সরকারি কর্মকমিশন কতটা স্বাধীন? by ইকতেদার আহমেদ

নির্বাচন কমিশন ও সুপ্রিমকোর্টের অনুরূপ সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি) একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। নির্বাচন কমিশন ও সুপ্রিমকোর্টের সাংবিধানিক পদধারীদের মতো পিএসসির সাংবিধানিক পদধারীরা শপথের অধীন। শপথ পাঠ ছাড়া উপরোক্ত কোনো পদধারীর নিয়োগ কার্যকর হয় না। প্রধান বিচারপতি ছাড়া উপরোক্ত সব সাংবিধানিক পদধারীর শপথ পাঠ অনুষ্ঠান প্রধান বিচারপতি কর্তৃক পরিচালিত হয়। প্রধান বিচারপতির শপথ পাঠ অনুষ্ঠান রাষ্ট্রপতি কর্তৃক পরিচালিত হয়।
পিএসসির সাংবিধানিক পদধারী বলতে কমিশনের সভাপতি (চেয়ারম্যান) ও সদস্যদের (মেম্বার) বোঝায়। অনুরূপ সুপ্রিমকোর্টের সাংবিধানিক পদধারী বলতে প্রধান বিচারপতি এবং আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারকদের বোঝায়। একইভাবে নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক পদধারীদের বলতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের বোঝায়।
পিএসসির সভাপতি ও সদস্যরা শপথ গ্রহণের সময় সুপ্রিমকোর্টের বিচারক এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের মতো অপরাপর বিষয়ের পাশাপাশি ব্যক্ত করেন যে, তারা সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করবেন। দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টের বিচারকদের সম্পর্কে সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে, এ সংবিধানের বিধানাবলি সাপেক্ষে প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারক বিচারকার্য পালনে স্বাধীন থাকবেন। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে, নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবে এবং কেবল এ সংবিধান ও আইনের অধীন হবে। যদিও পিএসসির সভাপতি ও সদস্যদের স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনের বিষয়ে সংবিধানে সুপ্রিমকোর্টের বিচারক ও নির্বাচন কমিশনের অনুরূপ সুস্পষ্টভাবে কিছুই ব্যক্ত করা হয়নি, কিন্তু তাদের স্বপঠিত শপথ দৃষ্টে প্রতীয়মান হয়, স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনে তাদের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ কতজন বিচারক সমন্বয়ে গঠিত হবে এ বিষয়ে সংবিধানে স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। নির্বাচন কমিশনের ক্ষেত্রেও পঞ্চদশ সংশোধনী পূর্ববর্তী কিছু বলা ছিল না। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বলা হয়, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক ৪ জন কমিশনারকে নিয়ে বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকবে। পিএসসির গঠন বিষয়ে সরকারি কর্মকমিশন অধ্যাদেশ, ১৯৭৭-এ বলা হয়েছে, একটি সরকারি কর্মকমিশন প্রতিষ্ঠিত হবে, যা বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন নামে অভিহিত হবে। চেয়ারম্যানসহ সর্বনিু ৬ অথবা সর্বোচ্চ ১৫ জন সদস্য সমন্বয়ে কমিশন গঠিত হবে। সংবিধানে এক বা একাধিক কর্মকমিশন প্রতিষ্ঠার কথা বলা হলেও বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন অধ্যাদেশ, ১৯৭৭ (অধ্যাদেশ নম্বর ঠওওও, ১৯৭৭)-এর মাধ্যমে দুটি সরকারি কর্মকমিশন প্রতিষ্ঠার বিধান করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে ১৯৭৭ সালের খঠওও নম্বর অধ্যাদেশের মাধ্যমে আগের অধ্যাদেশটি বাতিল করে একটি সরকারি কর্মকমিশন প্রতিষ্ঠার বিধান প্রণয়ন করে সদস্য সংখ্যা সর্বনিু ও সর্বোচ্চের ক্ষেত্রে সীমিত করে দেয়া হয়।
পিএসসির সভাপতি ও সদস্যদের মেয়াদ বিষয়ে সংবিধানে বলা আছে, দায়িত্ব গ্রহণের তারিখ থেকে ৫ বছর বা বয়স ৬৫ বছর পূর্ণ হওয়া- এ দুটির মধ্যে যা অগ্রে ঘটে সেকাল পর্যন্ত সভাপতি বা একজন সদস্য স্বীয় পদে বহাল থাকবেন। তাদের অপসারণ বিষয়ে সংবিধানে বলা আছে, সুপ্রিমকোর্টের কোনো বিচারক যেরূপ পদ্ধতি ও কারণে অপসারিত হতে পারেন, সেরূপ পদ্ধতি ও কারণ ব্যতীত সরকারি কর্মকমিশনের সভাপতি বা কোনো সদস্যকে অপসারণ করা যাবে না।
উল্লেখ্য, সুপ্রিমকোর্টের কোনো বিচারক গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগে অভিযুক্ত হলে অথবা শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যরে কারণে দায়িত্ব পালনে অপারগ হলে প্রধান বিচারপতি এবং পরবর্তী কর্মে প্রবীণ দুজন বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল তদন্তপূর্বক যে প্রতিবেদন দাখিল করে, রাষ্ট্রপতি তার ভিত্তিতে অপসারণের আদেশ প্রদান করেন।
পিএসসির সভাপতি ও সদস্যদের অপসারণ পদ্ধতি সুপ্রিমকোর্টের বিচারকদের অনুরূপ হওয়ায় প্রতীয়মান হয়, স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে এটি একটি বড় ধরনের রক্ষাকবচ।
পিএসসিকে সাংবিধানিকভাবে যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তা হল- (ক) প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগদানের জন্য উপয্ক্তু ব্যক্তিদের মনোনয়নের উদ্দেশে যাচাই ও পরীক্ষা পরিচালনা; (খ) রাষ্ট্রপতি কর্তৃক কোনো বিষয় সম্পর্কে কমিশনের পরামর্শ চাওয়া হলে কিংবা কমিশনের দায়িত্ব সংক্রান্ত কোনো বিষয় কমিশনের কাছে প্রেরণ করা হলে সে সমন্ধে রাষ্ট্রপতিকে উপদেশ দান এবং (গ) আইনের দ্বারা নির্ধারিত অন্যান্য দায়িত্ব পালন।
আইন ও বিধিবিধানের অধীনে কমিশনকে সরকারের বিভিন্ন ক্যাডার পদে এবং অধস্তন বিচার বিভাগ ছাড়া অপরাপর বেসামরিক বিভাগ ও কতিপয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের ১ম ও ২য় শ্রেণীর পদের পরীক্ষা পরিচালনা ও প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। কমিশন প্রার্থী বাছাইপূর্বক সরকারের কাছে সুপারিশ পেশ করে থাকে। কমিশনের সুপারিশ প্রদান পরবর্তী পুলিশের গোয়েন্দা শাখা কর্তৃক গোপনীয় প্রতিবেদনে বিরূপ কোনো কিছু না থাকলে রাষ্ট্রপতি বা ক্ষেত্রবিশেষে যথাযথ কর্তৃপক্ষ সুপারিশের ভিত্তিতে নিয়োগ আদেশ প্রদান করে থাকেন। এ পর্যন্ত এভাবেই নিয়োগ আদেশ দেয়া হয়ে আসছিল। কমিশন কর্তৃক নিয়োগ সংক্রান্ত সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্নের পর রাষ্ট্রপতি বা যথাযথ কর্তৃপক্ষ কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে নিয়োগ সংক্রান্ত আদেশ প্রদান করে থাকলে এ নিয়োগ বিষয়ে কোনো মহল থেকে কোনো ধরনের প্রশ্ন উত্থাপনের সুযোগ সীমিত। কিন্তু রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন কোনো ব্যক্তি যদি এমন কিছু বলেন, যা কমিশনের স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসেবে দেখা দেয়, সেক্ষেত্রে কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন এ কথাটি বলার অবকাশ আছে কি?
সম্প্রতি সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথার অবসান বা পুনর্বিন্যাসের দাবিতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আন্দোলনে নেমে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত হলে সরকারের শীর্ষ নির্বাহী তার দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের এক সভায় বলেন, আন্দোলনের নামে যারা ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের সঙ্গে জড়িত, তাদের কেউ চাকরি পাবে না। ছবি ও ভিডিও ফুটেজ দেখে বিসিএস মৌখিক পরীক্ষার সময় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে, অযোগ্য ঘোষণা করা হবে।
সরকারের শীর্ষ নির্বাহীর মুখ থেকে এ কথাটি উচ্চারিত হওয়ার পর দেশের সচেতন মানুষের মনে প্রশ্নের উদয় হয়েছে, মৌখিক পরীক্ষায় কৃতকার্য ও অকৃতকার্য বিষয়ে পিএসসি স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করে থাকে নাকি কোনো কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে করে থাকে? সরকারি কর্মকমিশনের সাবেক একাধিক সাংবিধানিক পদধারীর সঙ্গে আলাপ করে নিশ্চিত হওয়া গেছে, কমিশন সুপারিশ প্রদান-পরবর্তী কোনো উত্তীর্ণ প্রার্থীর বিষয়ে পুলিশের গোপন শাখা থেকে নেতিবাচক প্রতিবেদন পাওয়া গেলে সে প্রার্থীর নিয়োগ কার্যকর করা হয় না এবং এ পর্বটি সব সময় কমিশন কর্তৃক মৌখিক পরীক্ষা সম্পন্নের পর বাছাই সংক্রান্ত প্রতিবেদন সরকারের বরাবরে পেশ করার পর ঘটে থাকে। তাদের অভিমত, সরকারের শীর্ষ নির্বাহী যে বক্তব্য প্রদান করেছেন তাতে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে যে, আন্দোলনকারীদের ছবি ও ভিডিও ফুটেজ দেখে বিসিএস মৌখিক পরীক্ষার সময় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। সরকারের শীর্ষ নির্বাহীর বক্তব্য অনুযায়ী মৌখিক পরীক্ষার সময় পিএসসি যদি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে সেক্ষেত্রে স্বভাবতই প্রশ্ন দেখা দেবে, সরকারের শীর্ষ নির্বাহীর দল ক্ষমতাসীন হওয়ার পর তার দলের ছাত্র সংগঠনের যেসব নেতাকর্মী অগ্নিকাণ্ড, ভাংচুর, লুটতরাজ, হত্যা প্রভৃতিতে জড়িত ছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হবে? এ বিষয়ে কিছু না বলা প্রচ্ছন্নভাবে নিজ দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের এ ধরনের ঘটনা সংগঠনে উৎসাহিত করার নামান্তর নয় কি?
দেশবাসী অত্যন্ত পরিতাপের সঙ্গে লক্ষ্য করেছে, ১৯৯০-পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে পিএসসির সভাপতি এবং ক্ষেত্রবিশেষে কতিপয় সদস্য রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তা বিসর্জন দিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ নিয়োগের মাধ্যমে কমিশনের ভাবমূর্তির ওপর কুঠারাঘাত করেছেন। যদিও সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় নিয়োগপ্রাপ্ত সভাপতি ও সদস্যরা নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে কমিশনের হƒত গৌরব পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট ছিলেন, কিন্তু তাদের বিদায়ের পর অতীতের ধারাবাহিকতার পদধ্বনিই শোনা যায়।
ইতিমধ্যে সরকারের শীর্ষ নির্বাহীর বক্তব্যের জবাবে সরকারের সাবেক শীর্ষ নির্বাহী ঘোষণা করেছেন, কথিতভাবে যাদের মৌখিক পরীক্ষায় অকৃতকার্য করানো হবে, তার দল ক্ষমতায় গেলে তাদের সবার চাকরির ব্যবস্থা করা হবে। সরকারের সাবেক শীর্ষ নির্বাহীর এ ঘোষণা আন্দোলনকারীদের আশ্বস্ত করেছে এবং অনুমিত হয় বিপুল জনগোষ্ঠীর এ আন্দোলন আগামী নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্ধারণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
সুপ্রিমকোর্টের কোনো বিচারকের বিচারিক দায়িত্ব পালন এবং নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে যেমন বাইরের কোনো মহলের কোনো ধরনের হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই, ঠিক তেমন প্রজাতন্ত্রের বিভিন্ন ক্যাডার পদে এবং বিচার বিভাগ ছাড়া সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের ১ম ও ২য় শ্রেণীর পদের পরীক্ষা পরিচালনা ও প্রার্থী বাছাই সাংবিধানিকভাবে পিএসসির একক এখতিয়ারের বিষয়। এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে সরকারের শীর্ষ নির্বাহীসহ পদস্থ কেউ যদি কোনো ধরনের বক্তব্য প্রদান করেন, তা হবে কমিশনের স্বাধীনভাবে দায়িত্বপালনের ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপের শামিল। আর এ ধরনের হস্তক্ষেপ একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও ভাবমূর্তির ভিত্তিমূলে আঘাত হানে। তাই সরকারের শীর্ষ নির্বাহীর পক্ষ থেকে বক্তব্যটি দেয়ার পর দেশবাসী প্রত্যাশা করেছিল, কমিশন হয়তো আনুষ্ঠানিকভাবে বিবৃতি প্রদান করে তার অবস্থান বিষয়ে জাতিকে আশ্বস্ত করবে। কিন্তু এ বিষয়ে কমিশনের নীরবতা জনমানুষের মধ্যে এমন বিশ্বাসের জš§ দিয়েছে যে, কমিশন সরকারের শীর্ষ নির্বাহীর আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে একনিষ্ঠ হয়ে কাজ করছে। আর এভাবে একনিষ্ঠভাবে কাজ করলে কমিশনকে স্বাধীন না বলে অধীন বলাই বোধ করি সমীচীন।
ইকতেদার আহমেদ : সাবেক জেলা জজ ও সাবেক রেজিস্ট্রার, সুপ্রিমকোর্ট

No comments

Powered by Blogger.