বেহাল দলীয় রাজনীতি

দেশের দুই প্রধান দল বৈধতা ও অবৈধতার বিতর্কে লিপ্ত থাকলেও উভয় দল যথারীতি একমত যে তারা তাদের দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের প্রশ্ন অমীমাংসিত রাখবে। সে কারণে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অচলাবস্থা আরও গভীরতর হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ক্ষমতাসীন দলটির মত প্রকাশের স্বাধীনতা সরকারব্যবস্থার মধ্যে বহু ক্ষেত্রে বিলীন হয়ে গেছে। সরকার ও আওয়ামী লীগকে দিনকে দিন আলাদা করে চেনা কঠিন হয়ে পড়েছে। তবে ক্ষমতায় থাকার কারণে গণতন্ত্রের ঘাটতিজনিত ক্ষতি সহজে হয়তো চোখে পড়বে না। কিন্তু সাত বছরের বেশি সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা ইদানীং সহজেই চোখে পড়ছে। খোদ রাজধানীর কমিটি গঠনকেন্দ্রিক গণতন্ত্র অনুশীলন মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। প্রহসনমূলক যে দলের এত বড় বিপর্যয়ের পরও দলটি তার শীর্ষ পদগুলো পুনর্বিন্যাসের ঝুঁকি নিতে পারছে না। দলের শুভাকাঙ্ক্ষীরাও বড় গলায় অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের আওয়াজ তোলেন না। কারণ, তাঁরা জানেন, এ নিয়ে সরব হওয়াটা আদৌ অর্থ বহন নাও করতে পারে। কিন্তু দেশের দুই প্রধান দলের অব্যাহত গণতন্ত্রবিমুখতা এবং একই সঙ্গে নানা ধরনের বুজরুকিচর্চা দেশকে বিশ্বের দরবারে হেয় করে চলেছে। ক্ষমতাসীন দল কথায় কথায় সংবিধানের ৭ ও ১১ অনুচ্ছেদের বরাত দিয়ে থাকে। আর এতে কেবল নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা প্রশাসনের সব স্তর পরিচালনার কথা বলা আছে। দলে গণতন্ত্রচর্চা বন্ধ রাখা এই অনুচ্ছেদগুলোর চেতনাবিরুদ্ধ।
তারা দলের কর্মী ‘জনগণ’ ও ভোটার ‘জনগণকে’ পরস্পরের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছে। দুই বড় দল আগে পাঁচ বছর অন্তর সুষ্ঠু নির্বাচনে একমত ছিল। ২০০৬ সাল থেকে শুরু করে ২০১৪ সালে এসে সে ব্যাপারে পরস্পরবিরোধী অবস্থানে। এরশাদের পতনের পর দুই দল নিয়মিত কাউন্সিল করা এবং সময়ে সময়ে জনগণের মতামতের ভিত্তিতে দলের কমিটিগুলো পরিচালনার ওপর গুরুত্ব দিতে শুরু করেছিল। কিন্তু দুই দলই বর্তমানে সেসব নীতি বিসর্জন দিয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। কার কত পকেট কমিটি আছে, তা নিয়ে দুই দলে প্রতিযোগিতা রয়েছে। এর ফলে দেশশাসনের মান ও জবাবদিহি উভয়ই কমছে। রাষ্ট্র পরিচালনার দৈনন্দিন কার্যক্রমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত থাকা জরুরি। এর জন্য প্রয়োজন অব্যাহতভাবে গণতন্ত্রচর্চা। তা নিশ্চিত না করার ফলে গত এক দশকে দলের অভ্যন্তরে বিদ্রোহ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। বহু ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা চুলোয় গেছে। বিভিন্ন ধরনের নির্বাচন এলেই এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এবারের উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে উভয় দলেই বিদ্রোহী প্রার্থী সামলানো কঠিন হয়ে পড়েছে। সরকারি দল এবং বিরোধী দলের গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ায় দলীয় নেতা-কর্মীদের মনোভাবের প্রতিফলন ঘটে না। মনে হয় যেন সবকিছুই অদৃশ্য হাতের কারসাজি। হুটহাট সিদ্ধান্ত আকাশ থেকে টুপ করে পড়ে; যা গণতান্ত্রিক রীতি ও শাসনের পরিপন্থী।

No comments

Powered by Blogger.