নৃ-জাতিগত থিয়েটারের শক্তি by শুভাশিস সিনহা

‘আদিবাসী’ শব্দটা শুনলেই এমন কিছু যূথবদ্ধ মানুষের কথা মনে পড়বে, যারা কিনা রাষ্ট্রের মূলস্রোত থেকে দূরে আছে, আদি একটা রূপ ও আদিকালের সংস্কৃতি নিয়ে টিকে থাকতে চেষ্টা করছে। এ কথার ভালো-মন্দ দুই-ই আছে। মানুষ হিসেবে সাংস্কৃতিক অক্ষুণ্নতার সুখ যেমন আছে, আবার রাষ্ট্রের হিসাবের বাইরে থেকে যাওয়ার একটা বিচ্ছিন্নতার সংশয়ও জ্বলজ্বলে। আসলে এখানে আদি বা অন্ত বলে কিছু থাকতে পারে না, এটি রাষ্ট্রের ‘জাতি’ বা ‘বাসী’ ধারণার একটি প্রতিক্রিয়া মাত্র। নিজেদের মতো করে জীবনযাপনের সবকিছু থেকেও যা তাদের ‘নেই’, তাকে একমাত্র রাষ্ট্রনৈতিকভাবেই চিহ্নিত করা চলে। আর রাষ্ট্রের বাস্তবতা এখন জাতিগত বাস্তবতার ঊর্ধ্বে বলে আদিবাসী অভিধাটি তাত্পর্যপূর্ণ। রাষ্ট্রেরও একটা মানবিক দায় আছে নিশ্চয়।
সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে আমাদের প্রথম ও প্রধান দাবি, দেশে একটি আদিবাসী থিয়েটার ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আদিবাসী না বলে ‘এথনিক’ বললেই ভালো হয়। অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমরা মনে করি, আদিবাসী থিয়েটার ইনস্টিটিউটের দরকার রয়েছে। আদিবাসীদের এত দাবি থাকতে থিয়েটারই বা কেন! এর উত্তর সহজ ও প্রথাগত, তবে অনস্বীকার্য। ‘থিয়েটার’ তার গত্বাঁধা শব্দের বাইরে অনেক কিছুকে ধারণ করে ও সম্ভাবনার জন্ম দেয়।
এথনিক থিয়েটার বা নৃ-জাতিগত থিয়েটার নিয়ে এখন আমাদের দেশেও অনেক কাজ হচ্ছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ অনেক আগেই এ বিষয়ে সম্পূর্ণ কোর্স অন্তর্ভুক্ত করেছে। প্রয়াত নাট্যকার অধ্যাপক সেলিম আল দীন ও অধ্যাপক আফসার আহমদ এ বিষয়ে বিস্তর শ্রম দিয়েছেন। এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যবিষয়ক বিভাগগুলো এ ধরনের কাজ শুরু করেছে। বিশিষ্ট নাট্যজন মামুনুর রশীদসহ অনেক খ্যাত ও তরুণ নাট্যকর্মী এ থিয়েটারের ধরন-ধারণ নিয়ে ভাবছেন এবং কাজ করছেন। কিন্তু এ চর্চার মধ্য দিয়ে বাংলা নাট্যইতিহাসে ভিন্নমাত্রার সংযোজন ছাড়া কার্যত সেই জনজাতির তেমন কোনো সাংস্কৃতিক বিনির্মাণ ঘটছে বলে মনে হয় না। সে বিষয়ে তাত্ত্বিক বিতর্কের সুযোগ এখানে নেই। মূলধারার প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানকাঠামোর আওতামুক্ত যেকোনো জাতিসত্তার প্রতিটি সাংস্কৃতিক আঙ্গিক বা অনুষঙ্গ কৃত্যমূলক হতে বাধ্য। সেখানে সংস্কার ও বিশ্বাস যেমন আছে, তেমনই আছে জীবনকে দেখার একেবারে অকৃত্রিম ভঙ্গি ও বোধ। অন্তত আদিবাসী বা এ-মতো জনসম্প্রদায়ের থিয়েটার ভাবনায় এ বিষয়টির গুরুত্ব অনেক বেশি।
ভারতের তুলনায় সেখানকার মণিপুর রাজ্যের জনসংখ্যা দশমিকেরও অনেক নিচে। তবু সেখানে সেই জাতিসত্তা টিকে আছে বড় দাগের সব সাংস্কৃতিক প্রত্যয় ও স্বাতন্ত্র্য নিয়ে। একজন ‘মণিপুরি’ রতন থিয়াম বা একজন কানাইলাল হিশনাম তাঁদের সব মিথ ও কৃত্যকে ভেঙে নব্যকালের রূপক ও ভাষা তৈরি করেছেন। সেই জাতির চলমান বিকাশের পথে সেগুলো একেকটি বাঁক বটে। এ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্র তৈরি না হলে ক্ষুদ্র জাতিগুলোর সাংস্কৃতিক ভবিষ্যত্ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
অস্ট্রেলিয়ায় গত বছর বিশাল মাপের যে থিয়েটার কনফারেন্স হয়েছে, সেখানে থিম পয়েন্টই ছিল ‘ইনডিজেনাস থিয়েটার’ এবং সেখানে বলা হয়েছে, ইনডিজেনাস থিয়েটারের নিরন্তর লড়াই ও মুক্তির সন্ধানের মধ্য দিয়েই প্রকৃত থিয়েটার বাঁচতে ও জীবন্ত থাকতে পারে।
আগে তো মূলটি রক্ষা করতে হবে। এরপর এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের চিন্তা। থিয়েটার নিয়ে এত যে কথা এর কারণ, এখনো এই পুঁজির সাম্রাজ্যের যুগে পরিবেশনাগত শিল্প-সংস্কৃতির (পারফর্মিং আর্ট) অন্ধত্ব ও বৈকল্যের কালে থিয়েটারই শ্রমসাধ্য, অ-পুঁজিধন্য, মানুষের সঙ্গে একেবারে খাঁটি ও জীবন্ত সম্পর্কে গ্রন্থিত। থিয়েটারের মধ্য দিয়ে একটি জনগোষ্ঠীর সব ধরনের ভাষা ও ভঙ্গির জীবন্ত প্রকাশ ঘটতে পারে। আর এখনো প্রান্তে প্রান্তে এর কী বিপুল জন ও গণ-উত্সাহ।
তাই দেশে একটি আদিবাসী বা এথনিক থিয়েটার ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা দরকার। সেখানে সেসব জনজাতির ভাবুক, শিল্পী ও কলাকুশলীরা তাঁদের অস্তিত্বধারক সব সাংস্কৃতিক উপাদানের সমকালীন রূপ আবিষ্কারের চেষ্টায় নিরন্তর গবেষণা ও চর্চায় যুক্ত থাকবেন। বিশেষজ্ঞ হিসেবে অবশ্যই থিয়েটারের সুদক্ষ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিত্বরাও সেখানে নিযুক্ত থাকবেন।
এ কাজের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষার থিয়েটারও লাভবান হবে। এ ইনস্টিটিউটের ব্যবস্থাপনায় সরকারি কিংবা বেসরকারি উদ্যোগে ‘আদিবাসী’ বা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় পাঠ্য বিভিন্ন ছড়া, কবিতা ও গল্পের পাশাপাশি অভিনয়মূলক শিক্ষার একটি অতিরিক্ত কোর্স রাখা যেতে পারে। হতে পারে সেটা স্কুল-সময়ের বাইরেও। মানুষের জ্ঞানবিকাশের এই জীবন্ত ও সক্রিয় মাধ্যমের প্রয়োগ বাঙালিদের জন্য ততটা না হলেও ভাষিক সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে মৌলিকভাবে বিপন্ন জাতিসত্তার শিশুদের জন্য একান্ত জরুরি।
এ ছাড়া ঢাকা ও অন্যান্য বিভাগীয় শহরের থিয়েটার কার্যক্রমে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নাট্য-সাংস্কৃতিক দলগুলোর মোটা দাগে অন্তর্ভুক্তি এবং বিশেষ করে ঢাকার থিয়েটার হলগুলোয় বিধি খানিকটা শিথিল সাপেক্ষে প্রতি মাসেই বাংলা ভিন্ন অন্য ভাষার নাট্য বা নাট্যমূলক পরিবেশনার জন্য দিন বরাদ্দ
রাখা দরকার।
shuvashissinha@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.