মেহসুদকে ছাড়াও তালেবানরা টিকে থাকবে -পাকিস্তান by জেসন বার্কে

যেসব কারণে পাকিস্তানে বায়তুল্লাহ মেহসুদের উত্থান হয়েছিল, চালকবিহীন বিমান থেকে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে সেসব কারণ দূর করা যাবে না। নতুন বায়তুল্লাহ মেহসুদ এসে শূন্যস্থান পূরণ করবে।
প্রথমত, সনাতন পশতুন উপজাতীয় সত্তার সঙ্গে উগ্র ইসলামী পরিচয় এখানে একাকার। দ্বিতীয় পরিচয়টি তখনই জোরদার হতে দেখা যায়, যখন তা আঞ্চলিক পরিচয়কে বেশি অবলম্বন করে। গাজা উপত্যকায়ও হামাস ফিলিস্তিনি জাতীয়তাবাদ ও বৈপ্লবিক পরিবর্তনকামী ইসলামের প্রতীক ও প্রতিনিধি। পশ্চিম আফ্রিকায় আল কায়েদার যেভাবে শক্তিশালী হয়েছে, তারও কারণ এটিই যে, তারা সত্যিকার বাস্তব পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করছে। ইরাকে তাদের ব্যর্থতার কারণ হলো, তারা স্থানীয়দের দলে টানতে পারেনি। সেজন্য সেখানকার মিসরিয় আল কায়েদা নেতাদের বলতে হচ্ছে যে তারা ইরাকি। কিন্তু তেহরিক-ই তালেবান, পাকিস্তান (টিটিপি) জানে, তারা কারা এবং কোথা থেকে তারা এসেছে। তারা হচ্ছে পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে বসবাসকারী পশতুন। শতবর্ষ ধরে তারা পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে বিভক্ত হয়ে আছে। তাদের এক হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে তালেবান আন্দোলন।
যেখানে এখন তেহরিক ও মেহসুদদের শক্ত ঘাঁটি, ১৯৯৮-৯৯ সালে আমি সেই এলাকাটিতে (এফএটিএ) চষে বেড়িয়েছি। তখন আমি তেমন কোনো সহিংসতা দেখিনি। ২০০১ সালে যখন আফগানিস্তানে বৃষ্টির মতো বোমা বর্ষিত হতে শুরু হওয়ার পর খাইবার অঞ্চলে গেলে চেনা পশতুনরা আমাকে হুশিয়ার করে দিয়েছিল যে, তালেবানদের যুদ্ধ তাদেরও যুদ্ধ। আল-কায়েদা তাতে মদদ জুগিয়েছে। আজও পরিস্থিতি তেমনটাই রয়ে গেছে। জাতিপরিচয়, ধর্ম ও রাজনীতির এই মিশেল আলাদা হতে লেগে যাবে যুগের পর যুগ।
দ্বিতীয়ত, কেন্দ্রশাসিত ফাটা অঞ্চলের ৪০ লাখ মানুষকে পাকিস্তান রাষ্ট্র দীর্ঘদিন কোণঠাসা অবস্থায় রেখেছে। মেহসুদ পাকিস্তানি তালেবানদের নেতৃত্ব দিয়ে এদের এই রাষ্ট্রীয় বঞ্চনার প্রতিকার চাইছিলেন। কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের পশতুনরা পাকিস্তানের অন্য যেকোনো অঞ্চলের চেয়ে শিক্ষায়, অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত দিক থেকে সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী। তাদের পূর্ণ নাগরিক হিসেবেও গণ্য করা হয় না। জাতীয় রাজনীতি ও অর্থনৈতিক জীবনে কোণঠাসা হতে হতে এখন তারা জাতীয় রাজনীতি ও অর্থনৈতিক জীবনের কেন্দ্রে আসবার জন্য লড়াই শুরু করেছে।
তৃতীয়ত, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের সামাজিক জীবনেও তাদের এই প্রান্তিক অবস্থানের প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। প্রকৃতপক্ষে উপজাতীয় যোদ্ধারা হলো সেইসব লোক যারা সাধারণ পরিস্থিতিতে সামাজিক মর্যাদা, সম্পদ ও ক্ষমতার দিক থেকে সবচেয়ে বঞ্চিত। খাইবার এলাকার একজন প্রধান জঙ্গি নেতা মঙ্গল বাগ ছিলেন একজন ট্রাকচালক। সম্প্রতি তালেবানদের সোয়াত দখলের মূল উদ্যোক্তা মোল্লা ফজলুল্লাহ ছিলেন একজন সাধারণ শ্রমিক। বাজাউর ও মোহমান্দ এলাকায় শীর্ষস্থানীয় জঙ্গিরা হচ্ছেন কারিগর, ছোট দোকানদার কিংবা জায়গীর থাকা ধর্মীয় শিক্ষক। গত বছর বাজাউরে আটক জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদ করে করে আমি এসব তথ্য পেয়েছি। বায়তুল্লাহ মেহসুদেরও কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। যত্সামান্য ধর্মীয় জ্ঞানই ছিল তাঁর পুঁজি, কোনো বিষয়েই তাঁর কোনো কর্তৃত্ব ছিল না। অন্য অনেক জঙ্গির মতোই তিনিও এসেছিলেন তুলনামূলকভাবে ক্ষুদ্র একটি উপজাতীয় জনগোষ্ঠী থেকে, যে জনগোষ্ঠী ছিল প্রায় দ্বিগুণ প্রান্তিক।
চতুর্থত, তিন দশক ধরে সিন্ধুর সমতল থেকে শুরু করে মধ্য আফগানিস্তানের উঁচু ভূমি পর্যন্ত এলাকায় ‘দেওবন্দি প্রতিষ্ঠান’ দ্রুত বিস্তার লাভ করছে। এটি কোনো রাষ্ট্র নয়, তা সত্ত্বেও কাগুজে মুদ্রা ও ডাকটিকিট ছাড়া রাষ্ট্রের প্রায় সব ধরনের ব্যবস্থাই সেখানে বিদ্যমান। তারা সেখানে অবৈতনিক বিদ্যালয় ও মসজিদ ভিত্তিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। নানা ধরনের বৈধ-অবৈধ ব্যবসার একটি বড় বাণিজ্যিক খাতও দৃশ্যমান। উপসাগরীয় এলাকায় কিংবা ইসলামি বিশ্বের নানা প্রান্তে কূটনৈতিক যোগাযোগও রয়েছে তাদের। রয়েছে অর্থের আসা-যাওয়া এবং প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো আয় কম নয়। রক্ষণশীল, গ্রামীণ, ধর্মীয় মূল্যবোধের ভিত্তিতে গড়া সংস্কৃতিও ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য। অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, বঞ্চিত, অস্থির ও সংঘাতপূর্ণ জাতিগোষ্ঠীগুলো সেখানে মিলিতভাবে নিজেদের একটি ঠিকানা তৈরির চেষ্টা করছে।
এই সবকিছুকে একত্রে মিলিয়ে দেখলে এটি প্রায় পরিষ্কার যে, চালকবিহীন বিমান হয়তো উপসর্গ দমন করতে পারবে, কিন্তু রোগের কারণগুলো দূর করতে পারবে না। এটিও পরিষ্কার যে সেখানে, খুব দ্রুতই আরেকজন মেহসুদের উত্থান ঘটবে।
গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
জেসন বার্ক: গার্ডিয়ান পত্রিকার সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.