সমৃদ্ধি সূচকে পথ হারায়নি বাংলাদেশ

বিষয়টি অনেকেরই স্মরণে থাকার কথা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের কয়েক বছরের মাথায় যখন দুর্ভিক্ষাবস্থা দেখা দেয়, দেশের বেশির ভাগ মানুষ যখন ভাতের পরিবর্তে আটার রুটি খাওয়া শুরু করে, ঢাকার রাস্তায় যখন গ্রাম থেকে উঠে আসা ছিন্নমূল কঙ্কালসার মানুষের সমাগম বেড়ে যায়, সেই দুর্দিনেই বাংলাদেশ থেকে একটা বড়সংখ্যক চিকিৎসক এবং প্রকৌশলীর বহরকে মালয়েশিয়ায় নিয়োগ দিয়ে সে দেশে নিয়ে যাওয়া হয়।
বলা বাহুল্য, সে সময় দেশটিতে প্রয়োজনীয়সংখ্যক চিকিৎসক এবং প্রকৌশলী ছিল না বলেই আমাদের দেশ থেকে নিয়ে যাওয়া হয় এসব পেশাজীবীকে। সে সময় বাংলাদেশের মেডিকেল কলেজ এবং প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীদের মধ্যে মালয়েশিয়ার ছাত্রছাত্রীও পাওয়া যেত, কারণ বাংলাদেশের শিক্ষার মান তখন দেশটির তুলনায় উচ্চমানের ছিল। অথচ স্বাধীন মালয়েশিয়ার বয়স স্বাধীন বাংলাদেশের চেয়ে ১৪ বছর বেশি, আর পাকিস্তানের চেয়ে ১০ বছর কম। ১৯৫৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর দেশটি দ্রুততম সময়ে উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির মহাসড়কে উঠে আসতে সক্ষম হয়েছিল। ১৯৭০ সালে মালয়েশিয়ার মাথাপিছু জিডিপি ছিল ৩৩৯ ডলার, ২০১২ সালে এই পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৯০০ ডলারে। ৪০ বছর আগে যে দেশটিকে বাংলাদেশ থেকে চিকিৎসক ও প্রকৌশলী নিয়ে যেতে হয়েছিল তাদের উন্নয়ন ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য, যে দেশের ছাত্রছাত্রীদের উচ্চ কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করতে বাংলাদেশে আসতে হতো, আজ সেই দেশটি বাংলাদেশে আসছে সেই দেশের স্বাস্থ্যসেবা বিপণনের জন্য। সে দেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বাংলাদেশে এসে সরাসরি প্রচারণা চালাচ্ছেন তাঁদের দেশের উন্নত চিকিৎসাব্যবস্থা এবং দক্ষ চিকিৎসকদের পক্ষে। মালয়েশিয়ার কোনো শিক্ষার্থী এখন আর দেশে পড়াশোনা করতে আসে কি না জানি না,
তবে বাংলাদেশের বহু ছাত্রছাত্রী এখন মালয়েশিয়াতে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে যায়। আমাদের এই উল্টোরথে চড়ার কারণ অনুসন্ধান করার সময় পেরিয়ে যায়নি এখনো। কিংবা কারণ উপলব্ধি করলেও সেসবের সামনে আমরা বড় অসহায়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ যখন চীন এবং মার্কিন পরাশক্তির প্রকাশ্য বিরোধিতা সত্ত্বেও স্বাধীনতাযুদ্ধে অবতীর্ণ এবং সে যুদ্ধে বিজয় যখন আসন্ন, তখন বাংলাদেশ ভবিষ্যতে একটা ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’তে পরিণত হবে—মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, এমন একটি কথা ব্যাপকভাবে প্রচলিত। তবে তিনি এই মন্তব্যটা কখন বা কোথায় করেছিলেন, এমন সুনিশ্চিত কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। ২০০৫ সালে সুইজারল্যান্ডের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম সম্মেলনে বাংলাদেশের একজন সাংবাদিক কিসিঞ্জারকে তাঁর এই কথিত মন্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি নাকি স্মরণ করতে পারেননি। পরে তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হলে তিনি নতুনভাবে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকার করে কেবল বলেছিলেন, ‘চুয়াত্তরে সে একটা সময় ছিল।’ এখানে উল্লেখ করা দরকার, কিসিঞ্জার আদৌ ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছিলেন কি না, সে ব্যাপারে কোনো সমর্থিত তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায় না।
ইংরেজিতে যে বিশেষণ ব্যবহার করা হয়েছিল বলে জানা যায়, সেটি হচ্ছে ‘বাস্কেট কেস।’ এই শব্দবন্ধের অর্থ হচ্ছে নৈরাশ্যজনক বা অকার্যকর কিংবা অপ্রতিকার্য অবস্থা, (সরকার বা প্রতিষ্ঠানের) খুব খারাপ অবস্থা বা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কাছাকাছি—ইত্যাদি। এ বিষয়ে সাংবাদিক মোহাম্মদ রেজাউল বারি এক নিবন্ধে বিষয়টির ওপর আলোকপাত করে ফরেন রিলেশনস অব দি ইউনাইটেড স্টেটস-এর ‘সাউথ এশিয়া ক্রাইসিস, ১৯৭১’-এর উদ্ধৃতি দিয়ে জানান যে বাংলাদেশকে প্রথমবারের মতো ‘বাস্কেট কেস’ হিসেবে পরিচিত করার ঘটনাটা ঘটেছিল ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর হোয়াইট হাউসে অনুষ্ঠিত ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের এক সভায়। সে সভায় কিসিঞ্জার ইউএস এইডের উপপ্রশাসক উইলিয়ামের কাছে জানতে চেয়েছিলেন যে পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক দুর্ভিক্ষ হবে কি না। জবাবে উইলিয়াম জানান যে নিকট ভবিষ্যতে না হলেও অদূরভবিষ্যতে হবে। এবং বাংলাদেশের তখন সব ধরনের সাহায্যের প্রয়োজন হবে। কিসিঞ্জার এই পর্যায়ে জানতে চান, তখন বাংলাদেশকে উদ্ধার করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অনুরোধ করা হবে কি না। এর জবাব হিসেবে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের আন্ডার সেক্রেটারি জনসন মন্তব্য করেন যে তারা (বাংলাদেশ) একটা আন্তর্জাতিক বাস্কেট কেস হবে। কিসিঞ্জার তখন মন্তব্য করেছিলেন, কিন্তু অবশ্যম্ভাবীরূপে আমাদেরই বাস্কেট কেস হবে এমন নয়। (সূত্র: ফোরাম, দি ডেইলি স্টার, তৃতীয় সংখ্যা, ২০০৮)।
উল্লিখিত নিবন্ধেই জানা যায়, বাংলাদেশের বিজয় অর্জনের নয় মাসের মাথায় নিউইয়র্ক টাইমস এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে মন্তব্য করে: ‘বাংলাদেশ যে একটা আন্তর্জাতিক অপ্রতিকার্য অবস্থায় (বাস্কেট কেস) পতিত হবে, গত বছর একজন মার্কিন কূটনীতিবিদের এমন কথিত পূর্বাভাস অন্ততপক্ষে আপাত সত্যে পরিণত হয়েছে। গত ডিসেম্বরে বাঙালিদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিল যে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, তা শেষ হওয়ার পর থেকে নতুন দেশটি ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যাপক ত্রাণ কার্যক্রমের গ্রহীতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।...আজ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় হুমকি বিদেশি সাহায্যের স্বল্পতা থেকে উদ্ভূত যতটুকু নয়, তার চেয়ে বেশি অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি থেকে।’ এমনকি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকেরই ধারণা ছিল না যে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে টিকে থাকতে পারবে। যাই হোক, মন্তব্যটি কিসিঞ্জার কিংবা অন্য কেউ করে থাকুক, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং এমনকি স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আন্তর্জাতিক বলয়ে এমনই ছিল মনোভাব এবং পূর্বাভাস। এ রকম বিরূপ মনোভাবাপন্ন প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক প্রচারণা এবং দাতাগোষ্ঠীর প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য অসহযোগিতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ সদ্যোজাত শিশুর মতো একটু একটু করে এগিয়ে গেছে। তার পরের ইতিহাস সবারই কমবেশি স্মরণে থাকার কথা। বঙ্গবন্ধু হত্যা, সেনাশাসন,
সেনা-সমর্থিত শাসন, গণতন্ত্রের পথে অভিযাত্রা, রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা এবং অস্থিতিশীলতা, উপর্যুপরি কয়েকটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ—এত সব প্রতিকূলতা থামাতে পারেনি বাংলাদেশের সামাজিক-অর্থনৈতিক মৌল ভিত্তিসমূহের অগ্রযাত্রাকে। অর্থনীতির মধ্যকার অন্তর্নিহিত শক্তির সহজাত তাড়নাতেই বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের যে ক্রান্তিরেখায় পৌঁছেছে, তাতে বিশ্বব্যাংকসহ অনেক আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী মনে করে ২০১৬ সাল নাগাদ বাংলাদেশ একটা মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হতে পারে সহজেই, যদিও এই অর্জনের জন্য দরকার হবে প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের ওপর উন্নীত করা। তবে আশার কথা এই যে বহুবিধ প্রতিকূলতা সত্ত্বেও কয়েক বছর ধরে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির গড় হার ৬ শতাংশ থেকে নিচে নামেনি। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ যখন বিশ্বমন্দায় আক্রান্ত, কিংবা আরব বসন্তের কবলে পড়ে মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতি যখন টালমাটাল—তখনো আমাদের প্রবৃদ্ধির ধারা ব্যাহত হয়নি। যে বাংলাদেশকে সাত-আট কোটি লোকের খাদ্য জোগানোর জন্য নির্ভর করতে হতো বিদেশি সাহায্যের ওপর, সেই বাংলাদেশ আজ খাদ্যে অর্জন করেছে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, ‘বাস্কেট কেস’ পরিণত হয়েছে ‘ফুড বাস্কেট’-এ।
অতি সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশ লন্ডনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান লেগাটাম-এর সমৃদ্ধি সূচকে ভারতকে অতিক্রম করে ১০৩তম অবস্থানে পৌঁছে গেছে, পক্ষান্তরে ভারত নেমে এসেছে ১০৬তম অবস্থানে। উল্লেখ্য, এই সূচক প্রস্তুত করা হয় ১৪২ দেশের সম্পদ, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, জীবনযাত্রার মান ইত্যাদির ভিত্তিতে। গবেষণায় উঠে এসেছে পাঁচ বছর ধরে সমৃদ্ধির আটটি সূচকের মধ্যে সাতটিতেই ভারতের অবস্থান ছিল নিম্নগামী, পক্ষান্তরে একই সময়ে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঠিক সাতটি সূচকে ঘটেছে অগ্রগতি। গবেষণার রিপোর্টে মন্তব্য করা হয়েছে, মাথাপিছু আয় ভারতের অর্ধেক হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের এই অতিক্রম এক বড় অর্জন। গড় আয়ু, অপুষ্টি, শিশুমৃত্যুর হার, স্যানিটেশন, মাধ্যমিক শিক্ষা, নিরাপত্তা, ব্যক্তি স্বাধীনতা ইত্যাদি সূচকে বাংলাদেশ ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, এমন অর্জন থেকে বোঝা যায় যে উন্নয়ন এবং অগ্রগতি কেবল দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর নির্ভরশীল নয়। ভারতের দৃষ্টান্তই বলে দেয় যে একমাত্র জিডিপির প্রবৃদ্ধিই যথেষ্ট নয়, দেখা গেছে ১৯৯৫ সাল থেকে ২০১২ পর্যন্ত ভারতের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার বরাবরই বাংলাদেশের তুলনায় গড়ে ১.২ শতাংশ এগিয়ে ছিল। অর্থনীতির আকার, জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার, মাথাপিছু আয় এসব সূচকের সব কটিতেই ভারতের চেয়ে পিছিয়ে থেকেও বাংলাদেশ সমৃদ্ধি সূচকে এগিয়ে গেছে তার বৃহৎ এই প্রতিবেশী দেশটি থেকে। আরও উল্লেখযোগ্য বিষয়,
১৯৪৭ সালে ত্রিখণ্ডিত ব্রিটিশ ভারতের আরেকটি দেশ পাকিস্তান পড়ে আছে সূচকের ১৩২ নম্বরে। যে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বাংলাদেশ অর্জন করেছিল স্বাধীন একটি রাষ্ট্র, সেই দেশটি থেকে সূচকের প্রায় ৩০ পয়েন্ট এগিয়ে থাকা বাংলাদেশের জন্য আরও একটি বিজয়ের গৌরব এনে দেয়। তবে আলোচ্য রিপোর্টে বাংলাদেশের অর্জনসমূহকে স্বীকার করা হলেও মন্তব্য করা হয়েছে, যদিও সূচকে বাংলাদেশের অব্যাহত অগ্রযাত্রা অংশত সফল উন্নয়ন কৌশলের প্রতিফলন—আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত হবে না যে দেশটির নিজস্ব অনেক সমস্যা রয়েছে। এত সব সাফল্যের পরও এখনো বাংলাদেশের তীব্র সমস্যাসমূহ রয়ে গেছে, বিশেষ করে রাষ্ট্রশাসনে...। আজ বিশ্বসভা নির্দ্বিধায় স্বীকার করছে যে বাংলাদেশের একটি মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা সফল হতে পারে যদি নিশ্চিত করা যায় উৎপাদনসক্ষমতা ও দক্ষতা, দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ, পর্যাপ্ত অবকাঠামো এবং স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ। রাজনৈতিক অস্থিরতা নিম্ন ও মধ্য আয়ের বহু দেশেই থাকে সমাজের সহজাত অনুষঙ্গ হিসেবে, কিন্তু সম্প্রতি বাংলাদেশে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং অধিকারের নামে যে বিধ্বংসী প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে, তা দীর্ঘায়িত হলে বা স্থায়ী রূপ নিলে ম্লান হয়ে যাবে আমাদের যাবতীয় অর্জন। এই অবিশ্বাস্য আত্মঘাতী পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সদিচ্ছার দিকে চেয়ে আছে সাধারণ মানুষ।
ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার।
fmainuddin@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.