বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্বের অধীনতামূলক সম্পর্ক by বদরুদ্দীন উমর

ভারতের পক্ষ থেকে যত না, তার চেয়ে অনেক বেশি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারত-বাংলাদেশ বন্ধুত্বের কথা বলা হয়ে থাকে। বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক অহরহ ভারতকে বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে আখ্যায়িত করে পারস্পরিক বন্ধুত্বের গৌরব প্রচার করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের এই প্রচার সত্ত্বেও দু’দেশের এই বন্ধুত্ব কতখানি বাস্তব ও কার্যকর তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং অন্য নেতারা প্রায়ই বলে থাকেন, ভারত এমন কোনো কাজ করবে না যাতে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মর্মার্থ, ক্ষতি করার ক্ষমতা তাদের আছে কিন্তু মহানুভবতার কারণে বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি তারা করবে না! টিপাইমুখ বাঁধ সম্পর্কে যখনই বাংলাদেশের সরকার ও বিভিন্ন সংগঠন থেকে আপত্তি জানানো হয়, তখন তারা বিশেষ করে এসব কথা বলে থাকেন। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রীর ভারত সফরের সময়েও প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং তাকে সে কথাই বলেছেন।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে নিয়ে অন্য মন্ত্রীর দল এবং সব ধরনের আমলা-ফায়লা জনগণের ট্যাক্সের টাকায় প্রায়ই বিদেশ সফর করে থাকেন, যার অধিকাংশই নিষ্প্রয়োজন এবং আনন্দ ভ্রমণ ছাড়া আর কিছু নয়। মাত্র কয়েক দিন আগে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নিজের বোনঝির বিবাহ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য ৪২ জন সরকারি লোক ও আÍীয়স্বজন নিয়ে সরকারি খরচে লন্ডন গিয়ে বিলাসবহুল হোটেলে থেকে দেশের জনগণের পকেট কেটে কোটি কোটি টাকা খরচ করে এসেছেন। এটাকে তারা চরম দুর্নীতি মনে করেন না। আসলে বাংলাদেশে চুরি, ঘুষখোরি, দুর্নীতি এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে, এসবই পরিণত হয়েছে স্বাভাবিক ব্যাপারে। প্রধানমন্ত্রী ছাড়া অন্য যে মন্ত্রীরা কারণে-অকারণে বিদেশ সফর করেন, তাদের মধ্যে বিদেশমন্ত্রী শীর্ষস্থানীয়। বিদেশ সফরের বিষয়ে তার কোনো নীতিজ্ঞান, কাণ্ডজ্ঞান অথবা প্রয়োজনের বোধ আছে বলে মনে হয় না। কাজেই যে কোনো ছুঁতো ধরে বা ছুঁতো তৈরি করে বিদেশ সফরের তাড়নায় তিনি অস্থির থাকেন। বাংলাদেশে ১৯৭২ সাল থেকে যে লুটপাটের রাজত্ব কায়েম হয়েছে, সেই লুটপাটের ঐতিহ্য এ ধরনের সফরের মাধ্যমেও রক্ষিত হচ্ছে।
বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রী এখন ভারতে গেছেন সেখানকার প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতাদের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি এবং দ্বিপক্ষীয় ভূমি সীমান্ত চুক্তি বিষয়ে আলোচনার জন্য। অবধারিতভাবে বিদেশমন্ত্রীর এই সফর ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু এদের কাছে সফর ব্যর্থ বা সফল হওয়া আসল ব্যাপার নয়। আসল ব্যাপার হল সফর করা। যে বিষয়ে মন্ত্রী ভারত সফরে গেছেন তা নিয়ে অসংখ্যবার আলোচনা হয়েছে এবং এ বিষয়ে ভারত তার সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে আছে। কাজেই এ মুহূর্তে ওই সফর বাংলাদেশের জন্য নিষ্প্রয়োজন। তিস্তা চুক্তি সম্পর্কে ভারতের প্রধানমন্ত্রী সফররত বাংলাদেশী বিদেশমন্ত্রীকে যা বলেছেন, তার মধ্যে নতুনত্ব কিছু নেই। নতুনত্ব যে থাকার কথা নয় এটাও জানা কথা। ভারত-বাংলাদেশ ভূমি সীমান্ত চুক্তি কার্যকর শুধু সরকারি প্রভাব ও সিদ্ধান্তের ব্যাপার নয়। তার জন্য প্রয়োজন ভারতের সংসদের উভয় কক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট। যেহেতু বিজেপি এবং অন্য কয়েকটি দল এর বিরোধী, সে কারণে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের কোনো সম্ভাবনা নেই। কাজেই এই চুক্তি বিষয়ে সরকারি সিদ্ধান্ত একটি বাংলাদেশ ঠকানো ব্যাপার ছাড়া আর কিছুই নয়। বিজেপি এই চুক্তির বিরোধিতা করতে গিয়ে বলেছে, এই চুক্তি হলে ভারতের অধিকৃত ভূমির পরিমাণ কম হবে। এটা ঠিক। কারণ ভারত ইতিপূর্বেই বাংলাদেশের ভূমির অনেকটা অংশ দখল করে রেখেছে। চুক্তির মাধ্যমে সেই দখল ছাড়ার বিষয়টি তাদের কাছে ‘ভারতের ভূমি হারানোর’ ব্যাপার! এই পরিস্থিতিতে কোনো আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই ভারত-বাংলাদেশ ভূমি সীমান্ত চুক্তি সম্পাদনের কোনো সম্ভাবনা নেই। কিন্তু সে সম্ভাবনা একেবারেই না থাকা সত্ত্বেও এ নিয়ে বিদেশ সফরে বিদেশমন্ত্রীর উৎসাহের কোনো অভাব নেই!!
ভারত-বাংলাদেশ বন্ধুত্বের বিষয় নিয়ে প্রথমে কথা শুরু করেছিলাম। এ দুই দেশের বন্ধুত্ব বলতে কী বোঝায় সেটা প্রচার মাধ্যমের ক্ষেত্রে যা ঘটছে তার দিকে তাকালে যত স্পষ্টভাবে বোঝা যায়, এমন আর কোনোভাবে বোঝা যায় না। এদিক দিয়ে টেলিভিশনের বিষয়টি উল্লেখ করা যায়। ভারতের অসংখ্য টেলিভিশন চ্যানেলের দরজা বাংলাদেশের জন্য খোলা রাখা হয়েছে। এদিক দিয়ে তথ্য মন্ত্রণালয়ের উদারতার শেষ নেই। ভারতের সরকারি চ্যানেল ডিডি বাংলা থেকে নিয়ে অসংখ্য ভারতীয় টিভি চ্যানেল এখন বাংলাদেশে অবাধে তাদের প্রোগ্রাম প্রচারের সুযোগ পায়। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, বাংলাদেশের কোনো টিভি চ্যানেলের প্রবেশাধিকার ভারতে নেই! এই হল বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের পরম বন্ধুত্বের নিদর্শন!! এটা যে কোনো তথাকথিত দুই ‘বন্ধু দেশ’ ছাড়াও কোনো দুই দেশের সাধারণ ও স্বাভাবিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সম্ভব, এটা চিন্তা করাই যায় না। সম্ভবত ভারত ও বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোনো দুই দেশের মধ্যে এ ধরনের অসম সম্পর্ক দেখা যায় না। বাংলাদেশের তথ্য মন্ত্রণালয় ও তথ্যমন্ত্রী অনেক লম্বা-চওড়া গালভরা কথা বলে থাকেন, কিন্তু ভারতের সঙ্গে প্রচার মাধ্যমের এই অসম ও হীন সম্পর্কের বিষয়ে তাদের মুখ থেকে কোনো কথা শোনা যায় না। তারা এ নিয়ে ভারত সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি তো দূরের কথা, কোনো কথাবার্তা বলেন- এমন কিছু শোনাও যায় না। দু’দেশের এই সম্পর্ক যে বন্ধুত্বের সম্পর্কের পরিবর্তে দাস ও প্রভুর সম্পর্ক- এ কথা বললে কি সত্যের অপলাপ হয়? অনেক সময় দেখা যায় এখানকার কোনো কোনো সংবাদপত্র সম্পাদক বা কলাম লেখককে ভারতের কোনো কোনো টিভি চ্যানেলের প্রোগ্রাম সম্পর্কে গদগদ ভাষায় লিখতে। কিন্তু ভারতের জনগণ যে বাংলাদেশের কোনো টিভির কিছুই দেখতে-শুনতে পান না, এ নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই! ভারতের জনগণের মধ্যেও বাংলাদেশের টিভি প্রোগ্রাম না দেখা নিয়ে অসন্তোষ আছে। তারা এখানকার প্রোগ্রাম শুনতে চান, কিন্তু ভারত সরকার তাদের ইচ্ছাকে পাত্তা দেয়ার কোনো প্রয়োজন বোধ করে না। বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের জনগণ কিছু জানুক, এটা তাদের অভিপ্রেত নয়! এসব দেখে মনে হয় যে, প্রকৃতপক্ষে ভারত ও বাংলাদেশের পারস্পরিক সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ নয়, শত্র“তামূলক। ভারত নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বের কথা বললেও প্রকৃতপক্ষে প্রত্যেকটি গুরুতর বিষয়ে তারা বাংলাদেশের সঙ্গে শত্র“তামূলক আচরণ করে থাকে। শুধু কেন্দ্রীয় সরকারই নয়, পশ্চিমবঙ্গের সরকার ও তার মুখ্যমন্ত্রী যে বাংলাদেশের কোনো ধরনের বন্ধু নয়, এটা তিস্তা চুক্তির বিরোধিতার ক্ষেত্রে তারা যে অবস্থানে আছে, তার থেকে বড় প্রমাণ আর কী হতে পারে? বাংলাদেশ সরকারের এই ভারতনীতি পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা নেই যতদিন বর্তমান শাসক শ্রেণী এবং তার যে কোনো রাজনৈতিক দল শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকে। ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক প্রকৃতপক্ষে বন্ধুত্বপূর্ণ করার জন্য প্রয়োজন উভয় দেশেই প্রকৃত গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতিষ্ঠা। এই গণতান্ত্রিক সরকারের অর্থ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের জোরে গঠিত সরকার নয়। এর অর্থ এমন সরকার, যারা ধাপ্পাবাজির মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট অর্জনের থেকে জনগণের মৌলিক সমস্যার প্রতি বেশি যতœবান হবে এবং সেই হিসেবে শুধু নিজেদের দেশের জনগণের জন্যই নয়, অন্য দেশের জনগণের স্বার্থও কোনোভাবে যাতে ক্ষুণœ না হয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখবে।
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল

No comments

Powered by Blogger.