ফোনে আড়িপাতা ও ক্ষয়িষ্ণু মার্কিন প্রভাব by মুহাম্মদ রুহুল আমীন

লাখ লাখ রেড ইন্ডিয়ানের গণকবরের ওপর দাঁড়িয়ে থেকেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার উন্নত আন্তর্জাতিক মূল্যবোধের কারণে বহির্বিশ্বে প্রভাব বিস্তার ও নেতৃত্বদানের প্রেক্ষাপট রচনা করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু বিতর্কিত গুপ্তচরবৃত্তিসহ সাম্প্রতিককালের কয়েকটি ঘটনা বহির্বিশ্বে দেশটির সম্মানহানির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক গোয়েন্দা পর্যবেক্ষণ নীতি সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বেশি দুর্নাম কুড়িয়েছে। এর বদৌলতে জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা (এনএসএ) যে কোনো নাগরিক ও বিদেশীর ফোনালাপ রেকর্ড করার বৈধতা পেয়েছে। জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান জেমস আর ক্লেপার স্বীকার করেছেন, বারাক ওবামার গোয়েন্দা নীতির অংশ হিসেবে ফোনালাপ রেকর্ড করার প্রক্রিয়া এখনও অব্যাহত রয়েছে। দেশটির সাবেক এনএসএ কর্মকর্তা অ্যাডওয়ার্ড স্নোডেন যুক্তরাষ্ট্রের নজিরবিহীন ফোন রেকর্ডের তথ্য ফাঁস করে বিশ্বময় হৈচৈ ফেলে দেন। ফোন রেকর্ড ছাড়াও রাজনীতিক, ব্যবসায়ী এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কম্পিউটার, ইমেইল নজরদারির নীতি যুক্তরাষ্ট্রের বহিঃইমেজের গোড়া কেটে ফেলেছে।
স্নোডেনসহ সাবেক মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের অনেকে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষয়িষ্ণু ভাবমূর্তি নিয়ে শংকিত ও উৎকণ্ঠিত। তাদের মতে, সবচেয়ে বিপর্যয়কর পরিণতি হল, এ ধরনের গোয়েন্দা নীতি স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের প্রতি চপেটাঘাতস্বরূপ। সাবেক সিআইএ কর্মকর্তা ম্যাকগভর্ন মন্তব্য করেছেন, তার দেশের ফোনে আড়িপাতা এবং কম্পিউটার পর্যবেক্ষণ নীতি নাগরিকদের স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে যাচ্ছে। তারা আরও মনে করেন, এ ধরনের বিপর্যয়কর জাতীয় নীতি আন্তর্জাতিক নীতি-নৈতিকতার চরম লংঘন। উদাহরণস্বরূপ, গোপনীয়তাবিরোধী কতিপয় গোষ্ঠী এবং সাবেক এনএসএ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা একটা দল মনে করে, তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে আন্তর্জাতিক নৈতিকতার বাধ্যবাধকতা থাকা আবশ্যক। কোনো কোনো বিশ্লেষকের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা নীতি দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। অপরাপর রাজনৈতিক বিশ্লেষকের ধারণা, গোয়েন্দাগিরির ছদ্মাবরণে ফোনে ও কম্পিউটারে আড়িপাতা নীতি আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে মারাত্মকভাবে। ব্যক্তি যখন স্বাধীনতা ভোগে অনিশ্চিত থাকে, তখন সে এমন সংস্কারের গোলক ধাঁধায় আক্রান্ত হয় যে, তার উদ্ভাবনী শক্তি হ্রাস পায়। ফলে আন্তর্জাতিক উন্নয়নও বিঘ্নিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, স্নোডেন মস্কোতে তার প্রথম ভিডিও বার্তায় বলেছেন, পৃথিবীর সব মানুষ এখন বুঝতে পারছে, আমাদের গোয়েন্দা নীতি সর্বত্র আমাদের নিরাপত্তাহীনতার যন্ত্রণা বাড়াচ্ছে, আমাদের অর্থনীতির বিনাশ ডেকে আনছে, আমাদের দেশকে ধ্বংস করছে এবং সর্বোপরি আমাদের কথা বলার, চিন্তা করার, মুক্তভাবে বসবাস করার, সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটানোর এবং সম্পর্ক রচনার অধিকারগুলো সংকুচিত করে তুলেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা নীতি দেশ-বিদেশে তাই ব্যাপক সমালোচনার ঝড় তুলেছে। পশ্চিমা সমাজে তরুণ-তরুণীদের দ্বারাই গোয়েন্দা-নীতিবিরোধী তৎপরতা শুরু হয়েছে। অস্ট্রেলীয় জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ, ব্রিটিশ নাগরিক সাবাহ হ্যারিসন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাডওয়ার্ড স্নোডেন, গ্লেন গ্রিনওয়াল্ড ও ব্রাডলিসহ অসংখ্য তরুণ-কলমযোদ্ধা আজ যুক্তরাষ্ট্রের অনৈতিক, অন্যায়, বেআইনি গোয়েন্দা নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে দেশান্তর হয়েছেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিষ্ঠুর আইনি জুুলুম নির্যাতনের করাল থাবার শিকার হচ্ছেন। তবুও তারা সর্বস্তরের জনগণের প্রশংসা পাচ্ছেন প্রতিনিয়ত, বিদেশীদের দ্বারাও সংবর্ধিত হচ্ছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক চার এনএসএ কর্মকর্তার একটি দল স্নোডেনের সঙ্গে মস্কোতে সাক্ষাৎ করে তার মহৎ কর্মের প্রতি শ্রদ্ধা ও সমর্থন জানিয়েছেন। তাদের একজন ম্যাকগভর্ন স্নোডেনকে প্রতীকী মোমবাতির জিয়নকাঠি উপহার দিতে গিয়ে বলে ওঠেন, স্নোডেনের মতো অসংখ্য তরুণ একই অনুভূতিতে অনুপ্রাণিত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি-কৌশলের অন্ধকারগুলো দূর করবে।
যুক্তরাষ্ট্রের বাইরেও ফ্রান্স, মেক্সিকো, জার্মানি ও ইইউসহ বিভিন্ন দেশে যুক্তরাষ্ট্রের উপরোক্ত নীতি ব্যাপকভাবে সমালোচিত হচ্ছে। ২৫ অক্টোবর লন্ডন থেকে রয়টার্স জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ৩৫ জন গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ব নেতার ওপর, গোয়েন্দাগিরি করে আসছে। ফ্রান্সের দৈনিক পত্রিকা লা মঁদ এবং জার্মানির সাপ্তাহিক ডার স্পাইগেইল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র লাখ লাখ ফরাসির ফোনালাপে আড়ি পেতেছে এবং মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট ফিলিপ কালডেরনের ইমেইলে চৌর্যবৃত্তির আশ্রয় নিয়েছে। লা মঁদ জানিয়েছে, ১০ ডিসেম্বর থেকে ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত এক মাসে যুক্তরাষ্ট্র ফ্রান্সের ৭০.৩ মিলিয়ন ফোনালাপে আড়ি পেতেছে। ব্রাজিলভিত্তিক আমেরিকান সাংবাদিক গ্লেন গ্রিনওয়াল্ড বলেছেন, তিনি অচিরেই আরও অসংখ্য আড়িপাতা ফোনের তথ্য প্রকাশে বিশ্বের নামকরা পত্রিকার সম্পাদকদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। ক্রমবর্ধমান আড়িপাতা নীতির খবর প্রকাশের মুখে জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেলের শংকা দূর করতে বারাক ওবামা তাকে আশ্বস্ত করেছেন, তার ফোনে কখনও আড়িপাতা হবে না।
ইইউ দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের বিতর্কিত গুপ্তচরবৃত্তির নীতিকে মার্কিন ও ইইউ সম্পর্কের ক্ষেত্রে চরম আস্থা ভঙ্গকারী হিসেবে অভিহিত করে মার্কিন গুপ্তচরবৃত্তির পুনর্মূল্যায়ন দাবি করেছেন। গোয়েন্দাগিরি কৌশল হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নানা গোপনীয় কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, টঝ-৯৮৫উ নামক কোড ব্যবহার করে এনএসএ স্বয়ংক্রিয়ভাবে যে কোনো ফোনালাপ রেকর্ড করতে পারে এবং টেক্সট মেসেজ পাঠ করতে পারে। এমন আরেকটি গোপনীয় কর্মসূচির নাম হল চজওঝগ, যার মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের নজরদারির আওতায় আনা যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সম্মান বিনষ্টের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ইয়েমেনে ক্রমবর্ধমান ড্রোন আক্রমণ। এই বিষয়ে এ পর্যন্ত অসংখ্য রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। জাতিসংঘ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, বুরো অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজমসহ অনেক মানবাধিকার সংগঠন এমন রিপোর্ট প্রকাশ করছে। এসব রিপোর্টে ড্রোন আক্রমণকে অন্যায়, অস্পষ্ট, মানবাধিকারের লংঘন, স্বাধীনতা হরণ, অমানবিক এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর হিসেবে উল্লেখ করা হলেও হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জে কার্নি তা অস্বীকার করেছেন। লন্ডনভিত্তিক সংস্থা ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজমের মতে, ২০০৪ সালে পাকিস্তানের প্রত্যন্ত উপজাতি এলাকায় ৪০০টি ড্রোন আক্রমণের ফলে ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার ৬০০ মানুষ নিহত হয়েছে। জাতিসংঘের বিশেষ সমন্বয়ক বেন এমারসন এক প্রাথমিক প্রতিবেদনে নিহতের সংখ্যা ৪৫০-এর বেশি বলে জানিয়েছেন। এতদসত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র নিহতের ঘটনা অব্যাহতভাবে অস্বীকার করে চলেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষয়িষ্ণু ভাবমূর্তির ওপর আরও একটি ধাক্কা লাগে দেশটির প্রশাসনিক হঠাৎ বন্ধের (শাটডাউন) ঘটনায়। পল টেইলর তার সাম্প্রতিক ইউএস প্রেসটিজ টেইকস এ হিট শীর্ষক নিবন্ধে শাটডাউনের পর যুক্তরাষ্ট্রের মর্যাদা হ্রাসের চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন। ১৭ অক্টোবর বারাক ওবামা স্বীকার করেছেন, ১৬ দিনের শাটডাউন প্রক্রিয়া ওয়াশিংটনের বৈশ্বিক অবস্থান অত্যন্ত নড়বড়ে করে তুলেছে। তিনি বলেছেন, গত কয়েক সপ্তাহব্যাপী শাটডাউন প্রক্রিয়া বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাসযোগ্যতায় মারাত্মক চিড় ধরিয়েছে। এটা আমাদের শত্র“দের উৎসাহিত করেছে, আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের শক্তিশালী করেছে এবং আমাদের ওইসব বন্ধুকে হতাশাগ্রস্ত করেছে, যারা আমেরিকার বৈশ্বিক নেতৃত্বের প্রতিশ্র“তির দিকে তাকিয়ে আছে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জোসেফ নাঈ বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা নীতির ফলে সৃষ্ট জটিলতা আরও তীব্র হয়েছে দেশটির শাটডাউন ঘটনার মাধ্যমে। যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত মর্যাদা ক্ষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে দেশটির আশু কর্তব্য হল অবিলম্বে তার জাতীয় নীতির পুনর্মূল্যায়ন ও পুনর্নির্ধারণ করা। আমার মনে হয়, শক্তির মাংসপেশি প্রদর্শনের চেয়ে বেশি কার্যকর কৌশল হল আদর্শের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করা। সে লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই তার হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারে তৎপর হতে হবে। বিশ্বায়নের এ পৃথিবীতে যুক্তরাষ্ট্র কেবল অন্যদের ওপর চাবুক পেটাবে, আর অন্যরা তা নীরবে সহ্য করবে- এটা অসম্ভব। বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান অসন্তোষের মুখেও যুক্তরাষ্ট্রকে বৈশ্বিক নেতৃত্ব দানের প্রতিশ্র“তি ও যোগ্যতা প্রদর্শন করতে হবে এবং এভাবেই রাষ্ট্রটি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে উদ্ভাবনী পরিবর্তনের পথে অগ্রসর হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের উচিত হবে এমন নীতি অনুসরণ করা, যাতে তারা তাদের সমৃদ্ধ মূল্যবোধ ও আন্তর্জাতিক নৈতিকতার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বহির্বিশ্বে গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে পারে। বৈশ্বিক নেতৃত্বদানে স্থায়িত্ব লাভ করতে হলে অবশ্যই আমেরিকাকে গোপনে আড়িপাতার নীতি এবং ডিজিটাল যুগের অন্যান্য অনৈতিক কৌশল পরিহার করতে হবে। সভ্যতা জন্ম লাভ করে বেঁচে থাকে তার আদর্শের উৎকর্ষের মাঝ দিয়ে আর সভ্যতা ধ্বংস হয় তার নৈতিকতা বিসর্জনের কারণে। আমেরিকা অবশ্যই ধ্বংস হবে, যদি তার আদর্শের মৃত্যু হয়।
মুহাম্মদ রুহুল আমীন : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.