জাতির এই অপচয় মেনে নেওয়া যায় না- শিক্ষার নামে বেকার তৈরি

শিক্ষার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য মানবসম্পদের উন্নয়ন ও বিকাশ। কিন্তু বাংলাদেশে যে শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে, তা কোনোভাবেই সময়ের চাহিদা মেটাতে পারছে না, মননের তো নয়ই। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা অগ্রগতির নির্দেশক না হয়ে সমাজের জন্য অনেকটা বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গতকাল রোববার প্রথম আলোয় শিক্ষা নিয়ে প্রকাশিত একাধিক প্রতিবেদনে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। শিক্ষা নিয়ে আমরা যতই বাগাড়ম্বর করি না কেন, খুব বেশি এগোতে পারিনি। ব্রিটিশ আমলের কেরানি তৈরি করার শিক্ষারও যে উপযোগিতা ছিল, স্বাধীন বাংলাদেশে আমাদের সেটুকু উপযোগিতা না থাকা কেবল দুর্ভাগ্যজনক নয়, লজ্জাজনকও।
বর্তমানে যে শিক্ষানীতি চালু আছে, তার অনেক ইতিবাচক দিক থাকা সত্ত্বেও দেশের মোট জনশক্তিকে জনসম্পদে রূপান্তর করার লক্ষ্য নিরূপিত হয়েছে বলা যাবে না। বরং পূর্বসূরিদের মতো এই সরকারও বাছবিচারহীনভাবে নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন ও এমপিওভুক্ত করে চলেছে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন নতুন বিভাগ চালু করেছে, কিন্তু সেসবের উপযোগিতা আছে কি না, তা মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। লন্ডনভিত্তিক ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিটের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশেই স্নাতক ডিগ্রিধারী শিক্ষিত বেকারের হার সবচেয়ে বেশি, ৪৭ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতি ১০০ জন স্নাতক ডিগ্রিধারীর মধ্যে ৪৭ জনই বেকার। একজন লেখাপড়া না জানা মানুষ বেকার থাকা আর শিক্ষিত মানুষের বেকার থাকা এক কাতারে ফেলা যাবে না। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র তথা জনগণ যে বিনিয়োগ করে থাকে, তার বিনিময়ে যদি আমরা কিছু না পাই, সেটি হবে মস্ত বড় অপচয়।
পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিবছর ২২ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করেন। কিন্তু কাজ পান মাত্র সাত লাখ। বাকি ১৫ লাখ মানুষ নিয়ে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের কোনো চিন্তাভাবনা আছে বলে মনে হয় না। ক্ষমতাসীনেরা ২০১৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে গড়ে তোলার যে আওয়াজ তুলছেন, স্নাতক ডিগ্রিধারী ৪৭ শতাংশ বেকারকে রেখে তা কখনোই সম্ভব নয়।
তাই দেশে প্রতিবছর কী পরিমাণ জনশক্তির আগমন ঘটে, তাদের কোথায় কাজে লাগানো যায়, তার ভিত্তিতেই শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত হওয়া উচিত। দেশের প্রত্যেক নাগরিক শিক্ষিত হোক, এটা জরুরি। কিন্তু তার চেয়েও বেশি জরুরি, সেই শিক্ষিত জনশক্তিকে উপযুক্ত কাজে লাগানো। প্রতিবছর যে লাখ লাখ জনশক্তির আগমন ঘটছে, তাদের কর্মসংস্থান করতে না পারলে সামাজিক অস্থিরতাই কেবল বাড়বে না, সমাজে অপরাধ প্রবণতাও ভয়াবহ রূপ নেবে। পরিস্থিতি আরও নাজুক হওয়ার আগেই এ ব্যাপারে কার্যকর ও টেকসই পদক্ষেপ নিতে হবে।
ভঙ্গুর ও দুর্বল শিক্ষাব্যবস্থা দিয়ে কোনো জাতি যে এগিয়ে যেতে পারে না, ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিটের প্রতিবেদনই তা আরেকবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।
প্রথম আলোর সম্পাদকীয় থেকে...

No comments

Powered by Blogger.