লেখ করেছেন৷ তিনি ভালোভাবে জানেন, আমাদের দেশটি একসময় পাকিস্তানের অংশ ছিল৷ তিনি জানেন, সেই পাকিস্তানে এ অপবাদ থেকে রেহাই পাননি পাকিস্তান প্রস্তাবের উত্থাপক শেরেবাংলা৷ বিশ্বাসঘাতক বলা হয়েছিল তঁাকে৷ এ অঞ্চলকে পাকিস্তানভুক্তির জন্য যেসব নেতা সংগ্রাম করেছিলেন, তঁাদের পুরোভাগেই ছিলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী৷ তঁাকেও বলা হয়েছিল ভারতের লেলিয়ে দেওয়া কুকুর৷ এ অঞ্চলে পাকিস্তান আন্দোলনে আরেক রূপকার মওলানা ভাসানীর ললাটেও রাষ্ট্রদ্রোহী আর বিশ্বাসঘাতকের শিরোপাই জুটেছিল অখণ্ড পাকিস্তানে৷ সেদিনকার তরুণদের মধ্যে পাকিস্তান আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু৷ সেই পাকিস্তানে তঁার জন্য জুটেছিল শুধু জেল, জুলুম আর বঞ্চনা৷ ১৯৭০-এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েও তিনি ক্ষমতা পাননি৷ হয়েছিলেন বন্দী৷ রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে চলেছিল বিচার৷ আর পাকিস্তানি দখলকার বাহিনীর দমন-নির্যাতনে প্রাণ দিয়েছিল ৩০ লাখ বাঙালি৷ এসবের কোনো কিছুই উল্লেখ করেননি হামিদ মির৷ অথচ তিনি আজ যে সমস্যার মুখোমুখি, এর পটভূমিকা রচিত হয়েছিল এগুলোর মাধ্যমেই৷
ওপরের বক্তব্যগুলো রাখা হলো হামিদ মিরের নিবন্ধের অসম্পূর্ণতার প্রতি তঁার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে৷ অতীত অখণ্ড৷ পঞ্চাশোর্ধ্ব যেকোনো বাঙািলর স্মরণে সে অতীত অম্লান হয়ে আছে৷ থাকার কথা হামিদ মিরদেরও৷ কিছু বিষয়ে আমাদের সঙ্গে ভিন্নমত থাকলেও হামিদ মির একজন প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি৷ তিনি ভুট্টোকে কৃতিত্ব দিয়েছেন৷ এটা সত্যি যে, ভুট্টো ইয়াহিয়া খান আর জিয়াউল হকদের চেয়ে ব্যতিক্রম৷ তবে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিয়োগান্ত অধ্যায়ের তিনিও একজন খলনায়ক৷ এটা বাঙালিরা বিশ্বাস করে৷ আর তাদের বিশ্বাস যথার্থ যুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত৷
এত সব সত্ত্বেও আলোচিত নিবন্ধে হামিদ মিরের অনুভূতির প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল৷ তঁার দেশটিতে অস্ত্রের ঝংকার বন্ধ হয়ে গণতন্ত্রের ধ্বজা উড্ডীয়মান থাকুক, এটা আমরাও চাই৷ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় মৌলবাদকে সে দেশে যারা আজকের স্তরে নিয়ে এসেছে, তাদের বিরুদ্ধে হামিদ মিরের ক্ষোভের সঙ্গে আমরাও সহমত পোষণ করি৷
আলোচিত নিবন্ধে আমাদের নেতাদের অবমূল্যায়নের জন্য অনুযোগ করলাম৷ হামিদ মির কিন্তু সহজেই বলতে পারেন, তোমরা কী করেছ? তঁার লেখায় তিনি পাকিস্তানের জাতির জনকের ভগ্নি ফাতেমা জিন্নাহকে অবমূল্যায়নের জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন৷ আর আমরা তো আমাদের জাতির জনককে হত্যাই করেছি সপরিবারে৷ শুধু হত্যা নয়, তঁাকে কত নিচে নামানো যায়, আজও অব্যাহত সে প্রচেষ্টা৷ ১৯৭৫-এর পর ২১ বছর রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোতেও বেতার-টিভিতে স্থান পেত না তঁার একটি ছবি কিংবা বাণী৷ সেই ২১ বছরের মধ্যে আজকের মহাজোটের শরিক এরশাদের নয় বছরও ছিল৷ স্বাধীনতাসংগ্রামের সংগঠক জাতীয় চার নেতাকে আমরা হত্যা করেছি কারা অভ্যন্তরে৷ তঁাদের স্মৃতি রক্ষার্থে তেমন কিছু করছি, এমনটা কেউ বলতে পারবে না৷ তা ছাড়া, স্বাধীনতাসংগ্রাম শুরু হলে রাজনৈতিক নেতৃত্বের পরপরই সামরিক বাহিনীর বাঙািল কর্মকর্তাদের ভূমিকা অনেক সহায়ক ছিল৷ তঁারাও যে হানাদার-আক্রান্ত দেশবাসীর সঙ্গে আছেন, এ খবর মুক্তিযুদ্ধের গতিকে দিয়েছিল ইতিবাচক মাত্রা৷ সম্মানিত ছিলেন তঁারা জাতির কাছে৷ তঁাদের অনেককেই আমরা হত্যা করেছি৷ কাউকে বন্দুকের গুলিতে আর কাউকে বা ফঁাসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে৷ হামিদ মির অতি অবশ্যই এদিকে আঙুল তুলে দেখাতে পারেন৷
যেসব নাম উল্লেখ না করার জন্য হামিদ মিরের ওপর ক্ষোভ, তঁাদের স্মৃতিকে আমরাও এখন যতটুকু সম্ভব এড়িয়ে চলি৷ দিশেহারা ও ঋণজালে জর্জরিত লাখ লাখ কৃষক-প্রজাকে মহাজনের ঋণমুক্ত করা আর জমিদারি উচ্ছেদের জন্য শেরেবাংলার ছিল নিরন্তর লড়াই৷ এ কাহিনি কিংবদন্তিসম৷ তিনি আজ জন্ম-মৃত্যুদিনে সংবাদপত্রের ভেতরের পাতায় এক কলামের অংশবিশেষেই সীমাবদ্ধ থাকেন৷ আরেকটি নাম শহীদ সোহরাওয়ার্দী৷ সমালোচনা কিছু থাকা সত্ত্বেও এ ভূখণ্ডে তিনিও নন্দিত ব্যক্তি৷ ১৯৪৭-পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন ব্যক্তিদের ফ্যাসিবাদী আচরণের বিরুদ্ধে যঁারা প্রতিবাদমুখর হয়েছিলেন, তিনি ছিলেন তঁাদের পুরোভাগে৷ আজকের ক্ষমতাসীন দলটিকে দৃঢ় জনভিত্তি দিতেও অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেন তিনি৷ অথচ অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, তঁাকে আমরা ভুলতে পারলেই বঁাচি৷
আসে মওলানা ভাসানীর কথা৷ আসামে বাঙালি কৃষকের স্বার্থ রক্ষায় জীবনপণ লড়াই ভুলে যাওয়ার বিষয় নয়৷ তা ছাড়া, দেশভাগের পর ১৯৪৯ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে নিয়মতান্ত্রিক বিরোধী দল হিসেবে গঠন করেন আওয়ামী মুসলিম লীগ৷ পরে নাম হয় আওয়ামী লীগ৷ ১৯৫৭ পর্যন্ত এর সভাপতি ছিলেন তিনি৷ এখন আমরা তঁার নাম সম্ভব হলে পাল্টে দিই৷ এমনকি তঁার সৃষ্ট দলটির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতেও এ নাম আসে না৷ অথচ জাতির জনক এসব নেতার প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ও বিনীত ছিলেন, এমনটাই ইতিহাস বলে৷ তবে আমরা এখন তঁাদের ভারমুক্ত হতে সক্রিয় রয়েছি৷ শুধু হামিদ মিরকেই দোষ দিই কেন?
হামিদ মির পাকিস্তানে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার৷ এর আগেও তিনি প্রাণনাশের প্রচেষ্টাসহ বিভিন্ন হয়রানির সম্মুখীন হয়েছিলেন৷ তবে সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করে চলছেন সব প্রতিবন্ধকতা৷ তিনি নিশ্চয়ই খবর রাখেন, আমরাও কিন্তু এখানে বহুমাত্রিক সন্ত্রাস মোকাবিলা করে চলছি৷ হামিদ মিরের মতো আমাদেরও প্রত্যাশা, সংবিধান হোক সব কার্যক্রমের নিয়ন্ত্রক৷ তঁার এ চেতনার সঙ্গে আমরাও একাত্ম৷
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.