গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন এবং তারপর by ড. মাহবুব উল্লাহ্

সাংবাদিকদের ভাষায় গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনটি ছিল একটি হাইভোল্টেজ নির্বাচন। ইদানীং সাংবাদিকরা কোনো বিষয় বা ঘটনার বিশেষ বৈশিষ্ট্য তুলে ধরার জন্য নতুন নতুন বিশেষণ ব্যবহার করছেন। যেমন হাইব্রিড নেতা। এসব বিশেষণের প্রয়োগ কতটা সার্থক ও সঠিক, সেটি ভাষাবিদরাই বলতে পারবেন। তবে এসব শব্দ প্রয়োগের মাধ্যমে বাংলা ভাষার দ্যোতনা যে অনেকটা সম্প্রসারিত হয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন একটি সদ্য গঠিত সিটি কর্পোরেশন। রাজধানী ঢাকা নগরী ক্রমান্বয়ে তার আশপাশের এলাকাগুলোতে সম্প্রসারিত হচ্ছে। এসব সম্প্রসারিত অঞ্চলের মধ্যে গাজীপুর বেশ গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে এর শিল্প-কারখানার জন্য। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনটি আয়তনের দিক থেকে বেশ বড়। এ কর্পোরেশনে ভোটারের সংখ্যা ১০ লাখেরও অধিক। কিছুদিন আগে অনুষ্ঠিত ৪টি সিটি কর্পোরেশনে ভোটারের সংখ্যা সম্মিলিতভাবে ১০ লাখের মতোই ছিল। এ বিচারে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল ও খুলনায় সরকার সমর্থিত প্রার্থীরা বিপুল ভোটে পরাজিত হওয়ার পর গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনটি একটি টেস্ট কেসে রূপান্তরিত হয়। এ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন আরও স্পষ্ট করে জানান দিল, সরকারের গণভিত্তি সত্যিকার অর্থেই নড়বড়ে হয়ে উঠেছে। সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন স্থানীয় সংস্থার নির্বাচন। স্বাভাবিকভাবে এ নির্বাচনে স্থানীয় ইস্যুগুলোরই প্রাধান্য পাওয়ার কথা। কিন্তু সম্প্রতি অনুষ্ঠিত কোনো সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেই স্থানীয় ইস্যু তেমন গুরুত্ব পায়নি। তাই যদি হতো তাহলে বরিশাল, খুলনা, রাজশাহী ও সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ফলাফল ভিন্নতর হতে পারত। বিশেষ করে বরিশাল ও রাজশাহীর ক্ষেত্রে। শুনেছি এ দুটি কর্পোরেশনেই ক্ষমতায় থাকা মেয়ররা তাদের দায়িত্ব পালনকালে নিজ নিজ কর্পোরেশনভুক্ত এলাকায় প্রচুর উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন। কিন্তু সেসব উন্নয়ন তাদের কাক্সিক্ষত বিজয় লাভে কোনো কাজে আসেনি। এ থেকে প্রশ্ন উঠেছে, ভোটের রাজনীতিতে কোন বিষয়টি নির্ধারক ভূমিকা পালন করে- উন্নয়ন না রাজনীতি?
এবারের সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনগুলোতে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল সরাসরি তাদের পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে সমর্থন জানিয়েছে এবং প্রচারাভিযানে অংশগ্রহণ করেছে। এর ফলে সবকিছু ছাপিয়ে এসব সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনের আমেজ লাভ করেছে। এ নিয়ে অনেকে হতাশা ব্যক্ত করলেও এতে দোষের কিছু আছে বলে মনে হয় না। প্রতিবেশী ভারতেও স্থানীয় নির্বাচন রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার রূপ পরিগ্রহ করে। কাজেই গাজীপুরসহ ৫টি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন কার্যত পরিণত হয়েছিল জাতীয় নির্বাচনের রিহার্সেলে।
গাজীপুর এলাকাটি ঐতিহ্যগতভাবে আওয়ামী লীগের এলাকা। বলা হয়ে থাকে, গোপালগঞ্জের পরেই গাজীপুরে আওয়ামী লীগের অবস্থান দ্বিতীয় প্রধান। সেজন্যই কোনো কোনো সংবাদপত্র শিরোনাম করেছিল, আওয়ামী লীগের দুর্গে হানা দিতে চায় বিএনপি তথা ১৮ দলীয় জোট। নির্বাচনী ফলাফলে দেখা গেল বিএনপি তথা ১৮ দলীয় জোট অত্যন্ত সফলভাবে আওয়ামী দুর্গ দখল করেছে। কীভাবে এ দুর্গ দখল সম্ভব হল, সেটাই বিবেচ্য বিষয়। নির্বাচনটি দুটি প্রধান দলের রাজনৈতিক লড়াইয়ে পরিণত হয়েছিল। গত সাড়ে ৪ বছর ধরে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আছে। এ সাড়ে চার বছরের ইতিহাস বহুলাংশে আওয়ামী লীগের জনবিচ্ছিন্ন হওয়ারই ইতিহাস। ২০০৮ সালের ডিসেম্বর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এবং তার জোট ভূমিধস বিজয় লাভ করে। জাতীয় সংসদে তাদের তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে। এ সংখ্যাগরিষ্ঠতাই তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার ফলে আওয়ামী লীগ প্রণোদিত হয়েছে ঔদ্ধত্য, ক্ষমতার দেমাগ, যথেচ্ছভাবে জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দখল, দলীয়করণ ও দুর্নীতিতে লিপ্ত হতো। ক্ষমতায় আসার আগে নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ দিনবদলের স্বপ্ন দেখিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে দিনবদল তো দূরের কথা, বাংলাদেশ বহু যুগ পিছিয়ে গেছে। গুম, খুন, নির্যাতন, নিপীড়ন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের ওপর কারানির্যাতন, রিমান্ডের নির্যাতন এবং ডাণ্ডাবেড়ির নির্যাতন একটি আধুনিক সভ্য সমাজের জন্য কলংক তিলকচিহ্ন হিসেবে প্রতিনিয়ত জনগণকে আওয়ামী লীগের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে মানসিকভাবে প্রস্তুত করেছে। তদুপরি আওয়ামী লীগের অঙ্গ-সংগঠনগুলোর যথেচ্ছাচার এবং দুর্বিনীত আচরণ ভুক্তভোগীদের বীতশ্রদ্ধ করে তুলেছে। এছাড়াও ছিল লাঠি, গুলি, টিয়ার শেল, সাউন্ড গ্রেনেড, পিপার স্প্রেসহ নানাবিধ মারণাস্ত্র এবং মানব নির্যাতনের হাতিয়ারের বহুল প্রয়োগ। সব মিলিয়ে এসব অস্ত্র প্রয়োগের ফলে ডজন ডজন লোক প্রাণ হারিয়েছে অথবা আহত হয়ে প্রতিবন্ধিত্ব বরণ করেছে। কথায় বলে ‘পেটে খেলে পিঠে সয়’। ভয়াবহ মূল্যস্ফীতির ফলে মধ্যবিত্ত, নিুবিত্ত ও গরিব মানুষরা পেটেও খাওয়া পায়নি, পিঠে আর সইবে কীভাবে? রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনের দিক থেকে বর্তমান শাসনপর্ব অতীতের অনেক শাসনপর্বকে বিশালভাবে ছাড়িয়ে গেছে। শাসকগোষ্ঠীর কারও কারও লোভের বলি হয়েছে পদ্মা সেতু প্রকল্পটি।
এসব দুঃশাসন ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলো বিশেষ করে বিএনপি আন্দোলন গড়ে তুলতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের সেই আন্দোলন কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জনে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেনি। কারণ মূল্যস্ফীতি এবং নির্যাতন-নিপীড়নে সন্ত্রস্ত জনগোষ্ঠী আন্দোলন থেকে দূরে অবস্থান করে আত্মরক্ষা করাই শ্রেয় মনে করেছেন। বর্তমানে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ মধ্যবিত্ত। তারাই জনমত গঠনে নেতৃত্ব দেয়। তবে এ শ্রেণীটি আন্দোলনের ঝুট-ঝামেলায় জড়িত হতে ভয় পায়। তাছাড়া জাতীয় অর্থনীতির প্রাণশক্তি এখন প্রাইভেট সেক্টর। খুদে, মাঝারি ও বড়সহ নানা ধরনের ব্যক্তি-উদ্যোক্তাদের নিয়ে এ প্রাইভেট সেক্টর গড়ে উঠেছে। তারাও চায় না আন্দোলন কিংবা প্রতিবাদ করতে গিয়ে তাদের ব্যবসা ও উদ্যোগকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে। এ কারণে বাস্তব পরিস্থিতি থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থান হচ্ছে না। যেমনটি ঘটেছে হাল আমলে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে। এছাড়া বাংলাদেশের মানুষ রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত সচেতন। তারা চায় না রাজনৈতিক আন্দোলন শেষ পর্যন্ত গৃহযুদ্ধে রূপান্তরিত হোক। তারা জানে, ভারতবেষ্টিত বাংলাদেশে গৃহযুদ্ধ হলে সেটি কত ভয়াবহ ও মর্মান্তিক হতে পারে। এসব কারণেই সব বস্তুগত উপাদান থাকা সত্ত্বেও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে কোনো অভ্যুত্থান সংঘটিত হচ্ছে না। কিন্তু জনগণ সবকিছু বোঝে ও জানে। তারা অপেক্ষা করছে তাদের হাতে যে মোক্ষম অস্ত্রটি রয়েছে, যার কোনো সংহারক ক্ষমতা নেই, সেই অস্ত্রটি প্রয়োগ করার জন্য। এটি হল ভোটাধিকার। এ ভোটাধিকার প্রয়োগ করেই জনগণ গাজীপুরসহ পাঁচটি সিটি কর্পোরেশনে নীরব বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে। সুযোগ পেলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তারা অনুরূপ বিপ্লব ঘটাতে পারে।
প্রশ্ন হল, সর্বশেষ পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কী করবে? তারা কি গভীর আÍজিজ্ঞাসায় মনোনিবেশ করবে? তারা কি অবশিষ্ট যেটুকু সময় হাতে আছে সেই সময় যাদের তারা অপমানিত করেছে, আহত করেছে, সর্বস্বহারা করেছে, কষ্ট দিয়েছে- তাদের কাছে টানার চেষ্টা করবে? কিংবা তাদের পিঠে হাত বুলিয়ে বলবে, ‘ভাই, অনেক অন্যায় করে ফেলেছি, মাফ করে দিও, আর কখনও এরকমটি হবে না।’ এ পথে তারা যদি এগোয়, তাহলে দেশে শান্তি ও স্বস্তি অনেকটাই ফিরে আসবে। তাদেরও বেশ লাভ হবে। ভোটের লড়াইয়ে বিপর্যয়ের মাত্রা কিছু হলেও কমে আসবে। কিন্তু অন্য সম্ভাবনাও রয়েছে। সেটা হল, আতংকগ্রস্ত হয়ে আরও মারমুখী হয়ে ওঠা। সেক্ষেত্রে দেশ আরও সংঘাতময় হয়ে উঠবে।
৫টি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ফলাফল এটাও জানিয়ে দিচ্ছে যে, জনগণ নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছে। অথচ প্রধানমন্ত্রী বিদেশ সফরে গিয়ে সেই পুরনো কথারই পুনরাবৃত্তি করলেন। তিনি বললেন, অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতোই বাংলাদেশে নির্বাচন হবে। কিন্তু বাংলাদেশ যে অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতো হয়ে ওঠেনি- এ সত্যটি তিনি উপলব্ধি করতে চান না। যে দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার সংকট রয়েছে, সে দেশে ক্ষমতার পালাবদল হয় যে জাতীয় নির্বাচনে তা পরিচালনার দায়িত্ব কেন দলীয় সরকারের হাতে থাকবে? আওয়ামী লীগ দলীয় নেতারা বলতে চাইছেন, সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনগুলো সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হওয়ার ফলে আগামী জাতীয় নির্বাচনও একইভাবে দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে। কিন্তু তারা যে প্রশ্নটি এড়িয়ে যেতে চান সেটি হল, স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সঙ্গে জাতীয় নির্বাচনের চরিত্রগত পার্থক্য। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে রাষ্ট্রক্ষমতার পরিবর্তন হয় না, কিন্তু জাতীয় নির্বাচনে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পরিবর্তন হয়। সে কারণেই জাতীয় নির্বাচন বাংলাদেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিপ্রেক্ষিতে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই হওয়া উচিত।
গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সরকার বা সরকারি দলের নগ্ন হস্তক্ষেপের ঘটনাও লক্ষ্য করা গেছে। একজন মেয়র প্রার্থীকে যেভাবে প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ডেকে নিয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার আদায় করলেন, সেটা আর যাই হোক গণতান্ত্রিক রীতিনীতির দিক থেকে শুদ্ধ ছিল না। এছাড়া ১৮ দলীয় জোট সমর্থিত মেয়র প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচনের দু’-তিন দিন আগে এনবিআর গৃহীত পদক্ষেপও নির্বাচনী ফলাফলকে প্রভাবিত করার অসৎ উদ্দেশ্যে নেয়া হয়েছিল বলে সাধারণ মানুষের ধারণা। একটি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে যদি এরকম ঘটনা ঘটতে পারে, তাহলে ৩০০ আসনের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আরও অনেক ভয়াবহ ঘটনা যে ঘটবে তার আঁচ-অনুমান করা যায়। সেজন্যই প্রয়োজন সংবিধান সংশোধন করে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান প্রণয়ন। তাহলেই দেশ বড় রকমের সংকটের হাত থেকে রক্ষা পাবে।
ড. মাহবুব উল্লাহ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক

No comments

Powered by Blogger.