র‌্যাব বিলোপের দাবি এবং রাজনীতি by কামাল আহমেদ

গত ২৬ মার্চ বেশ তোড়জোড়ের সঙ্গে পালিত হয়েছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) দশম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। বহুল আলোচিত এবং বিতর্কিত এই বাহিনীটির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ঢাকার প্রধান প্রধান সংবাদপত্রগুলোতে ব্যয়বহুল ক্রোড়পত্রও প্রকাশিত হয়েছে, যাতে কয়েকজন অপরাধ বিষয়ে অভিজ্ঞ সাংবাদিক র‌্যাবের গুণকীর্তনের বয়ান দিয়েছেন। স্পষ্টতই এটা ছিল ভাবমূর্তি উন্নয়নের একটি উদ্যোগ। প্রচারণার জগতে ভিজ্যুয়াল নাটকীয়তার মূল্য বিবেচনায় র্যাব একটি বিজ্ঞাপনচিত্রও প্রকাশ করেছে, যেটা বলিউড এবং ঢালিউডের মিশ্রণ বলেই মনে হয়। ওই ভিডিওতে দেখা যায় যে একজন তরুণী একলা চলার পথে একদল দুষ্কর্মার হামলার শিকার হলে সেখানে হঠাৎ করে র‌্যাব সদস্যরা হাজির হয়ে তঁাকে কীভাবে বিপদ থেকে রক্ষা করছেন।

এরও কিছুদিন আগে (ফেব্রুয়ারিতে) র‌্যাবের আতিথেয়তায় পদস্থ অধিনায়ক বা কর্মকর্তারা এবং অপরাধবিষয়ক সংবাদদাতাদের একটি বড় অংশ (প্রথম আলো ছাড়া) সপরিবারে সংগঠিত আকারে সুন্দরবনে তিন দিনের বিহার করে আসেন। কিন্তু, ভাবমূর্তির প্রসার ঘটানোর এত সব উদ্যোগের মাস খানেকের মাথায় আবারও র্যাব ভেঙে দেওয়ার দাবি ওঠে। এবারও দাবিটি আসে বৈশ্বিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তরফ থেকে এবং কারণ হিসেবে তারা বলে যে এই বাহিনীর ওপর সরকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে (ডেমোক্রেসি ইন দ্য ক্রসফায়ার, এপ্রিল ২৯, ২০১৪)৷ তাদের বক্তব্য বিচারহীনতার সংস্কৃতির অবসান ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে একটি নতুন বিশেষায়িত বাহিনী গড়া যেতে পারে, তবে তা হতে হবে বেসামরিক বাহিনী।
২৬ মার্চ যে ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়েছে তাতে উইং কমান্ডার এ টি এম হাবিবুর রহমান বর্ণিত ইতিহাস অনুযায়ী ২০০৪ সালে পুলিশের একটি বিশেষায়িত বাহিনী হিসেবে গঠিত হয় এলিট ফোর্স—র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন এবং তাদের ওপর যেসব দায়িত্ব অর্পণ করা হয় সেগুলো ছিল সন্ত্রাসবাদ ও জিঙ্গবাদ নিয়ন্ত্রণ, অবৈধ অস্ত্র, বিস্ফোরক ও মাদকদ্রব্য উদ্ধার। এই বাহিনীতে সামরিক বাহিনীর সব শাখা থেকে কর্মকর্তাদের নিয়ে আসার লক্ষ্য ছিল একটি চৌকস পেশাদার বাহিনী গড়ে তোলা।
গত ১০ বছরের বিবর্তনে দেখা যায়, র্যাব পুলিশের বিশেষায়িত বাহিনী হিসেবে যতটা কাজ করেছে, দৈনন্দিন পুলিিশ কাজে তাদের ব্যবহার তার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। দৈনন্দিন পুলিিশ কাজের মধ্যে রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশ নিয়ন্ত্রণের কাজও করেছে৷ ফলে ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিকদের সঙ্গে তাদের সরাসরি যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার সুযোগ তৈরি হয়েছে, তাতে তাদের আভিজাত্যের বাধা দূর করে দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির ক্রীড়নক হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। পুলিশের এসপি কিংবা থানার দারোগাদের ওপর শাসক দলের নেতা-পাতি নেতাদের যে দাপটের খবর আমরা পত্রপত্রিকায় নিয়মিত দেখতে পাই, সেই একই প্রভাব ওই অভিজাত বাহিনীটির ওপরও পড়েছে। এরই এক করুণ নিদর্শন নারায়ণগঞ্জ, যেখানে সাংসদ থেকে সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরও এই বাহিনীকে তঁাদের ব্যক্তি, পরিবার বা গোষ্ঠীর স্বার্থে ব্যবহার করতে সমর্থ হয়েছেন বলে জোরালো ও বিশ্বাসযোগ্য আলামত মিলছে। এমনকি, নারায়ণগঞ্জের হত্যাকাণ্ডে অভিযোগের আঙুল যঁাদের দিকে, তঁাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে লক্ষ্মীপুর, লাকসাম ও নরসিংদীতেও গুম ও হামলার অভিযোগের কথা র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসানও অস্বীকার করেননি (প্রথম আলো, ১১ মে, ২০১৪)।
কথিত আভিজাত্যের অধিকারী এই বাহিনীটির প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব অথবা দোষ যাদের, সেই বিএনপি এখন বলছে, র‌্যাব বিলোপ করা উচিত। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, র‌্যাবের আর প্রয়োজন নেই৷ র‌্যাবকে রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে, এই বাহিনী গুম–খুনে জড়িয়ে পড়েছে৷ তাহলে কি র্যাব প্রতিষ্ঠা ভুল ছিল? ভুল করে থাকলে তার দায়িত্ব স্বীকার করে সে জন্য তো তঁার ÿক্ষমা চাওয়া উচিত। যে প্রয়োজনীয়তার উপলব্ধি থেকে তঁারা এটা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেটা পূরণের বিকল্পটা কী? সেটা নিশ্চয়ই তঁাদের আমলের কথিত যৌথ বাহিনীর অভিযান নয়, যঁাদের বিচারবহির্ভূত হত্যাগুলোর জন্য তঁারা দায়মুক্তির আইন করে গেছেন। যেহেতু তিনি ক্ষমাও চাননি আবার কোনো বিকল্পও বলেননি, সেহেতু ধরে নেওয়া যায় যে রাজনৈতিক সুবিধাবাদিতাই হচ্ছে তঁার এই দাবির কারণ। অন্যদিকে, যঁারা র্যাব বিলোপের দাবি জানিয়েছেন, তঁাদের জিঙ্গবাদের দোসর হিসেবে চিহ্নিত করার সরকারি দলের বক্তব্য র‌্যাবের প্রাতিষ্ঠানিক ও সাংগঠনিক সংকটকে অস্বীকারেরই নামান্তর। বিএনপিকে জিঙ্গবাদের দোসর বলার রাজনীতিতে তালি কুড়ানো গেলেও মানবাধিকার সংগঠকদের গায়ে সেই তকমা লাগানোর চেষ্টা কিছুটা হাস্যকর শোনায়।
র‌্যাবের কার্যক্রম যে শুধু মানবাধিকারবাদীদের মাথাব্যথার কারণ, তা কিন্তু নয়। এ বিষয়ে উন্নয়ন–সহযোগী এবং দাতাদেশগুলোর অস্বস্তির বিষয়টি এখন আর মোটেও গোপনীয় কিছু নয়, যার অর্থ হচ্ছে তা উপেক্ষণীয় নয়। ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন বিতর্কিত নির্বাচন বিষয়ে ১৬ জানুয়ারি ব্রিটিশ পার্লামেন্টের বিতর্কেও আমরা র‌্যাব বিলুপ্তির আহ্বানের কথা শুনেছি। সেদিন হাউস অব কমনসের বিতর্কে ব্রিটিশ এমপিদের সমালোচনার একটা বড় অংশ জুড়ে ছিল বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং র্যাবের ভূমিকা। র্যাবকে একটি ‘ঘাতক বাহিনী’ হিসেবে অভিহিত করে সেদিন এমপিদের অনেকে বিভিন্ন গুম ও খুনের ঘটনার জন্য র্যাবকে দায়ী করে তাদের জবাবদিহির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে না পারার জন্য বাংলাদেশ সরকারের সমালোচনা করেন। তঁাদের কেউ কেউ র্যাব ভেঙে দেওয়ার দাবি জানাতে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানান (প্রথম আলো, ১৭ জানুয়ারি, ২০১৪)। তারও কয়েক বছর আগে, ‘সরকারের ঘাতক বাহিনী’ হিসেবে সমালোচিত র্যাবকে প্রশিক্ষণ এবং সহায়তা দেওয়ার বিষয়ে ব্রিটিশ প্রচারমাধ্যমে শোরগোল উঠলে ব্রিটিশ সরকার জানিয়েছিল যে তারা এই বাহিনীর জন্য কোনো ধরনের অস্ত্র বা সরঞ্জাম সরবরাহ করছে না। শুধু ‘তদন্তের জন্য জিজ্ঞাসাবাদের কৌশল’ এবং ‘গুলিবর্ষণের যৌক্তিকতা’ (রুলস অব এনগেজমেন্ট) বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা স্বীকার করে তারা জানায়, ২০০৭ সাল থেকে যে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালানো হয়েছে, তা ব্রিটিশ আইন মেনেই করা হয়েছে। (গার্ডিয়ান, ২১ ডিসেম্বর, ২০১০)
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও সন্ত্রাসবাদ মোকািবলার প্রশ্নে সহযোগিতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে র্যাবের বিতর্কিত ভূমিকা যে প্রায় শুরু থেকেই একটা বাধা তৈরি করে রেখেছে, সে কথা আমরা জানতে পারি উইকিলিকসে ফঁাস হওয়া গোপন তারবার্তায়। ২০০৮-এর ১১ অাগস্ট তৎকালীন রাষ্ট্রদূত জেমস মরিয়ার্টির পাঠানো ‘এনগেজিং বাংলাদেশ’স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন’ শিরোনামের বার্তাটিতে র্যাব সম্পর্কে বেশ কিছু চমকপ্রদ তথ্য পাওয়া যায়। বাংলাদেশ সফররত যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে র্যাব কর্মকর্তাদের দুই দিনের বৈঠকের একটা মূল্যায়ন ওই বার্তায় তুলে ধরা হয়। ওই বার্তাতেই আমরা জানতে পারি যে সন্ত্রাসবাদ মোকািবলা এবং আইন প্রয়োগের সক্ষমতা গড়ে তোলার বিষয়ে র্যাবকে সহায়তা দিতে আগ্রহী হলেও যুক্তরাষ্ট্র তাদের নিজস্ব আইিন বাধার কারণে তা করতে পারছে না। লিহি আইন নামে পরিচিত ওই বিধি অনুসারে কোনো বাহিনী, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ থাকলে যুক্তরাষ্ট্র সরকার তাদের কোনো ধরনের প্রত্যক্ষ সহায়তা দিতে পারে না। সন্ত্রাসবাদের বৈশ্বিক হুমকির পটভূমিতে র্যাবের সহায়তা পেতে যুক্তরাষ্ট্র তখন উন্মুখ হওয়াতেই সে সময়ে ওই সরকাির প্রতিনিধিদলটি বাংলাদেশে এসেছিল। কার কার বিরুদ্ধে কী ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আছে, সেসব তথ্য জানাতে অস্বীকৃতির ফলে র্যাব কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণে সহায়তা দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের জন্য প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। সর্বসাম্প্রতিক খবরে বলা হচ্ছে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের কারণে যুক্তরাষ্ট্র র্যাবের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম স্থগিত রাখার সিদ্ধােন্তর কথা বাংলাদেশকে জানিয়ে দিয়েছে (নিউ এজ, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৪)। খবরটিতে বলা হয়, মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী র্যাব প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০১৩ সালের অাগস্ট পর্যন্ত সময়ে তাদের হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন ৭৬০ জন এবং আটক অবস্থায় নির্যাতনে মারা গেছেন আরও ৩১ জন।
এগুলোর কোনো সরকাির পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। কেননা, সরকারের পক্ষ থেকে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনে বিচারবিহর্ভূত হত্যার অভিযোগগুলো কার্যত অস্বীকার করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে, বাংলাদেশে গুম বলে কিছু নেই। তবে, জাতিসংঘ কমিশনে সরকারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ২০১০ থেকে ২০১২—এই তিন বছরে র্যাবের এক হাজার ৬০০ সদস্যের বিরুদ্ধে সরকার শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। (সূত্র: বাংলাদেশ ইউপিআর ২০১৩)। পুরো এক দশকে এই সংখ্যাটি এর তিন গুণ ধরে নিলে বলতে হবে এই বাহিনীতে অপরাধপ্রবণতার হার অনেক উঁচু। এঁদের বিরুদ্ধে যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা সংশ্লিষ্ট বাহিনীর নিজস্ব ব্যবস্থা। এগুলো আদালতে গেলে তঁাদের অপরাধের প্রকৃত চিত্র হয়তো কিছুটা বোঝা যেত এবং এ বিষয়ে বিতর্ক আরও বস্তুনিষ্ঠ হতে পারত। কিন্তু, বিষয়টি সরকার এবং এই বাহিনী উভয়ের জন্য বিব্রতকর বলেই সম্ভবত তা কোনো দিন প্রকাশ হবে না। তবে, নিরাপত্তা বিশ্লেষক এবং অপরাধ বিশেষজ্ঞদের জন্য এসব তথ্য অত্যন্ত জরুরি।
নারায়ণগঞ্জে রোমহর্ষক ও নৃশংস সাত খুনের ঘটনায় ভাড়াটে ঘাতকের ভূমিকা পালনের অভিযোগ র্যাবকে নিয়ে চলা গত কয়েক বছরের বিতর্ককে যে নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে, সন্দেহ নেই। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে যে বাহিনী দেশে-বিদেশে বাড়তি মনোযোগ আকর্ষণ করে আছে, সেই বাহিনীর পুরোটাই যে দুর্বৃত্তায়নের ধারায় অধঃপতিত হয়েছে, এমন ঢালাও মন্তব্য যেমন অগ্রহণযোগ্য, তেমনই অযৌক্তিক এর সংস্কারের দাবিকে উপেক্ষা। র্যাবকে একটি পরিপূর্ণ অসামরিক নিরাপত্তা বাহিনী হিসেবে পুনর্গঠন, তাকে দলীয় রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত রাখা এবং তার জবাবদিহির স্বচ্ছ একটি ব্যবস্থা নিশ্চিত করা নিশ্চয়ই অসাধ্য নয়। একটি অনাকাঙ্ক্ষিত বিদ্রোহের পরিণতিতে বাংলাদেশ রাইফেলসকে (বিডিআর) পুনর্গঠন করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-তে রূপান্তর সম্ভব হলে এ ক্ষেত্রে বড় ধরনের একটি সংস্কার অসম্ভব নয়। পুলিশের সংস্কারের সুপারিশগুলো যেভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে, সেই একই ধারা র্যাবের ক্ষেত্রে অনুসৃত হলে একদিন হয়তো এর বিলুপ্তির কোনো বিকল্প থাকবে না।
কামাল আহমেদ: প্রথম আলো বিশেষ প্রতিনিধি, লন্ডন৷

No comments

Powered by Blogger.