আইসিটি আইনটি ঢেলে সাজানো দরকার

তানজীব উল আলম
ব্যারিস্টার তানজীব উল আলম সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আইনজীবী। তাঁর জন্ম চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে, ১৯৭৪ সালে। চট্টগ্রাম জামিয়া আহমাদিয়া সুন্নিয়া মাদ্রাসা থেকে দাখিল ও আলিম পাস করার পর তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯৬ সালে আইনশাস্ত্রে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৯৭ সালে লিংকনস ইন থেকে বার-অ্যাট-ল ডিগ্রি লাভের পর তিনি ঢাকায় আইন পেশা শুরু করেন; ১৯৯৯ সালে তিনি হাইকোর্টের সনদ লাভ করেন এবং ২০০৫ সালে আপিল বিভাগে আইনজীবী হিসেবে নিবন্ধিত হন। তিনি বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ আইন, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন ও বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি আইনের খসড়া প্রণয়নে ভূমিকা রাখেন। সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশন আইনের খসড়া প্রণয়ন করেন। তিনি তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি, টেলিযোগাযোগ ও জ্বালানিবিষয়ক আইনের একজন বিশেষজ্ঞ।
প্রথম আলো  বাংলাদেশে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনকে (আইসিটি আইন) একটা কালাকানুন বলা হচ্ছে। আইনটা আসলে কী?
তানজীব উল আলম  আইসিটি আইনের ৫৭ থেকে ৫৯ পর্যন্ত যে ধারাগুলো রয়েছে, মূলত সেগুলোর জন্যই এ আইনের সমালোচনা হচ্ছে। কিন্তু এই ধারাগুলো পুরো আইনটির একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। আইসিটি আইনের মূল উদ্দেশ্য খুবই ভালো এবং আমি মনে করি যোগাযোগপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে যে একটা আইনগত শূন্যতা ছিল, এই আইন প্রণয়নের ফলে সেই শূন্যতা পূরণ হয়েছে। এ আইনের মাধ্যমে ডিজিটাল স্বাক্ষরের একটা স্বীকৃতি এসেছে, ইন্টারনেটভিত্তিক আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর সবচেয়ে বড় সুফল আমরা দেখতে পাই ব্যাংকিং খাতে। এখন কোনো বাণিজ্যিক ব্যাংকই তাদের টাকার হিসাব লেজার বুকের মাধ্যমে করে না, ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে সফটওয়্যারের মাধ্যমে করে। এই যে সফটওয়্যারের মাধ্যমে যে হিসাবটা রাখা হচ্ছে, এটার আইনগত স্বীকৃতি কিন্তু আইসিটি আইনের মাধ্যমে এসেছে। সুতরাং আইনটাকে সেই অর্থে খারাপ বলা যাবে না, বরং বাংলাদেশে এই ইলেকট্রনিক যুগে ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারের যুগে একটা বড় অবদান রেখেছে।
প্রথম আলো  তাহলে এ আইন নিয়ে আপত্তির কারণ কী? কেন এটির সমালোচনা করা হচ্ছে?
তানজীব উল আলম  আইনটি যখন প্রণয়ন করা হয়, তখন এর একটা অংশের উদ্দেশ্য ছিল একরকম, পরবর্তী সময়ে প্রযুক্তিগত অগ্রগতির ফলে অনেক বিষয় চলে এসেছে, যেগুলোতে আইনটির এই বিশেষ কয়েকটি বিধানের অপব্যবহারের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
প্রথম আলো  সেগুলো কী?
তানজীব উল আলম  যেটা নিয়ে বেশ আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে সেটা হলো, ইলেকট্রনিক বিন্যাসে মিথ্যা, উসকানিমূলক, মানহানিকর তথ্য, সংবাদ, ছবি ইত্যাদি প্রচারের দায়ে যে শাস্তির বিধান করা হয়েছে, সেটা। ২০০৬ সালে মূল যে আইনটা করা হয়েছে, সেটির কয়েকটি বিধানের ধারাবাহিকতায় এই বিধানগুলো এসেছে। যেমন, কেউ যদি ইলেকট্রনিক মাধ্যমে, বিশেষত কোনো ওয়েবসাইট হ্যাকিং করে, কিংবা কারও ওয়েবসাইটে ঢুকে কারও বদনাম করে, মানহানিকর কিছু প্রকাশ করে, তাহলে যে অপরাধ ঘটে, তা বন্ধ করার জন্য ওই আইনটা করা হয়েছিল। ২০০৬ সালে যখন মূল আইনটি করা হয়, তখন কিন্তু ফেসবুক বা এ ধরনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বলে কিছু ছিল না। প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে এই বিধানের অনেকটা সেকেলে হয়ে গেছে বেশ দ্রুতই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপরাধের বিচারের জন্য আলাদা বিধান করে আলাদা আইন করা যেত। কিন্তু সেটা না করে এই আইনটাকে ঢালাওভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে মানুষের মতপ্রকাশের অধিকারটাকে দমন করার জন্য। যদিও আইনটার আদি উদ্দেশ্য অনেক ভালো ছিল এবং বর্তমানেও আইনটা অনেকটুকুই আমাদের সাহায্য করছে। কিন্তু এই কয়েকটি বিধানের অপব্যবহারের ফলে লোকে মনে করছে যে পুরো আইনটাই আসলে কালাকানুন। প্রথম আলো  কিন্তু এই আইনের ৫৭ থেকে ৫৯ ধারা পর্যন্ত বিধানগুলোর কারণে তো নাগরিকদের কয়েকটি মৌলিক অধিকার খর্ব হচ্ছে। যেমন মতপ্রকাশের ও সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতা... তানজীব উল আলম  বর্তমান প্রেক্ষাপটে বলা যায়, আইনটা যে অপব্যবহারের কয়েকটা দৃষ্টান্ত আমরা দেখেছি, তাতে সাধারণ মানুষের মনে হতে পারে যে এই পরিস্থিতিগুলোতে এই আইনের এমন ব্যবহার আসলে কাম্য ছিল না। বিশেষ করে ৫৭ ধারার কথা যদি ধরা যায়, সেখানে লেখা আছে, ইলেকট্রনিক বিন্যাসে মিথ্যা, অশ্লীল ও মানহানিকর তথ্য প্রকাশসংক্রান্ত অপরাধ। পুরো বিধানটা যদি আপনি পড়েন, তাহলে দেখবেন, যে পারস্পেক্টিভ থেকে এ বিধানটা করা হয়েছে, সেখানে কিন্তু পত্রিকাগুলোর সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে এই আইনের অপব্যবহার হবে—এই বিষয়টা পরিপ্রেক্ষিত অনুযায়ী আসে না। যে পরিপ্রেক্ষিত মনে রেখে বিধানটা করা হয়েছিল, সেটা হলো কেউ যদি ইলেকট্রনিক মাধ্যম ব্যবহার করে কোনো অপরাধ বা কাউকে হেয়প্রতিপন্ন করার লক্ষ্যবস্তু করে কোনো পদক্ষেপ নেয়।
প্রথম আলো  আপনি কি সাইবার অপরাধের কথা বলছেন, যেটার সঙ্গে সংবাদমাধ্যমের পেশাদারি কাজের সম্পর্ক নেই?
তানজীব উল আলম  ঠিক। জিনিসটা আসলে ছিল সাইবার অপরাধেরই অংশ হিসেবে। কিন্তু এখন সংবাদমাধ্যমের সংবাদ বা ছবি প্রকাশকে সাইবার অপরাধের আওতায় নিয়ে আসাকে আমি মনে করি আমাদের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। কারণ, এই অনুচ্ছেদে মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
প্রথম আলো  কিন্তু বাস্তবে অনেক সাইবার অপরাধ ঘটছে। যাঁরা এসব অপরাধের শিকার হচ্ছেন, তাঁরা এখনো আইনি প্রতিকারের বিষয়টা ভালোভাবে জানেন না বলে হয়তো মামলা-মোকদ্দমা হচ্ছে না। কিন্তু ফেসবুকসহ ইন্টারনেটের বিভিন্ন ফোরামে ব্যক্তি মানুষের সম্মানহানি, গুজব ছড়িয়ে অস্থিরতা সৃষ্টি, সামাজিক-সাম্প্রদায়িক উসকানিসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক আচরণ করা হচ্ছে। রামু বৌদ্ধপল্লিতে আক্রমণের ঘটনা একটা উদাহরণ। এসব অপরাধের আইনি প্রতিকারের উপায়ও তো থাকা দরকার। তানজীব উল আলম  হ্যাঁ, এ ধরনের অপরাধ আসলেই সংঘটিত হচ্ছে। এখন বিষয় হচ্ছে, এসব অপরাধ দমনের জন্য আমরা কী ধরনের আইন করব। এমন আইন করা তো ঠিক হয় না যাতে করে এসব অপরাধ দমন করতে গিয়ে মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্বিত হয়। এই ক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রাখাটা খুবই চ্যালেঞ্জিং একটা বিষয়। যেহেতু মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা একটা মৌলিক অধিকার হিসেবে সংবিধানে স্বীকৃত, তাই আইনটা এমনভাবে প্রণয়ন করা উচিত, যাতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সর্বোচ্চ গুরুত্ব পায়, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা চর্চার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া না হয়। আবার একই সঙ্গে কেউ যদি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা চর্চা করতে গিয়ে সীমা লঙ্ঘন করে অপরাধ করে, তাহলে তার শাস্তিও অবশ্যই হওয়া উচিত।
প্রথম আলো  এ দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা হবে কীভাবে?
তানজীব উল আলম  সেটাই তো প্রশ্ন। এই ভারসাম্য এভাবে রক্ষা করা যাবে যে এমন একটা আইন করা হলো, যাতে ন্যূনতম শাস্তি সাত বছর কারাদণ্ড, যেখানে অভিযুক্তের জামিন পাওয়ার বিধান থাকবে না, কোনো ধরনের সুরক্ষা ব্যতিরেকেই যেকোনো সময় অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করা যাবে? তো ২০০৬ সালের আইনটিতে তিন-চার ধরনের সংশোধনী এনে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করা হলো, যা খুবই বিপজ্জনক। যারা অপরাধী তারা কিন্তু এ ধরনের পদক্ষেপ থেকে কোনোভাবেই নিবৃত্ত হবে না। কারণ, তারা তো অপরাধী। কিন্তু বিধানটা আপনি এমনভাবে করলেন যে সাধারণ নাগরিকদের জন্য মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে একটা ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হলো। তাহলে তো ভারসাম্যটা আসলে রক্ষা করা গেল না। ভারসাম্য হওয়া উচিত এ রকম যে যারা অপরাধী তারা তাদের অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী শাস্তি পাবে। ধরা যাক, আপনি ফেসবুকে এক ব্যক্তি সম্পর্কে একটা মিথ্যা খবর শেয়ার করলেন, আপনি জানেন না যে খবরটা মিথ্যা। এখন এই অপরাধে আপনাকে জামিন অযোগ্য হিসেবে গ্রেপ্তার করে কারাগারে রাখা ঠিক?
প্রথম আলো  শুধু তা-ই নয়, অপরাধ প্রমাণিত হলে কমপক্ষে সাত বছর কারাদণ্ড হবে, এর চেয়ে কম শাস্তি দেওয়া যাবে না। এটা কী ধরনের আইন?
তানজীব উল আলম  হ্যাঁ, এটা হচ্ছে এই আইনের সবচেয়ে অসাংবিধানিক অংশ। এখানে আইন সুনির্দিষ্ট করে বলে দিচ্ছে ন্যূনতম শাস্তি কী হবে, অপরাধের মাত্রা বিবেচনা না করেই। কারণ, আইনটিতে অপরাধের সংজ্ঞা এমন বিস্তৃতভাবে দেওয়া হয়েছে যে ফেসবুকে আপনার যেকোনো স্ট্যাটাসও আপনার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে, আপনার সাত বছরের কারাদণ্ড হয়ে যেতে পারে।
প্রথম আলো  তো এ ধরনের বিপজ্জনক কালাকানুন কী প্রক্রিয়ায় করা হলো?
তানজীব উল আলম  আমার জানামতে, ২০০৬ সালের আইনটির সংশোধনী আনা হয়েছে খুবই তড়িঘড়ি করে। সে সময় পার্লামেন্ট বসছিল না, তখন একটা অধ্যাদেশের মাধ্যমে প্রথমে এই সংশোধনীটা আনা হয়। দুই সপ্তাহ পরেই আবার সংসদে সংশোধনীটা পাস করা হয়। এ ধরনের আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞসহ জনগণের ওয়াকিবহাল অংশের যে অংশগ্রহণ থাকা প্রয়োজন, এ ক্ষেত্রে তা ঘটেনি। এটা ঠিক হয়নি। ২০০৬ সালের আইনটিই যথেষ্ট কড়া আইন ছিল, সেটাকে এ রকম বিপজ্জনক কালাকানুনের রূপ দেওয়া হয়েছে। এটা একটা সভ্য সমাজে কখনোই কাম্য হতে পারে না।
প্রথম আলো  আপনি কি মনে করেন না, এই মুহূর্তে এই আইন সংশোধন করা উচিত?
তানজীব উল আলম  আমি মনে করি আইসিটি আইনের অষ্টম অধ্যায় সম্পর্কে সমাজের বিভিন্ন অংশের মতামত নেওয়া উচিত এবং সাইবার জগতের বিভিন্ন অপরাধ আলাদা আলাদা করে সংজ্ঞায়িত করা উচিত। তারপর অপরাধের স্বরূপ ও মাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আলাদা আলাদা শাস্তি নির্ধারণ করা উচিত। অর্থাৎ পুরো আইনটি আগাগোড়া ঢেলে সাজানো প্রয়োজন এবং সেই প্রক্রিয়ায় বিশেষজ্ঞসহ সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা জরুরি।
প্রথম আলো  আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
তানজীব উল আলম  আপনাকেও ধন্যবাদ।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মশিউল আলম

No comments

Powered by Blogger.