ফিরে এল লাক্ষার সোনালি দিন by আনোয়ার হোসেন

একসময় লাক্ষার জন্য চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার সীমান্তবর্তী বর্ধিষ্ণু গ্রাম বিনোদপুরকে বলা হতো ‘সোনার বিনোদপুর’। সেখানকার লাক্ষাচাষিদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে ঈর্ষা করত আশপাশের গ্রামের লোকজন। নানা গল্প প্রচলিত ছিল বিনোদপুরের লাক্ষাচাষিদের ‘টাকার গরম’ নিয়ে। বিনোদপুরে চাষিদের দেখাদেখি পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে ছড়াতে থাকে লাক্ষার চাষ। চাহিদা বৃদ্ধি ও লাক্ষার অপার সম্ভাবনা দেখে ১৯৬১ সালে কৃষি বিভাগ চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলায় ১০০ বিঘা জমির ওপর লাক্ষা বীজের খামার স্থাপন করে। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ১৯৮৫ সালে স্থাপন করে দেশের একমাত্র লাক্ষা গবেষণা কেন্দ্র। কিন্তু চারপাশে আমবাগানে কীটনাশকের ব্যবহার বৃদ্ধি ও লাক্ষা বিপণনের ক্ষেত্রে চোরাচালানের অজুহাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে চাষি হয়রানির কারণে ক্রমে লাক্ষা হারিয়ে যায় বিনোদপুর থেকে। হারিয়ে যায় লাক্ষার সোনালি দিন। অন্যদিকে বরেন্দ্রভূমির রুক্ষ কঠিন মাটিতে নীরবে-নিভৃতে বাড়তে থাকে লাক্ষার চাষ। নাচোলের মাক্তাপুরে বেলাল উদ্দীন, সাদিকুল ইসলাম ও রবিউল ইসলাম এবং কাজলা গ্রামের জহুরুল ইসলাম ও তাঁর সাত ভাই, মজিবুর রহমানসহ আরও কয়েকজনের লাক্ষা চাষে সাফল্যের হাত ধরে আবারও ফিরে আসে লাক্ষা। দুটি গ্রামের ৪০০-৫০০ চাষি এখন সম্পূর্ণভাবে লাক্ষার ওপর নির্ভরশীল। তিন বছর আগে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট নাচোলের মাক্তাপুর ও কাজলাকে ‘লাক্ষা গ্রাম’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে।
লাক্ষা গ্রামে একদিন:
নাচোল উপজেলা সদর থেকে দুই কিলোমিটার দূরে লাক্ষা গ্রাম মাক্তাপুর। গ্রামের সবচেয়ে পুরোনো ও সফল লাক্ষাচাষি বেলাল উদ্দীন। তাঁর ছেলে মো. ইসরাইলও (২৩) বাবার হাত ধরে একজন লাক্ষাচাষি।
লাক্ষা চাষ নিয়ে ইসরাইল বলেন, ‘আগেরবার এক কেজি লাক্ষা বেচ্যা দুই মণের বেশি ধান কিনেছি। এক কেজি লাক্ষার দাম ৫০০ থেকে এক হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত হয়েছে। এবারও এক কেজি লাক্ষার দাম ৫০০ টাকা দিয়্যা শুরু হয়েছে। হামার বাপ একদিন পরের দুয়ারে কাম করতোক। সেই বাপ হামার দোতালা বাড়ি কর‌্যাছে।’বেলাল উদ্দিন জানালেন, এখন নাচোলের ৯০-৯৫ ভাগ বরইগাছেই লাক্ষা চাষ হচ্ছে। টানা ২৫ বছর ধরে লাক্ষা চাষ করলেও কখনো ক্ষতির মুখে পড়েননি। ছিলেন গৃহস্থবাড়ির কামলা। এখন নিজেই সচ্ছল গৃহস্থ। আরেক চাষি সাদেকুল ইসলাম আড়াই বিঘা জমি কিনেছেন, বাড়ি করেছেন।মাক্তাপুরে ছিলেন আগে ৫০ জন লাক্ষাচাষি। এ বছরই আরও ৫০ জন বেড়েছে।নাচোলের আরেকটি লাক্ষা গ্রাম কাজলা। এই গ্রামের প্রায় ২০০ পরিবার লাক্ষা চাষের সঙ্গে জড়িত।
পরিচয় ও চাষ: লাক্ষা একপ্রকার অতি ক্ষুদ্র পোকা ক্যারিয়া লাক্ষা নিঃসৃত রজনজাতীয় পদার্থ। লাক্ষা পোকার ত্বকের নিচে সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা একপ্রকার গ্রন্থি থেকে আঠালো রস নিঃসৃত হয়, যা ক্রমান্বয়ে শক্ত ও পুরু হয়ে পোষক গাছের ডালকে আচ্ছাদিত করে ফেলে। পোষক গাছের ডালের এই আবরণই লাক্ষা বা লাহা নামে পরিচিত।
বরইগাছেই লাক্ষা চাষ সবচেয়ে লাভজনক। প্রতিবছর দুটি মৌসুমে চাষ হয়। একটি কার্তিক মৌসুম অন্যটি বৈশাখ। তবে বৈশাখ মৌসুমে ফলন বেশি। বৈশাখ মৌসুমে চাষ করার জন্য ১৬০ থেকে ১৮০ দিন আগে বরইগাছ ছাঁটাই করতে হয়। ছাঁটাই করা গাছ থেকে বের হওয়া কচি ডালে বীজলাক্ষা কাঠি বেঁধে দিতে হয়। সাত দিনের মধ্যে সেই কাঠি থেকে বীজ ছড়িয়ে পড়ে গোটা গাছে। বৈশাখ মৌসুমে চাষ করার জন্য কার্তিক মাসে বীজ গাছে বাঁধতে হয়। বৈশাখে লাক্ষা তোলার সময় কিছু ডাল রেখে দেওয়া হয় বীজ করার জন্য। এসব ডাল থেকে আষাঢ় মাসে (মধ্য জুনের পরে) লাখ লাখ বাচ্চা লাক্ষা বের হয়। এক ফুট করে বীজ লাক্ষার ডাল কাটা হয়। ৫০টি বীজলাক্ষার ডালকে এক তুড়ি বলে। এক তুড়ি ডাল এক থেকে দেড় হাজার টাকায় বিক্রি হয় লাক্ষা গবেষণাকেন্দ্র থেকে। তবে চাষিরাই বীজলাক্ষা সংরক্ষণ করেন। 
ব্যবহার: লাক্ষার আছে বহুবিধ ব্যবহার। কাঠের আসবাব বার্নিশ করা এবং বিভিন্ন ধরনের পেইন্ট তৈরির কাজে ব্যবহূত হয়। অস্ত্র ও রেলওয়ে কারখানায়, বৈদ্যুতিক শিল্প-কারখানায় অপরিবাহী বার্নিশ পদার্থ হিসেবে, ডাকঘরের চিঠি, পার্সেল ইত্যাদি সিলমোহর করার কাজে, চামড়া রং করা ও স্বর্ণালংকারের ফাঁপা অংশ পূরণে লাক্ষা ব্যবহূত হয়।
লাক্ষা গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোখলেসুর রহমান জানালেন, সাম্প্রতিককালে ওষুধশিল্পের ক্যাপসুলের আবরণ হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। লেবুজাতীয় ফলের সংরক্ষণ গুণ বাড়ানোর জন্য আবরণ হিসেবে, চুইংগাম ও চকলেটের আবরণ হিসেবেও এর ব্যবহার রয়েছে।
বিপণন: ডাল থেকে ছাড়ানো কাঁচা লাক্ষা ভালোভাবে পানিতে ধুয়ে পরিষ্কার করে শুকিয়ে দানা লাক্ষা তৈরি করা হয়। এই দানা লাক্ষাকে কাপড়ের তৈরি পাইপের মধ্যে ঢুকিয়ে আগুনে তাপ দিয়ে বানানো হয় টিকিয়া। এ টিকিয়া বিক্রি হয় বাজারে। কাঁচা লাক্ষা থেকে টিকিয়া প্রক্রিয়াজাতকরণের কারখানা রয়েছে রাজশাহী ও নাচোলে। কারখানার মালিকেরা চাষিদের কাছ থেকে কাঁচা লাক্ষা কিনে নেন।
যে যা বলেন: বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের উপপরিচালক আবুল কালাম আযাদ জানান, বর্তমানে লাক্ষা থেকে যে আয় হয়, তা অন্য কৃষিপণ্যের চেয়ে অনেক বেশি। এক বিঘা জমির ধানে যে আয় হবে, তার চেয়ে বেশি আয় হবে দু-তিনটি বড় বরইগাছে লাক্ষা চাষ করে। এ বছর নাচোলের ৮০ হাজার বরইগাছে লাক্ষা চাষ হয়েছে। ভবিষ্যতে নাচোলসহ বরেন্দ্র অঞ্চলে লাক্ষা চাষ আরও বাড়বে।
প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোখলেসুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের লাক্ষার বার্ষিক চাহিদা ১০ হাজার মেট্রিক টন। অথচ উৎপাদন মাত্র এক হাজার মেট্রিক টন। এর ৪৫ ভাগই উৎপন্ন হয় নাচোলে। বাকি লাক্ষা আসে ভারত থেকে বৈধ ও অবৈধ পথে। লাক্ষার বহুল ব্যবহারের কারণে রয়েছে অপার সম্ভাবনা। বিশ্বে চাহিদার ৭০ ভাগ উৎপাদিত হয় ভারতে। বাকি ৩০ ভাগ লাক্ষা হয় বাংলাদেশ, চীন ও থাইল্যান্ডে।
মোখলেসুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের আবহাওয়া লাক্ষা চাষের উপযোগী। কেবল অতিবৃষ্টি আর অনাবৃষ্টি লাক্ষা চাষে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে যে পরিমাণ বরইগাছ আছে, তাতে লাক্ষা চাষ করলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব।

No comments

Powered by Blogger.