অরণ্যে রোদন- আমরা কি মানুষ? by আনিসুল হক

এই ছবিটা দেখুন। ওই বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকান। ও আপনার-আমার যে কারও বাচ্চা হতে পারে। আমাদেরও বের হতে হয় হরতালে। উঠতে হয় রিকশায়, গাড়িতে, বাসে, টেম্পোতে, বেবিট্যাক্সিতে, রিকশাভ্যানে। যেকোনো সময় আগুন দেওয়া হতে পারে আমাদেরও বাহনে।
আমাদের যেকোনো কারও চামড়া ঝলসে যেতে পারে, চোখের পাপড়ি আর চুল পুড়ে যেতে পারে, মাংস পুড়ে অঙ্গার হয়ে যেতে পারে, দগদগে ঘা হতে পারে শরীরজুড়ে, দুই চোখ অন্ধ হয়ে যেতে পারে যেকোনো মুহূর্তে। আমরা লাশ হয়ে উঠে পড়তে পারি লাশবাহী গাড়িতে, পড়ে থাকতে পারি মর্গে। কিংবা কোনো রিকশাভ্যানে আশ্রয় নিয়ে সদ্য পোড়া যন্ত্রণাবিদ্ধ শরীর নিয়ে ছুটে যেতে পারি বার্ন ইউনিটে, কাতরাতে পারি, আর্তনাদ করতে পারি। তখন কী করবে আপনার-আমার সন্তান? কী করবে স্ত্রী কিংবা স্বামী? মা কিংবা বাবা?

কিংবা বের না হলেই কি রেহাই আছে! বাচ্চারা বাড়ির পেছনের উঠানে খেলতে যেতে পারে, টেপে মোড়ানো টেনিস বল ভেবে হাতে তুলে নিতে পারে হাতবোমা। উড়ে যেতে পারে তার হাত, পা, চোখ। কিংবা হরতালের দিনেই যে কেবল আমাদের যে কারও জীবনে এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে, তাও তো নয়। হরতালের আগের দিন তো বেরোনোর মানা নেই। কিন্তু হরতালের আগের দিনেও আক্রমণ করা হয় গাড়িতে, বারুদ ছিটিয়ে আগুন দেওয়া হয়, বোমা ছোড়া হয়, পেট্রলবোমা ছোড়া হয়। আমরা কী জবাব দেব চট্টগ্রামের সেই স্কুলছাত্রীকে, যে মায়ের সঙ্গে রিকশায় স্কুলে যাওয়ার পথে শিকার হয়েছিল বোমার। আমরা কী জবাব দেব গত ১৯ দিনে প্রতিবন্ধীসহ নিহত-আহত ৭৬ জন ও তাঁদের স্বজনদের। আমরা বর্বরতার কোন সীমায় পৌঁছালাম যে প্রতিবন্ধী মানুষটি দেখল পুড়ে যাচ্ছে তার ক্রাচ, আর সে জ্বলন্ত বাস থেকে নামতে গিয়ে নিজেই হলো দগ্ধ-আহত!
ওই শিশুটির মুখের দিকে তাকিয়ে দেখুন। কী বলবেন তাকে? সে কি বিএনপি, নাকি আওয়ামী লীগ? আর যারা গান পাউডার ছিটিয়ে আগুন দিল ওই বাসে, তারা কী? আমাকে শোনাতে আসবেন না যে তারা বিরোধী দলের হতে পারে, সরকারি দলের হতে পারে, এজেন্ট হতে পারে। বলতে আসবেন না যে ওই সরকার তার আগের সরকার তার আগের সরকারের আমলেও গান পাউডার ছিটিয়ে বাসে আগুন দিয়ে হরতালে বা হরতালের আগের দিনে মানুষ পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। আমি জিজ্ঞাসা করতে চাই, যারা আগুন দিয়েছে, তারা মানুষ কি না? তাদেরও মাতৃগর্ভে জন্ম হয়েছিল কি না? মাতৃস্তন্য সে পান করেছিল কি না? তাদেরও ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন আছে কি না? তারাও এই বাংলাদেশের রোদে-বৃষ্টিতে-হাওয়ায় বড় হয়েছে কি না? এদের কী বলব? পশু? কী করে পশু বলব? আজ পর্যন্ত কোনো পশু কোনো পশুশালায় আগুন দিয়েছে? বনে আগুন দিয়েছে? মানুষ আজ পশুর চেয়েও অধম।
মাত্র দেড় হাজার টাকা থেকে তিন হাজার টাকা দিলেই নাকি বাসে আগুন দেওয়ার লোক ভাড়া করা যায়। এই তাহলে অবস্থা?
তার পরেও বলব, সরকারকেই দায়িত্ব নিতে হবে। জনগণের জানমাল রক্ষার দায়িত্ব সরকারেরই। বাসে আগুন দিয়ে মানুষ মারা কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি হতে পারে না। এটা একেবারেই সন্ত্রাসবাদী কাজ, একেবারেই টেররিস্টের কাজ। কে মারা যাচ্ছে, তা বিচার না করে মানুষ মারার নামই টেররিজম। যারা এই কাজ করছে, তাদের কোনো রাজনৈতিক পরিচয়ই বিচার্য নয়। তারা অপরাধী, তাদের ধরতে হবে, শাস্তি দিতে হবে।

আর বিরোধী দলকে বলি, এই দেশের বেশির ভাগ মানুষই সমর্থন করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা। এটা নিয়ে আমরা সারা পৃথিবীর বুকে গর্ব করেছি। কিন্তু দুই বছর ধরে কী আন্দোলন করলেন যে মানুষের সম্পৃক্ততা নেই। বোমা ফাটালে, আগুন জ্বালালে সেই আন্দোলনে মানুষ কেন আসবে? আর যে আন্দোলনে মানুষ আসে না, সেই আন্দোলনে সফলতারও কোনো সুযোগ নেই। একটা জনপ্রিয় দাবিকে জনবিরোধী কৌশল প্রয়োগ করে আপনারা নষ্ট করেছেন। আর মানুষ বুঝে গেছে যে এটা হলো দুটো বড় রাজনৈতিক দলের ক্ষমতা নিয়ে কাড়াকাড়ি, মারামারি। তাতে তারা আসবে কেন?
সরকারি দলের নীতিনির্ধারকদের একটা কথা বলতে চাই। রংপুর জেলার তারাগঞ্জ উপজেলার গ্রামে গিয়েছিলাম, ৭ নভেম্বরের প্রথম আলোয় আমার লেখায় তার বর্ণনা ছাপা হয়েছে, দেখতে পারেন। গ্রামের মানুষ আমাকে বলেছেন, তাঁদের গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ, গোয়ালভরা গরু, সব বাচ্চা স্কুলে যায়, সবার বাড়িতে স্যানিটারি ল্যাট্রিন আছে, গ্রামে কোনো চোর নেই, তাঁদের কোনো অভিযোগ নেই। আজকে দেশে লোডশেডিং দেখা যাচ্ছে না। ঢাকায় অনেক জায়গায় যানজট কমেছে। কৃষিক্ষেত্রে, শিক্ষাক্ষেত্রে এই সরকারের সাফল্যের কথা শত্রুও স্বীকার করবে। তার পরেও সর্বশেষ জরিপে কেন দেখা যাচ্ছে, ভোট হলে লোকে বিএনপিকে ভোট দিতে চায়। দুর্নীতির কারণে? দুর্নীতি উভয় জোটের আমলেই হয়েছে, বিদেশিরা বিএনপির মন্ত্রীর বিরুদ্ধেও সংবাদ সম্মেলন করেছিল। শেয়ারবাজার, ডেসটিনি, হল-মার্ক—এসব তো আছেই। কিন্তু আসলে মানুষ সরকারি জোটের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে নেতা-কর্মীদের হম্বিতম্বির কারণে। মানুষ জানে, তাদের মন্ত্রী-এমপিরা সব সুযোগ নেন, তাঁরা ঈদে ট্রেন-বাসের টিকিটের কোটা নেন, স্টেডিয়ামের টিকিটের কোটা নেন, প্লট নেন। গণতন্ত্রে সবাই সমান, কিন্তু মন্ত্রী-এমপিরা একটু বেশি সমান। দলীয়করণ, দলীয় কর্মীদের সন্ত্রাস ও দৌরাত্ম্যে মানুষ বিরক্ত, কোথাও কোথাও ত্যক্ত-বিরক্ত। কিন্তু জনগণের বিরাগের সবচেয়ে বড় কারণ হলো, ক্ষমতাসীনদের আত্মম্ভরিতা! জনগণ একটা দিন সব হম্বিতম্বির জবাব দিতে পর্দাঘেরা গোপন কক্ষে ঢোকে, সে তো ভোটের দিন। ওই দিনে সে-ই তো রাজা। তার সামনে এসে দাঁড়াতে হবে করজোড়ে। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান তুলে দিয়ে মানুষের এক দিনের রাজা হওয়ার সুযোগটা কেড়ে নেওয়াই এই সরকারের জনপ্রিয়তা কমার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ।
গত কয়েক দিনে বেশ কিছু ঘটনা ঘটে গেছে। প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে জাতীয় সরকার গঠন করতে চেয়েছেন, বিরোধী দলের কাছে নাম চেয়েছেন। তার জবাব দেওয়া হয়েছে আপসহীনতার ভাষায়। প্রধানমন্ত্রী ফোন করেছেন বিরোধী নেত্রীকে, সেই আলোচনা পরিণত হয়েছে তপ্ত তর্কে। দেশের মানুষ দেখছে, হম্বিতম্বিতে বিরোধী দলও কম যায় না। এখন জনপ্রিয়তার জরিপ করলে হয়তো দেখা যাবে, বিরোধী দলের পারদ নামতে শুরু করেছে। আমার পরামর্শ হলো উভয় জোটের নেতাদের কাছে, দেওয়ার বেলায় এগিয়ে থাকুন। বিনয়ের প্রতিযোগিতা করুন। দেশের স্বার্থে যিনি বড় ছাড় দেবেন, তিনি এবার জনতার ভালোবাসা বেশি করে পাবেন।
সরকারি জোট যদি জনগণের ভালোবাসা অর্জন করতে চায়, এই হলো সুযোগ। বড় বড় কথা না বলে সত্যিকারের আন্তরিকতা নিয়ে বিরোধী দলকে কাছে আনার চেষ্টা করুন। দরকার হলে, প্রধানমন্ত্রী চলে যেতে পারেন বিরোধী নেত্রীর বাড়িতে। মহাসচিব পর্যায়ে তো যাওয়া যেতেই পারে।
আর বিরোধী দলের নেতাদেরও বলি, দেশের স্বার্থে একটা ন্যূনতম সমঝোতায় আসুন। বাংলাদেশের মানুষের ভোটের প্যাটার্ন হচ্ছে একবার এই জোট, আরেকবার ওই জোট। এবার আপনাদের পালা। আপনারা কেন এই সুযোগ ছেড়ে দিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের পথটাকেই একমাত্র বিকল্প হিসেবে নিচ্ছেন? একটা মানুষের প্রাণও তো প্রাণ। একটা মানুষের চোখও তো চোখ। কত কষ্ট হচ্ছে মানুষের। ডেইলি স্টার -এ ছবি দেখলাম, দুগ্ধ উৎপাদনকারী চাষিরা দুধ রাস্তায় ফেলে দিতে বাধ্য হচ্ছে হরতালের কারণে। রপ্তানি পণ্যবাহী ট্রাকে আগুন জ্বলছে, এই ছবি দেখে বুক কেঁপে উঠেছে। এটা কোন রাজনীতি যে রেললাইন উপড়ে ফেলে ট্রেনকে দুর্ঘটনার মুখে ফেলবেন!
আপনারা একটা জনমতের প্রকৃত প্রতিফলনের নির্বাচন করুন। তাতে জনগণ যাদের ভোট দেবে, তারা ক্ষমতায় আসবে।

আমি এ কথা বিশ্বাস করি না যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থাকবে কি থাকবে না, এই ভোট তার শেষ পরীক্ষা। আপনি দুর্নীতি করবেন, আর মুক্তিযুদ্ধের কথা বলবেন, তা হবে না। আপনি সন্ত্রাস করবেন, লুটপাট করবেন, আর ধর্মের দোহাই দিয়ে ভোট চাইবেন, জনগণ সেই ধোঁকাতেও সাড়া দেয় না। এই দেশের ভোটারদের মন সাদা কাগজের মতো পরিষ্কার, তুমি সুশাসন দাও, আমি তোমাকে ভোট দেব, না দিতে পারলে বিদায় হও। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশই থাকবে, তা ভোটে যে-ই ক্ষমতায় আসুক না কেন। দেশের মুক্তমনা জাগ্রত তরুণসমাজই এই দেশকে ইতিহাসের অন্ধকারের দিকে ফিরে যেতে দেবে না। যদি প্রয়োজন হয়, রাজপথে থেকেই সেই প্রশ্নের ফয়সালা করতে হবে।

বাংলাদেশ সব দিক থেকে ভালো করছে। দেশের চাকাকে সামনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে এই দেশের কৃষক, শ্রমিক, উদ্যোক্তা, সৃজনশীল তরুণসমাজ, সরকারি-বেসরকারি সংগঠন— সবাই মিলে। এত সুন্দর একটা দেশকে শুধু আত্মম্ভরিতার দ্বন্দ্বে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছাই করে দেবেন না। দয়া করুন।
একটা সন্ধির পথ বের করুন। সবাই মিলে নির্বাচনে আসুন। আমরা ভোটের উৎসব চাই, দেশকে পুড়িয়ে মারার বহ্নুৎসব চাই না।
আপনার-আমার সন্তানের মঙ্গলের জন্য আপনারা আগুন নিয়ে খেলা বন্ধ করুন। আর বন্ধ করুন নির্বিচারে আগুন জ্বেলে বোমা মেরে পেট্রল ঢেলে মানুষ মারা। পশুর চেয়েও অধিক পশুত্ব আমরা এরই মধ্যে দেখিয়ে ফেলেছি, একবার শিশুদের মুখের দিকে তাকান, একবার আপনার মায়ের মুখের দিকে তাকান, একবার হাত রাখুন সন্তানের মাথায়—দোহাই লাগে, মানুষের মতো আচরণ করুন।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.