গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রায় নির্বাচনের ভূমিকা by আলী ইদরিস

৫ই এপ্রিল ২০১৪ খ্রি. তারিখে বঙ্গবন্ধু একাডেমি আয়োজিত এক আলোচনা সভায় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য জনাব সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তার ভাষণে একটি মূল্যবান উপলব্ধি ব্যক্ত করে বলেছেন ‘‘নির্বাচন কমিশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। গণতন্ত্রের অস্তিত্ব এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। নির্বাচন কমিশনারের পদ একটি  মর্যাদাপূর্ণ ও সাংবিধানিক পদ।
মানুষ তার কাছ থেকে সংযত ও ভাল আচরণ প্রত্যাশা করে। এত তীর্যক ও তীব্রভাবে সমালোচনা ঠিক নয়।”  উল্লেখ্য যে, ৩০শে মার্চ দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার বেগম খালেদা জিয়ার উদ্দেশ্যে বলেছিলেন যে, বিএনপি উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিয়ে নাকে খত দিয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দীন আহমেদের দীর্ঘ ছুটি কাটানোর ব্যাপারেও জনাব সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন ‘‘তার দীর্ঘ ছুটিতে যাওয়াকে ডিফেন্ড করা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। তার উপস্থিতিটা খুবই প্রয়োজন ছিল। মানুষ মনে করে উপজেলা নির্বাচনের সময় তার এ দীর্ঘ ছুটিতে থাকা ঠিক হয় নি।” দিবালোকের মতো সত্য কথাগুলো সাহসের সঙ্গে স্বীকার করার জন্য জনাব সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে আন্তরিক সাধুবাদ জানাই। কারণ ক্ষমতাসীন দলের দু’চার জন নেতা যাঁরা মাঝে মাঝে সত্যি কথা বলে ফেলতেন তারাও আজকাল মুখে কলুপ এঁটেছেন। নির্বাচন কমিশন, দুদক, প্রধান বিচারপতি ইত্যাদি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো জনমানুষের শেষ আশা-ভরসা ও  আশ্রয়স্থল। এগুলো দলীয়করণ হয়ে গেলে নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের  আর কোথাও যাওয়ার জায়গা থাকে না। একটি দেশের গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি নির্বাচন, আর  সুষ্ঠুভাবে ও স্বচ্ছতার সঙ্গে  নির্বাচন অনুষ্ঠান করা কমিশনের প্রধান দায়িত্ব। এ উদ্দেশ্যেই সংবিধানের আলোকে নির্বাচন কমিশনকে সর্বোচ্চ ক্ষমতা দেয়া হয়। নির্বাচন পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপারে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার যথাযথ প্রয়োগই নির্বাচন কমিশনের প্রধান  নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। নির্বাচন কমিশন সংসদ সদস্য হিসেবে অতি লোভনীয় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অথবা স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধির পদ দখল করতে প্রার্থীগণ  নিজেদের  আর্থিক, দলীয়, পেশিশক্তি ইত্যাদি সব রকম অস্ত্র প্রয়োগ এবং আচরণবিধি লঙ্ঘন করতে পারেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশন নীতি ও আদর্শে অটল থেকে নিজের সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগ করলে  কেন্দ্র  দখল, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, জাল ভোট দেয়া এসব ঘটনা ঘটতে পারে না। নির্বাচন কমিশন নির্ভয়ে, নিরপেক্ষভাবে তার ক্ষমতা প্রয়োগ করলেই নির্বাচন সুষ্ঠু, উৎসবমুখর, স্বচ্ছ ও সন্ত্রাসবিহীন হতে পারে।পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ ভারতের লোকসভা নির্বাচন শুরু হয়েছে ৭ই এপ্রিল থেকে। ১২৭ কোটি লোক সংখ্যার দেশে ৮১.৪০ কোটি ভোটার ৯ দফায় ভোট দিয়ে তাদের  পছন্দের প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন। ৯ দিনে ভোট হলেও ভোট গণনা ও ফলাফল ঘোষণা হবে ১৬ই মে থেকে। ৩৭ দিন  যাবৎ চলবে নয় লাখ নির্বাচন কেন্দ্রে এই মহোৎসব ও বিরাট কর্মযজ্ঞ। ৫০০টি রাজনৈতিক দলের প্রায় ১৫ হাজার প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন এই লোকসভা নির্বাচনে। এত বিশাল আকারের নির্বাচন কর্মযজ্ঞ সুষ্ঠু ও স্বচ্ছভাবে সম্পন্ন করা নির্বাচন কমিশনের জন্য একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ হলেও অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় ভারতের নির্বাচন কমিশন সেটা পারবে। ইতিমধ্যে বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠ সহযোগী অমিত শাহ এক জনসভায় কংগ্রেস দলের বিরুদ্ধে ‘‘বদলা” নিতে তার পার্টিকে ভোট দেয়ার আহ্বান জানালে নির্বাচন কমিশনের  আদেশে জেলা প্রশাসন তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে। অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় হম্বিতম্বি করলেও একদিন না যেতেই কমিশনের কাছে হার মানেন। এতেই বোঝা যায় ভারতের নির্বাচন কমিশন তাদের ক্ষমতা প্রয়োগে কত তৎপর। এ দিকে আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্য এবং ৪টি রাজ্যের ৯১টি আসনে ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে শান্তিপূর্ণভাবে। বাংলাদেশের উপজেলা নির্বাচনে কেন্দ্র  দখল, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, ভোটের আগের দিন জাল ভোট দিয়ে বাক্স ভরে রাখা, খোদ প্রশাসনের লোকদের নানা অপকর্ম সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশনের  নির্বিকার থাকা এবং নির্বাচন আগের চেয়ে স্বচ্ছ হয়েছে বলে দাবি করা হাস্যকর ও দুর্ভাগ্যজনক। এরশাদ সরকারের পতনের পর এ দেশে পাঁচ বার জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, এ সমস্ত নির্বাচনে যে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ, স্বচ্ছতা পাওয়া গিয়েছিল উপজেলা নির্বাচনের অরাজকতা  অতীতের সব গৌরব বিনষ্ট করে দিয়েছে।
গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রার পথে নির্বাচনের পবিত্র ভূমিকা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। প্রতিবেশী বৃহৎ শক্তি ও পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ ভারত থেকে গণতন্ত্র ও নির্বাচন পদ্ধতি সম্পর্কে আমাদের অনেক কিছু শিক্ষনীয় আছে। ভারতের নির্বাচন পদ্ধতি অনুসরণ করলে উপজেলা নির্বাচনে এতো অনিয়ম হতো না। একটি গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন এ দুটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে যথাযথ ক্ষমতা, স্বাধীনতা ও সুবিধা প্রদান করলে সে দেশের গণতান্ত্রিক, সুশাসনিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি কেউ রুখতে পারে না।

No comments

Powered by Blogger.