সদকাতুল ফিতর কেন দেবেন by মাহবুবুর রহমান নোমানি

যাদের ওপর সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব তাদের জাকাত-ফেতরা দেওয়া যাবে না। মা, বাবা, দাদা, দাদি এবং তাদের বাবা-মাকে জাকাত-ফেতরা দেওয়া যাবে না। এভাবে নিজের ছেলেমেয়ে, নাতি-পুতিকে জাকাত-ফেতরা দেওয়া জায়েজ নয়। স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে জাকাত-ফেতরা দিতে পারবে না। ধনী ব্যক্তির নাবালক সন্তান এবং অমুসলিমকে জাকাত-ফেতরা দিলে আদায় হবে না।
সদকাতুল ফিতর আমাদের সমাজে ‘ফেতরা’ নামেই অধিক পরিচিত। দ্বিতীয় হিজরিতে ঈদুল ফিতরের মাত্র দুই দিন আগে রাসুলুল্লাহ (সা.) জনগণের উদ্দেশে খুতবা প্রদানকালে প্রথমবারের মতো সদকাতুল ফিতর আদায়ের নির্দেশ প্রদান করেন। এ সদকার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে রোজার ত্রুটিবিচ্যুতির ক্ষতিপূরণ এবং ঈদের দিন গরিব-অসহায়দের খাবারের ব্যবস্থা করা। এদিন যেন তারা খাদ্য সংকটে কষ্ট ভোগ না করে। এ মর্মে রাসুল (সা.) বলেন, ‘ঈদের দিন ফকির-মিসকিনকে আহারের সন্ধানে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ানো থেকে মুক্তি দাও।’ (দারাকুতনি : ২১৩৩)। আবু দাউদ শরিফের বর্ণনায় রয়েছেÑ ‘ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) সদকাতুল ফিতর আবশ্যক করেছেন রোজা পালনে ত্রুটিবিচ্যুতি, অহেতুক কথা-বার্তা, অশ্লীল কাজ-কর্ম ইত্যাদির ক্ষতিপূরণ এবং গরিব-মিসকিনদের আহারের চাহিদা পূরণস্বরূপ। আমাদের হানাফি মাজহাব মতে সদকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। রোজা রাখতে না পারলেও সদকাতুল ফিতর আদায় করা আবশ্যক।
সদকাতুল ফিতর কার ওপর ওয়াজিব
ঈদের দিন সকালে যার কাছে জাকাত ওয়াজিব হওয়া পরিমাণ অর্থ বা সম্পদ থাকে তার ওপর সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব। তবে জাকাতের নিসাবের ক্ষেত্রে ঘরের আসবাবপত্র, জায়গা-জমিন ইত্যাদি ধরা হয় না। কিন্তু সদকাতুল ফিতরের ক্ষেত্রে অতি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ব্যতীত অন্যান্য আসবাবপত্রের মূল্য ধর্তব্য। সুতরাং সেসব জিনিসপত্রের মূল্য সাড়ে বায়ান্না তোলা রুপার মূল্য পরিমাণ হলে সদকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। সদকাতুল ফিতর নিজের পক্ষ থেকে এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েদের পক্ষ থেকে আদায় করা জরুরি। স্ত্রী ও প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদের ফেতরা দেওয়া বাবার ওপর আবশ্যক নয়। তবে তিনি তাদের পক্ষ থেকে আদায় করে দিলে শুদ্ধ হবে। সদকাতুল ফিতর ঈদুল ফিতরের দিন সুবহে সাদিকের সময় ওয়াজিব হয়। সুতরাং যে সন্তান ঈদের দিন সুবহে সাদিকের কিছু সময় পর জন্মগ্রহণ করেছে তার ফেতরা দেওয়া আবশ্যক নয়। কেননা সে সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব হওয়ার সময় অনুপস্থিত ছিল। হ্যাঁ, ঈদের রাতে জন্মগ্রহণকারী সন্তানের ফেতরা আদায় করতে হবে। কারণ এ সন্তান সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব হওয়ার সময় বাবার সংসারে উপস্থিত।
সদকাতুল ফিতর কী দিয়ে আদায় করবে
রাসুলুল্লাহ (সা.) এর যুগে সাধারণত খেজুর, যব, কিশমিশ, ঘি এবং গম দ্বারা সদকাতুল ফিতর আদায় করা হতো। সুতরাং কেউ যদি এসব খাদ্য দ্বারা সদকাতুল ফিতর আদায় করতে চায়, তাহলে সেই পরিমাণ আদায় করতে হবে, যা নবীযুগে আদায় করা হতো। হাদিসের বর্ণনায় পাওয়া যায়, নবীজির যুগে খেজুর, যব, কিশমিশ এবং ঘি ‘এক সা’ (৩ কেজি ১৮৪ গ্রাম) পরিমাণে দেওয়া হতো। আর গমের ক্ষেত্রে এক সা এবং আধা সা দুই বর্ণনাই পাওয়া যায়। অতএব গম বা আটা দ্বারা ফেতরা আদায় করতে চাইলে ‘আধা সা’ (১ কেজি ৬৬২ গ্রাম) গম, আটা বা তার মূল দিলেই যথেষ্ট হবে। কিন্তু অন্য জিনিসের বেলায় এক সা (৩ কেজি ১৮৪ গ্রাম) খাদ্য বা তার মূল্য আদায় করতে হবে। এ নীতিমালা অনুযায়ী ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে এ বছর ফেতরা নির্ধারণ করা হয়েছে সর্বনিম্ন ৭০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ১ হাজার ৯৮০ টাকা। জাকাত-ফেতরা আদায়ের ক্ষেত্রে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উপকারের প্রতি লক্ষ করে জাকাতযোগ্য সম্পদের মূল্য পরিমাণ অর্থ দান করা উত্তম। এটি ইমাম আবু হানিফা ও তার অনুসারীদের অভিমত। সুতরাং কাপড়, খাদ্য ইত্যাদি দ্বারা জাকাত-ফেতরা না দিয়ে টাকা প্রদান উত্তম।
যাদের সদকাতুল ফিতর দেওয়া যাবে না
যাদের ওপর সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব তাদের জাকাত-ফেতরা দেওয়া যাবে না। মা, বাবা, দাদা, দাদি এবং তাদের বাবা-মাকে জাকাত-ফেতরা দেওয়া যাবে না। এভাবে নিজের ছেলেমেয়ে, নাতি-পুতিকে জাকাত-ফেতরা দেওয়া জায়েজ নয়। স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে জাকাত-ফেতরা দিতে পারবে না। ধনী ব্যক্তির নাবালক সন্তান এবং অমুসলিমকে জাকাত-ফেতরা দিলে আদায় হবে না।
যাদের সদকাতুল ফিতর দেওয়া যাবে
যাদের ওপর সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব নয় তারা জাকাত, ফেতরা, কোরবানির চামড়ার অর্থ এবং সদকার টাকা গ্রহণ করতে পারবে। কারণ তাদেরই শরিয়তে ফকির বা মিসকিন বলা হয়েছে। আপন ভাইবোন, চাচা-চাচি, খালা-খালু, ফুফা-ফুফু, মামা-মামি, শ্বশুর-শাশুড়ি-জামাই প্রভৃতি লোক গরিব হলে জাকাত-ফেতরা দেওয়া যাবে। বরং এতে আত্মীয়তার হকও আদায় হবে। সবচেয়ে উত্তম দ্বীনি প্রতিষ্ঠানে গরিব তালিবুল ইলমদের দান করা। এতে সদকায়ে জারিয়ার সওয়াব পাওয়া যাবে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেছেনÑ ‘দান-খয়রাত ওইসব গরিব লোকের জন্য, যারাা আল্লাহর রাস্তায় আবদ্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে জীবিকার সন্ধান করতে পারে না।’ (সূরা বাকারা : ২৭৩)। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসিরে মারেফুল কোরআনে বলা হয়েছেÑ ‘যারা ধর্মীয় কাজে নিয়োজিত থাকার কারণে জীবিকা উপার্জনের উদ্দেশ্যে অন্য কোনো কাজ করতে পারে না এখানে তারাই উদ্দেশ্য।’
সদকাতুল ফিতর আদায়ের উত্তম সময়
হাদিসের বর্ণনা থেকে বোঝা যায়, ঈদের নামাজে যাওয়ার আগে সদকাতুল ফিতর আদায় করা উত্তম ও মুস্তাহাব। এ মর্মে হজরত ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদের ঈদের নামাজে যাওয়ার আগে সদকাতুল ফিতর আদায়ের নির্দেশ দিতেন।’ (সুনানে তিরমিজি : ৬৭৭)। তবে ঈদের নামাজের আগে সদকাতুল ফিতর আদায় করতে না পারলেও ওয়াজিব রহিত হবে না। বরং অনতিবিলম্বে তা আদায় করতে হবে। পক্ষান্তরে ঈদের রাতের আগে সদকাতুল ফিতর আদায় করলে নির্ভরযোগ্য মতানুসারে আদায় হয়ে যাবে। এমনকি রমজানের শুরুতে আদায় করলেও শুদ্ধ হবে। পুনরায় আদায় করা জরুরি নয়। (তুহফাতুল আলমায়ি : ২/২০৮)।
লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া উসমানিয়া দারুল উলুম, সাতাইশ, টঙ্গী

No comments

Powered by Blogger.