চায় সুন্দর সংসার, সন্তান ও স্বামী: তসলিমা নাসরিন

তসলিমা নাসরিনের সাম্প্রতিককালের দু’টি লেখা পড়লাম। প্রথম লেখাটির শিরোনাম ছিলো হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কিত।
লেখাটিতে তসলিমা নাসরিন হুমায়ুন আহমেদকে পুরুষতান্রিক সমাজের বাহক বলে আখ্যায়িত করেছেন।

লেখাটি পড়ে আমার মনে হয়েছে, তসলিমা নাসরিন পুরুষতন্ত্র ও নারীবাদিতা সম্পর্কে একটু ভুল ধারণা পোষণ করেন অথবা দীর্ঘদিন দেশের বাহিরে অবস্থান করার কারণে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে একটু কম অবহিত রয়েছেন। লেখার শুরুতেই তিনি বলেছেন, ছেলেবেলায় হুমায়ুন আহমেদ পড়লেও যখন সাহিত্য বুঝতে শিখেছেন তখন তিনি হুমায়ুন আহমেদ পড়া ছেড়ে দিয়েছেন। একই সাথে আরো বলেছেন যে যখন তিনি নাটক অথবা সিনেমা বুঝতে শিখেছেন তখন থেকে হুমায়ুন আহমেদ এর নির্মিত নাটক দেখা ছেড়ে দিয়েছেন। তসলিমা নাসরিন এর এ রকম মন্তব্যের পেছনে দুটো যুক্তি থাকতে পারে। প্রথমত: তিনি হুমায়ুন আহমেদের লেখা পছন্দ করেননি কারণ এতে “যৌন-যৌনাঙ্গ ও যোনী”-এ তিনটি শ্বব্দের ব্যবহার অপেক্ষাকৃতভাবে কম। দ্বিতীয়ত: যে সাহিত্য হুমায়ুন আহমেদ তৈরী করে গেছেন সে সাহিত্য তা তসলিমা নাসরিনের মান সম্মত হয়নি। তবে তসলিমা নাসরিন কেন হুমায়ুন আহমেদের নাটক দেখতেন না তা আমার বোধগম্য নয়। গুটি কয়েক সিনেমা ছাড়া বাংলাদেশে এর চেয়ে মান সম্মত কোনো সিনেমা তৈরী হয়েছে কিনা তা আমার জানা নাই। তসলিমা নাসরিন এ কথা স্বীকার করেছেন যে হুমায়ুন আহমেদ পাঠক তৈরী করেছেন। এটা বাংলা সাহিত্যে হুমায়ূন আহমেদের অনেক বড় অবদান। হুমায়ুন আহমেদ বাংলা সাহিত্যকে কোলকাতা থেকে বাংলাদেশ মুখী করেছেন। আমাদের ছেলেবেলায় আমরা সুনীল গঙ্গপধ্যায় অথবা সমরেশ মজুমদার পড়তাম কিন্তু আশি’র দশকে আমরা মূলত উপন্যাস বলতে হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসকেই বুঝতাম। হুমায়ূন আহমেদ বিতর্কের উর্ধ্বে ছিলেন না তবে ওনার কঠিনতম সমালোচকরাও ওনাকে তিন দশকের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক বলেই অভিহিত করেছেন। তসলিমা নাসরিনের মতে বাংলাদেশের অর্ধশিক্ষিত অশিক্ষিত মানুষ সস্তা দরের উপন্যাস পরে অনন্দ পায় তাই হুমায়ুন আহমেদ এত জনপ্রিয় ছিলেন। তসলিমা নাসরিনের সাথে আমি একমত হ্যাঁ-হুমায়ুন আহমেদ বাংলাদেশের অর্ধশিক্ষিত-অশিক্ষিত মানুষেকে বই মুখো করেছেন। অশিক্ষিত জাতিকে শিক্ষার আলোতে আলোকিত করবার চেষ্টা করেছেন। এ কাজটিই বা বাংলাদেশের কয়জন সাহিত্যিক করেছেন? কথা সাহিত্যিক তসলিমা নাসরিনের কথায় যদি আমরা ধরি তবে যা দেখতে পাই তা হচ্ছে তিনি একজন সাহিত্যিককে বেশ্যার পর্যায়ে নামিয়ে নিয়ে গেছেন। স্বয়ং তসলিমা নাসরিন বলেছেন বেশ্যা আমরা সবচেয়ে বড় উপাধি। এটা অনেক নারীকে সাহিত্যিক হতে অনুৎসাহিত করেছে। পরিবারের বাধাও পেতে হয় মেয়েদের এখন সাহিত্য চর্চার জন্য। এটা জাতির জন্য কোনো মঙ্গলকর দিক নয়। লেখা লেখির প্রাথমিক পর্যায়ে আমাকেও একথা বেশ কয়েকবার শুনতে হয়েছে। তসলিমা নাসরিন হবার প্রয়োজন নেই। তসলিমা নাসরিন হুমায়ুন আহমেদের দ্বিতীয় বিয়ের কথা তুলে বলেছেন যে হুমায়ুন আহমেদ পুরুষ ছিলেন বিধায় সমাজ তার মেয়ের বয়সী একজন মেয়ের বিয়ে মেনে নিয়েছেন। একজন লেখকের কাছ থেকে এ ধরনের মন্তব্য আশা করা যায় না। এবং এ ধারনাটি সম্পূর্ণ রূপে ভুল। হুমায়ুন আহমেদ এ কারণে বহু বিতর্কের সম্মুক্ষীন হয়েছেন। পাঠকও হারিয়েছেন। তসলিমা নাসরিন দেশের বাহিরে অবস্থান করেছেন বিধায়-এ ব্যাপারটি বুঝতে পারছেন না। তিনি আরো বলেছেন যে যদি স্বয়ং তসলিমা নাসরিন তার ছেলের বয়সী কাউকে বিয়ে করেন তবে সমাজ তা মেনে নেবে না। ওনার এ ধারনাও ঠিক নয়-তসলিমা নাসরিন যদি সাবালক কাউকে বিয়ে করেন তবে সমাজ তা মেনে নেবে। দীর্ঘদিন দেশের বাহিরে বসবার করবার কারণে এ ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। জনপ্রিয় অভিনেত্রী সুবর্ণা মোস্তফা তার ছেলের বয়সী একজনকে বিয়ে করেছেন-এতে করে সুবর্ণা মোস্তফার জনপ্রিয়তা মোটেও কমেনি এবং কোনো বিতর্কেরও সম্মুখীন ও হননি। নারী-পুরুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিগত এক যুগে দেশ বেশ পাল্টে গেছে শুধু পালটায়নি রাজনৈতিক অবস্থায় একজন লেখক ক্ষণজন্মা। তসলিমা নাসরিন ও এর বাহিরে নন। তিনি হুমায়ুন আহমেদের মত জনপ্রিয় লেখকের ব্যবহৃত “নাই” ও ” নেই” এর ব্যবহার নিয়ে মত পার্থক্য তুলেছেন। বিতর্কিতহলেও তসলিমা নাসরিনও একজনবড় লেখক। তিনি সাহিত্যের জগতে একটি ঝড় তুলতে সক্ষম হয়েছেন। জাতিকে দেবার মতন অনেক কিছু আছে ওনার কাছে। তিনি পারেন অশিক্ষত-অর্ধশিক্ষিত জাতিকে শিক্ষিত করতে এবং পারেন সমাজকে কুসংস্কার থেকে বের করে আনতে। তসলিমা নাসরিনের এ কথা মেনে নিচ্ছি যে এক সময় বাংলাদেশের মেয়েদের অবস্থান ছিল ক্রতদাসির মতন তবে বিগত এক যুগে সমাজে নারীর অবস্থান বেশ পাল্টে গেছে। তাছাড়া নারিবাদিতা আর দেহবাদিতা এক কথা নয়। নারীবাদিতার অর্থ দেহ বাদিতা নয়। নারীকে বেশ্যা হিসেবে উপস্থাপন করা নয়। নারিবাদিতার অর্থ সমাজে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করা এবং নারীর যথাযোগ্য মর্যাদা দেয়া। তসলিমা নাসরিনের যে কোনো লেখা পড়লে আমার মনে হয় যে লেখায় সেক্স এবং জেন্ডার এ দু’টো শ্বব্দকে এক করে দেখা হয়েছে। সেক্স এবং জেন্ডার দু’টো সম্পূর্ণ ভিন্ন শ্বব্দ। সেক্স বলতে নারী-পুরুষের শারীরিক গঠনকেই বোঝায়। আর জেন্ডার বলতে সমাজে নারী-পুরুষের অবস্থানকেই বোঝায়। নারীর অবস্থানের প্রশ্ন এখানেই আসে। সে ক্রীতদাসী না কি তা নির্ভর করে সে নারী অথবা পুরুষের মানসিকতা, তার পারিপার্শ্বিক অবস্থার উপর। সে ক্ষেত্রে সেক্স কোনো বিশেষ ভূমিকে পালন করে না। তাই নারীর মর্যাদা দেবার জন্য দেহবাদিতার প্রয়োজন হয় না। এক্ষেত্রে সমাজের অশিক্ষিত মানুষকে শিক্ষিত করবার প্রয়োজন আছে। তসলিমা নাসরিন”"যৌন-যৌনাঙ্গ ও যোনী”- এ তিনটি শব্ধ বাদ দিয়ে সমাজকে সৃজনশীল লেখা দিয়ে এ অশিক্ষিত জাতিকে শিক্ষার আলোকে , সংস্কারের আলোকে আলোকিত করতে পারেন এবং এ লেখকের কাছে আমাদের এটাই প্রত্যাশা। দ্বিতীয় লেখাটি পরলাম বিয়ে বিষয়ে ওনার মতামত নিয়ে এবং সাথে ওনার লেখা সম্পর্কে পাঠকের মন্তব্য ও পড়লাম । লেখাটি শুরু করেছেন তিনি এ কথা বলে যে মানুষ নির্বিঘ্নে যৌন সম্পর্ক করার ও সন্তান জন্মদেবার জন্যই বিয়ে করেন। মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণী বিয়ে করে না। তাদের মাঝে বিয়ের রীতি নেই। কথাটি সত্যি। কারণ মানুষ ছাড়া তো অন্য কোনো প্রাণী লেখা-পড়া করে না-তারা কিভাবে কাগজ কলমে সাইন করবে? তাছাড়া তিনি কিভাবে জানলেন যে তারা বিয়ে করে না? আমি যতটুকু জানি মানুষ এখনো কোনো প্রাণীর ভাষা বা সংস্কৃতি বুঝতে পারে না। লেখাটি খুব একটা পরিষ্কার না আমার কাছে। কি বলতে চাচ্ছেন এই জনপ্রিয় লেখিকা? তিনি কি বোঝাতে চাচ্ছেন যা কাগজে সাইন না করে যে কয়দিন ভালো লাগে থাক না হয় আবার আরেক জনকে গ্রহণ কর? ঘরে স্বামী-স্ত্রী রেখে সম্পর্ক করছেন গুটি কয়েকজন সবাই না। ইশ্বর ম্যাচমেকার হিসেবে মার খেয়ে গেছেন-এটা আসলে ঠিক নয়। ঈশ্বর যে জোড়া তৈরী করেন তার কাছাকাছি জোড়ার সন্ধান পেলে আমরা সম্পর্কে জড়িয়ে পারি তাই এ অবস্থা বার বার ভুল মানুষের কাছে গিয়ে সব শেষে আমরা সঠিক মানুষকে খুঁজে নেই। তাই তালাকের প্রয়োজন দেখা দেয়। সভ্য দেশ থেকে বিয়ের প্রথা উঠে গেছে। অসভ্য দেশের মানুষ বিয়ে করে এসব জেনেও তসলিমা নাসরিন স্বয়ং কেন চারবার বিয়ের নামক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হলেন? আসলে সম্পর্ক, নারী-পুরুষ এসব নিয়ে তসলিমা নাসরিনের কিছু ভুল ধারণা রয়েছে। বিয়ে মানে কিন্তু কাগজ-কলমে সাইন করা না। এটা মনের বন্ধন, একারণেই অন্য প্রাণীরা যার সাথে মনের মিল হয় আর সাথে লম্বা সময় থাকে। উন্নত বিশ্বেও তাই দীর্ঘদিন থাকে কারণ তাতে আছে বিস্বাস ও ভালোবাসা। এই ভালোবাসাকে সামাজিক স্বীকৃত দেয়ার জন্য মানুষ বিয়ে করে। মেয়েদের অবস্থান এখন অনেক পাল্টে গেছে সমাজে। এখন মেয়ের কয়টা প্রেম ছিল না ছিল তা নিয়ে কেউই আর মাথা ঘামে না। সমাজে সে সময় এখন আর কারো নেই। হ্যাঁ, কিছু ব্যতিক্রম আছে-কিন্তু সমাজ পাল্টে গেছে। সভ্য সমাজ থেকে বিয়ে উঠে যায় নি। কমে গেছে। ট্যাক্স হোক আর যে কারণেই হোক-মানুষ এখনো বিয়ে করে তবে হ্যা বাংলাদেশ অনেক বেশি চাপ এই বিয়ের। দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত বাংলাদেশের একজন অবিবাহিত মেয়েকে বিয়ের কথা শুনতেই হবে। মনে হয় মেয়েদের জন্ম হয় শুধুমাত্র একটা ভালো বিয়ে হবার জন্য। বিয়ে না করলে অথবা না হলে ওই মেয়ের জীবনের কোনো মূল্যই নেই। সে মেয়ে যতোই ভালো কাজ করুক না কেনো? আবার কোনো মেয়ের একাধিক বিয়েতেও সমস্যা, সমাজ কিছু নিয়ম বেধে দিয়েছে, সেটা মেনে চলো না হলে অপ্রয়োজনীয় মানুষের অপ্রাসঙ্গিক কথা শুনে মাথা খারাপ হয়। যদিও অনেকে বলে থাকেন যে এসব কোথায় কান দিও না কিন্তু সমাজ যতক্ষণ এসব কথা কানে না যাবে ততক্ষণ মেয়েটিকে শান্তিতে থাকতে দেবে না। প্রেম, ভালোবাসা ও বিয়ে-এ তিনটি শব্দ সারা বিশ্বে বিরাজ করে। জেন্মের পর থেকে প্রতিটি ছেলে ও মেয়েই তার প্রকৃত ভালোবাসার মানুষকে খোজে, প্রেম-ভালোবাসার সঙ্গা যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়েছে, এমন একটি সময় ছিলো যখন প্রেম আর কাম হতো বিয়ের পর, এখন প্রেম আর কাম না হলে বিয়ে হয় না। বিয়ের পূর্বে শর্তই কাম। দ্বিধা ও দ্বিমত থাকলেও বাঙালি নারী মাত্রই একবার হলেও বিয়ে করতে চায়, চায় সুন্দর সংসার, সন্তান ও স্বামী। সবাই পায় কিনা জানি না তবুও সব মেয়েরই একটি স্বপ্ন থাকে এবং সে স্বপ্ন হচ্ছে তার স্বপ্নের পুরুষের সন্ধ্যান করা। হয়তবা তসলিমা নাসরিন ঠিক বলছেন এমন একদিন আসবে যখন বিয়ে নামক প্রথার বিরুদ্ধে সবাই মুখ খুলবে এবং এটা উঠে যাবে এবং সমাজবিজ্ঞানীরা হয়ত বলবেন যে ‘পৃথিবীতে একটি যুগ ছিল, সে যুগের নাম অন্ধকার যুগ। সেই অন্ধকার যুগে একটি প্রথা দীর্ঘদীর্ঘকাল টিকে ছিল, প্রথাটির নাম বিয়ে’।, এসব বোঝাতে গিয়ে পুরুষতন্ত্রের প্রসঙ্গ উঠবে, তখন নিশ্চয়ই ভবিষ্যতের সেই সব মানুষের গা কেঁপে উঠবে বীভৎস একটা সমাজ কল্পনা করে”।-এটা হতে পারে সত্যি তবে ইউটোপিয়া? নাডিসটোপিয়া তা সময় বলে দেবে। তবে এসব অনেক ছোট ব্যপার। বিয়ে, যৌন, যৌন চাহিদা, জরায়ুর স্বাধীনতা-সমাজে এছাড়া অনেক বিষয় আছে। তসলিমা নাসরিনের মতন একজন বড় লেখক সে সব দিকগুলো তুলে ধরে জাতিকে আলোর দিকে নিয়ে যাবেন বলেই আমার বিশ্বাস। প্রায় দেড় যুগের মতো তিনি স্বেচ্ছায় নির্বাসনে। নিজের কাজের জন্যই আজ তসলিমা নাসরিন নির্বাসনে। ভালো, গঠনশীল কাজের মাধ্যমেই ক্ষণজন্মা এই লেখক আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন-এটাই আমাদের প্রত্যাশা।(ড. তানিয়া হোসেন সহযোগী অধ্যাপক, ওয়াসেদা বিশ্ববিদ্যালয়)

No comments

Powered by Blogger.