ইউক্রেন নিয়ে ইসরায়েলের দোলাচল by ইতামার রাবিনোভিচ

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকার ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রশাসনের মধ্যে সম্পর্ক এমনিতেই বেশ নাজুক। এ অবস্থায় ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সঙ্গে যোগ দিয়ে রাশিয়ার ক্রিমিয়াকে সংযুক্ত করার বিষয়কে নিন্দা করতে রাজি হয়নি। তবে ঝুঁকিপূর্ণ হলেও ইসরায়েলের এ সিদ্ধান্ত অবাক করার মতো নয়। যত যা-ই হোক, মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার উপস্থিতির বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কার্যকর নীতি নেই। এর ফলে ইসরায়েলের মতো দেশগুলোর পক্ষে ক্রেমলিনের মোকাবিলা করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

ইউক্রেনে রাশিয়ার কার্যকলাপের নিন্দা করতে বা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ইউক্রেনের আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রতি সমর্থন জানাতে ইসরায়েল অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। একজন জ্যেষ্ঠ মার্কিন কর্মকর্তা ইসরায়েলের প্রভাবশালী সংবাদপত্র হারেৎজ-এর কাছে এ নিয়ে অনুযোগ করলে সাম্প্রতিকতম বিতর্কটির সূত্রপাত হয়। কর্মকর্তাটির ভাষ্য ছিল, যে দেশ মার্কিন সাহায্য ও কূটনৈতিক সমর্থনের ওপর এত বেশি নির্ভরশীল, তার জন্য এ রকম একটি জটিল সময়ে তার সবচেয়ে বড় মিত্রের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া একেবারেই অযৌক্তিক।
ইসরায়েল সরকার এর প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রকে শান্ত করতে সচেষ্ট হয়। ইসরায়েলি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আভিগদর লিবারম্যান মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা সুজান রাইস ও অন্যদের সঙ্গে এক বৈঠকে ব্যাখ্যা দেন যে রাশিয়া সিরিয়াকে অত্যাধুনিক অস্ত্র (প্রধানত এস-৩০০ বিমানবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র) দেবে—এই ভয়ে ইসরায়েল দেশটিকে চটাতে পারে না। সিরিয়া ওই অস্ত্র পেলে ইসরায়েলের কৌশলগত প্রেক্ষাপটের স্থিতাবস্থা বজায় থাকবে না। উল্লেখ করা দরকার, নেতানিয়াহু গত বছর ঠিক এ চুক্তিটিই সম্পন্ন না করার জন্য রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে রাজি করানোর চেষ্টা করেছিলেন। আর পুতিন ইতিমধ্যেই সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ইউক্রেনে হস্তক্ষেপ করা হলে মধ্যপ্রাচ্যে তার প্রভাব পড়বে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ভোটকে নিশ্চয়ই হস্তক্ষেপ আখ্যায়িত করা যায় না। কিন্তু ইসরায়েল কোনো ঝুঁকি নিতে রাজি নয়।
পুতিন ইসরায়েলকে ভয় দেখালেন এবারই প্রথম নয়। ক্রেমলিনের শত্রু প্রেসিডেন্ট মিখাইল সাকাশভিলির সময় জর্জিয়ার সঙ্গে প্রতিরক্ষা সম্পর্ক নিয়ে পাল্টা ব্যবস্থার হুমকি দিয়েছিলেন তিনি। ইসরায়েল হার মেনে অস্ত্রশস্ত্র ও তার সঙ্গে যুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা সমঝোতা থেকে বাদ দেয়। তবে বিষয়টা যখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইসরায়েলের অবনতিশীল সম্পর্ক, তখন পুতিন কোনো সমস্যা নন, সমস্যা হচ্ছেন ওবামা আর নেতানিয়াহু। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সম্পর্ক নিঃসন্দেহে অনেক ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে গেলেও দুই দেশের নেতাদের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে একটা সাধারণ আস্থার বোধ—এমনকি উষ্ণতা—ছিল। আজ তা মারাত্মকভাবে অনুপস্থিত।
দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের এই শীতলতা শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তা পর্যায়ে ছড়িয়েছে, বিশেষ করে ইসরায়েলে। দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোশ ইয়ালন সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিকে অপমান করেছেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথিত ‘দুর্বলতাকে’ উপহাস করেছেন তিনি। পরিস্থিতি আরও জটিল করছেন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আসা লিবারম্যান। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ব্যবস্থাপনায় ছোট হলেও একটা ভূমিকা রাখতেন তিনি। কিছুদিন ধরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সমন্বয়ের পক্ষে কথা বলে এলেও ইউক্রেন সংকট নিয়ে তাঁর সাম্প্রতিক বিবৃতি মার্কিন কর্মকর্তাদের ক্ষুব্ধ করেছে। ওই সব বিবৃতিতে লিবারম্যান যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক বিষয়ে কথা বলেছেন একই ভাষায়, যেন ইসরায়েলের কাছে তারা উভয়েই সমান। বাগাড়ম্বর বাদ দিলে দেখা যাবে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অন্য মিত্রদের মতোই ইসরায়েলও ওই অঞ্চল থেকে পর্যায়ক্রমিক মার্কিন সেনা প্রত্যাহারে উদ্বিগ্ন। মার্কিন নীতির এ পরিবর্তনে রাশিয়া সেখানে হারানো প্রভাব ফিরে পেয়েছে। আর প্রভাব রাশিয়ার ভালো রকমই আছে। উল্লেখযোগ্য মাত্রার কূটনৈতিক সক্ষমতা কাজে লাগিয়ে ইরানের সঙ্গে পাশ্চাত্যের আলোচনাকে প্রভাবিত করতে সক্ষম রাশিয়া। অন্যদিকে সিরিয়া থেকে মিসর পর্যন্ত অস্থির দেশগুলোতে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য অস্ত্র সরবরাহ কৌশলকে ব্যবহার করতে পারে তারা।
এই প্রেক্ষাপটে ইসরায়েলি কর্মকর্তারা ক্রমেই বেশি করে এ যুক্তি দিচ্ছেন যে ইউক্রেন বা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কে নাক গলানো ইসরায়েলের উচিত না। বরং তার উচিত নিজের স্বার্থ রক্ষা করা। তা ছাড়া, তারা অভিযোগ করেছেন, ইসরায়েলের প্রতি বৈরী ওবামা প্রশাসনের কর্মকর্তারা নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য বিষয়টিকে ইচ্ছা করে অতিরিক্ত ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখাচ্ছেন। তাঁরা আরও উল্লেখ করেছেন, জাতিসংঘে ইসরায়েলের ভোটে কিছু আসত-যেত না। উভয় পক্ষের যুক্তির সারবত্তা যা-ই হোক, শেষ কথাটা হচ্ছে ইউক্রেন সংকট নিয়ে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে বিপন্ন করে তুলছে, যাতে কোনো দেশেরই লাভ হচ্ছে না। দুই দেশের সরকারেরই উচিত নিজেদের অবস্থান পর্যালোচনা করে সমঝোতার উপায় বের করা। ইসরায়েলকে অবশ্যই তার নিজস্ব পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করতে হবে। সে যদি অন্ধভাবে মার্কিন নীতির সবকিছু সমর্থন করে যায়, তাহলে ওই নিজস্ব নীতির বিকাশ বা বাস্তবায়ন কোনোটাই সম্ভব হবে না। একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রেরও এমন ইসরায়েলের দরকার নেই, যার কিনা নিজস্ব সম্পদ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নেই এবং যে পুরোপুরিই যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার ওপর নির্ভরশীল।
কিন্তু ইসরায়েল তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে তড়িঘড়ি কিছু করলে চলবে না। জাতিসংঘে ইসরায়েলের ভোটে কিছু আসত-যেত না—ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের এ বক্তব্য তত্ত্বগতভাবে সঠিক হলেও তার ভোটের প্রতীকী তাৎপর্য উপেক্ষণীয় নয়। ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক অবস্থান অনেকাংশেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের নিরিখে স্থির হয় বলে এ রকম স্পর্শকাতর সময়ে মার্কিন সরকারকে সমর্থন দেওয়ায় ইসরায়েলের ব্যর্থতা তাৎপর্যপূর্ণ হবে। সেটা সবার নজরেও পড়বে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রকেও অবশ্যই মধ্যপ্রাচ্যে তার ক্রমহ্রাসমান স্বার্থ ও প্রভাব আর ইসরায়েলের বর্তমান উভয়সংকটের মধ্যকার সম্পর্ককে স্বীকার করতে হবে।
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশারের কাছে রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা বিক্রি করা বা মধ্যপ্রাচ্যে দেশটির প্রভাব ফিরে পাওয়ার চেষ্টা প্রতিহত করা ইসরায়েলের কাজ নয়। ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে দাঁড়ানোও ইসরায়েলের কাজ নয়। রাশিয়া যদি পূর্ব ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে একটি যোগসূত্র প্রতিষ্ঠা করে থাকে, সে ক্ষেত্রে ওই অঞ্চলে মার্কিন মিত্ররা আশা করবে যুক্তরাষ্ট্র নতুন পরিস্থিতি নিজেদের পক্ষে কাজে লাগানোর চেষ্টা করবে; ইতিমধ্যে স্পর্শকাতর আঞ্চলিক নিরাপত্তার ভারসাম্য নতুন পরিস্থিতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এমনটি চাইবে না

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
ইতামার রাবিনোভিচ: যুক্তরাষ্ট্রে সাবেক ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত। ইসরায়েল ইনস্টিটিউটের সভাপতি; তেল আবিব ইউনিভার্সিটি, নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি ও ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের জ্যেষ্ঠ গবেষক।

No comments

Powered by Blogger.