যে নির্বাচন না হবে গণতন্ত্রসম্মত, না হবে শাসনতন্ত্রসম্মত by মইনুল হোসেন

এ সত্য আমাদের নিরাশ করে যখন আমরা দেখি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু এবং আরও অনেকের নেতৃত্বে যে আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে অথবা অন্যদের সঙ্গে জোট বেঁধে গণতন্ত্রের জন্য রাকনসংগ্রাম করেছে, গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে, সেই আওয়ামী লীগ এ দেশে বরাবর গণতন্ত্র ধ্বংস করার প্রক্রিয়ায় পুরোভাগে থাকছে। উদ্ভূত পরিস্থিতির জরুরি তাগিদ থেকে যদি আর একবার আমরা পরীক্ষা করি তাহলে দেখতে পাব, সরকার অপ্রত্যাশিতভাবে নিজেদের নির্বাচনী সুবিধার জন্য খেয়াল-খুশিমতো শাসনতন্ত্র সংশোধন করতে গিয়ে এমন বৈপরীত্য সৃষ্টি করেছে যার জন্য রাজনীতিকরা মোটেও নিন্দার তোয়াক্কা করবেন না। কিন্তু আশার কথা হবে যদি অন্যরা সংকট নিরসনে কোনো রকম চিন্তা-ভাবনা উপস্থাপন করতে উজ্জীবিত বোধ করেন। সরকারি পরিকল্পনা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী, তার মন্ত্রিসভা এবং সংসদ সদস্যরা বহাল তবিয়তে থাকবেন এবং তারাই সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করবেন আর অন্যদের বলা হচ্ছে, তারা যেন শাসনতন্ত্র মেনে চলেন এবং অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে তাদের কর্তৃত্ব স্বীকার করে নেন। জনগণ প্রদত্ত শাসনতন্ত্র মানার ব্যাপারে প্রত্যেকের জন্য একটা বাধ্যবাধকতা রয়েছে- এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সংশয়ের অবকাশ নেই। কারণ এর পেছনে জনগণের নিজস্ব ইচ্ছার অনুমোদন রয়েছে। জনগণের অনুমোদনকে দেখতে হবে পবিত্র আমানত হিসেবে এবং তার প্রতি সম্মান দেখাতে হবে সবাইকে, বিশেষ করে বিচার বিভাগ ও আইন প্রণেতাদের। আইন প্রণেতাদের স্মরণ রাখতে হবে, তাদের ক্ষমতার উৎস হচ্ছে জনগণ প্রদত্ত শাসনতন্ত্র। শাসনতন্ত্র পরিবর্তনের ব্যাপারটিকে কতজন আইন প্রণেতা সমর্থন করেন, সেই সংখ্যার নিরিখে একে যুক্তিযুক্ত বলা যাবে না। তারা জনগণ দ্বারা নির্বাচিত হলেও তারা কিন্তু সার্বভৌম জনগণ নন। গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র সংশোধন করতে হলেও সে ব্যাপারে জনগণের মধ্যে একটা ঐকমত্য থাকতে হয়। একজন স্বৈরশাসকের শাসনতন্ত্র তার নিজস্ব শাসনতন্ত্র, মোটেও তা জনগণের শাসনতন্ত্র নয়। এ ধরনের শাসনতন্ত্রের অধীনে জনগণকে অধীনস্থ থাকার জন্য বাধ্য করা হয়। কিন্তু সে বাধ্যতার সঙ্গে সহজাত শ্রদ্ধার কোনো সম্পর্ক থাকে না। ১৯৭৫ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাকশাল প্রবর্তন করার শাসনতন্ত্রও সংসদে অনুমোদিত হয়েছিল। কিন্তু কেউ ওই শাসনতন্ত্রকে গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র বলবেন না। যে নির্বাচন নিয়ে আমরা কথা বলছি, তা যদি আদৌ অনুষ্ঠিত হয় তবুও তাকে সরকারের একটা ফন্দি হিসেবেই দেখা হবে, তাকে গণতন্ত্রসম্মত কিংবা শাসনতন্ত্রসম্মত কোনোটাই বলা যাবে না। সরকার এ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সফল হলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় স্থায়ীভাবে থেকে যাবে।
পরিকল্পনাটি ছিল ব্যাপক। ব্যক্তির ইচ্ছা-অভিপ্রায় অনুসারে কোনো গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র একতরফাভাবে পরিবর্তন করা যায় না, আর করলে তার বৈধতা থাকে না। শাসনতন্ত্রের পঞ্চদশ সংশোধনী করা হয়েছিল সব দলের সংসদীয় কমিটির সুপারিশ এবং সুশীল সমাজের সদস্যদের মতামত উপেক্ষা করে। এ ব্যাপারে সুপ্রিমকোর্টের পরামর্শ ছিল পরবর্তী দুটি সাধারণ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত করা যাবে।
এ বিষয়ে সাহায্য করার জন্য সুপ্রিমকোর্ট কর্তৃক নিয়োজিত আটজন আইনজীবীর সাতজনই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বহাল রাখার অনুকূলে অভিমত দিয়েছিলেন। সুপ্রিমকোর্টের যে সাতজন বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক বিষয়ক মামলাটি শুনেছিলেন, তাদের মধ্যে তিনজন বিচারপতি এ সিদ্ধান্ত দেন যে, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাটি অসাংবিধানিক নয়। মাত্র একজনের সংখ্যাগরিষ্ঠতায় শাসনতন্ত্রের বিধান বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয়াটা সমীচীন হতে পারে না। বিশেষ করে যখন সেই সিদ্ধান্ত জনগণের অবাধ ভোটাধিকারের স্বাধীনতা খর্ব করে।
উপরন্তু, এটা এমন একটি সংশোধনী যা বিশ্বের যে কোনো জায়গায় চালু থাকা সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সংসদ প্রথমে অবলুপ্ত না করে কোথাও সংসদীয় ব্যবস্থায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় না। এ কারণে সংসদীয় ব্যবস্থায় নির্বাচিত সরকারের অধীনে সরকার বদলের নির্বাচন অনুষ্ঠান করার ব্যাপারটি স্ববিরোধী। সংসদ বাতিল হওয়ার পর কোনো সরকার আর নির্বাচিত থাকে না। সংসদ টিকিয়ে রেখে সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করা যে কঠিন, সেটা বিলম্বে হলেও নির্বাচন কমিশন উপলদ্ধি করেছে।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ক্ষমতায় থাকার জন্য এতটা অন্ধ যে, সবার কাছে গ্রহণীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো সহজ পথ যে খোলা নেই সেটা তারা দেখতে পাচ্ছে না। সংসদ বাতিল করার সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন উঠবে, সুপ্রিমকোর্ট নির্দেশিত নির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে কীভাবে? যতক্ষণ না আমরা এ অবাস্তব ধারণা স্বীকার করে নেব যে, নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আমাদের একটি নিরপেক্ষ সরকারকে আগে নির্বাচিত করতে হবে। সুতরাং জটিলতা শুধু শাসনতান্ত্রিক নয়, সুপ্রিমকোর্টের রায় নিয়েও - যা বদলাতে হবে। অন্যদিকে দেশে মারাত্মক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও বিশৃংখলা বেড়ে যাচ্ছে। দলের তরুণ কর্মীরা ভয়ংকর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়ছে তাদের প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়ার জন্য এবং পরস্পরকে হত্যা করছে। গণতন্ত্রের বদলে আমরা হব্স বর্ণিত নিষ্ঠুরতার দিকে এগিয়ে চলেছি।
আমাদের নেতারা আপস-সমঝোতার পন্থা বের করার জন্য সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে পরামর্শ করার ব্যাপারে মোটেই আগ্রহী নন। আবার চালকের আসনের ‘বিজ্ঞজনেরা’ মুক্ত আলোচনায় বসতে দেবেন না। এমনকি ছাড় দিয়ে তারা একটা নিজস্ব জাতীয় সরকার গঠন করতেও অক্ষম, যে সরকার নির্বাচন দেখভাল করতে এবং তাদের পারস্পরিক আÍধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাবে।
আমাদের রাজনৈতিক চিন্তা ও মননের ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত পরিবর্তন আনার জন্য দলীয় রাজনীতির বাইরে একটি জাতীয় সরকার গঠন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে বলে মনে হচ্ছে। নীরব দর্শক হয়ে বসে থাকার কিংবা কোন পথে ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধার হবে সেটা দেখার সময় দ্রুত বয়ে যাচ্ছে। আমাদের শিক্ষিত সমাজ কম স্বার্থপর এবং অধিক আত্মমর্যাদাসম্পন্ন হলে সবকিছুই করা সম্ভবপর ছিল। কোনো গণতন্ত্রই বাইরের সাহায্য ছাড়া বিকশিত হতে পারে না। কিন্তু সমস্যার সমাধান আসতে হয় ভেতর থেকে। আমরা যে নির্বাচনী ব্যবস্থা গড়ে তুলেছি তাতে একটি ব্যর্থ সরকারের জায়গা নেবে আর একটি ব্যর্থ সরকার- এই ব্যবস্থা আর চলতে পারে না। রাজনীতিকে গণতন্ত্রের পথে চালিত করার আমাদের অধিকার আমাদেরই প্রয়োগ করতে হবে।
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন : আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ

No comments

Powered by Blogger.