বাংলাদেশের আধুনিক স্থাপত্যের পথিকৃৎ by রবিউল হুসাইন

মাজহারুল ইসলাম
বাংলাদেশের যে স্থপতি সর্বপ্রথম এ দেশে আধুনিক স্থাপত্যের সূচনা করেন তাঁর প্রখর সৃষ্টিশীল মেধা ও দূরদৃষ্টি নিয়ে, তিনি হলেন স্থপতি মাজহারুল ইসলাম। তিনি এ দেশের স্থাপত্য পেশাচর্চার পথিকৃৎ। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পশ্চিম দিকে, বর্তমানের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পাঠাগার এবং চারু ও কারুকলা ইনস্টিটিউটের এ দুটি ভবনই এ দেশের আধুনিক স্থাপত্যশিল্পের প্রথম উদাহরণ; এবং এ দুটি বিশিষ্ট স্থাপত্যকর্মের স্থপতি হচ্ছেন মাজহারুল ইসলাম। তখন তিনি সরকারি চাকরি করতেন। সরকারের অধীনেই ১৯৫৫ সালে নির্মিত এ ভবন দুটি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখলে অবাকই হতে হয়। পরিসরের বিভাজন, উপযোগিতার সঙ্গে উপকরণের সমন্বয় সাধন এবং সর্বোপরি চারপাশে বিরাজমান নৈসর্গের সঙ্গে মেলবন্ধনে এ কাজ দুটি এ দেশের স্থাপত্য জগতের দৃষ্টান্তমূলক মাইলফলক। হয়তো পৃথিবীখ্যাত স্থপতিগুরু লে কর্বুজিয়ের, আলভার আলটুর পরোক্ষ প্রভাব এ কাজে দেখা যেতে পারে, তথাপিও বর্তমান স্থাপত্যশিল্পের যে অবস্থা, সেদিক দিয়ে বিচার করলে ওগুলোর মান উন্নত তো বটেই, বরং দেশের পরিপ্রেক্ষিতে তা একটি ধ্রুপদি উদাহরণ হিসেবে বিরাজ করছে।
স্থাপত্যশিল্পের বেশ কয়েকটি বিষয়ে স্থপতি মাজহারুল ইসলামের নাম সর্বাগ্রে উচ্চারিত হয়ে থাকে, যেমন: তিনি এ দেশের প্রথম আধুনিক স্থপতি ও প্রথম স্থাপত্য পেশাচর্চার পথিকৃৎ তো বটেই, তিনি এ দেশের সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন স্থপতি এবং স্থাপত্য প্রতিযোগিতার বিচারক। তিনি স্থপতি ইনস্টিটিউটের প্রথম সভাপতি। তিনি এ দেশের স্থাপত্যশিক্ষা, বিশেষ করে চর্চার জন্য নবীন স্থপতিদের সম্মুখে পৃথিবীর বিখ্যাত স্থপতিদের কাজের দৃষ্টান্ত রাখার জন্য তাঁদের দ্বারা ভবন নির্মাণের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে সাহায্য করেছিলেন। এই নীরব, আত্মপ্রচারবিমুখ, নিরঙ্কুশ স্থাপত্যশিল্পীর জন্ম ১৯২৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর। ১৯৪২ সালে বিএসসি পাস করে প্রথমে তিনি শিবপুরের রয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে পুরকৌশলে ১৯৪৬ সালে স্নাতক হন। এরপর তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের কনস্ট্রাকশন, বিল্ডিং অ্যান্ড ইরিগেশন বিভাগে প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দেন। এই বিভাগে কর্মরত অবস্থায় স্থাপত্য পেশায় নিয়োজিত হওয়ার জন্য ১৯৫০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগন বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি বৃত্তি নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন এবং ১৯৫২ সালে স্থাপত্যে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৩ সালে দেশে ফিরে জুনিয়র সহস্থপতি হিসেবে পুনরায় সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। এরপর ১৯৫৭ সালে লন্ডনের এ এন্ড এ স্কুল থেকে ট্রপিক্যাল স্থাপত্য বিষয় সম্বন্ধে ডিপ্লোমা নিয়ে আসেন। এরই মধ্যে দেশে তাঁর সেই দুটি পথিকৃৎ ভবন নির্মিত হয়েছে। সে সময় যেহেতু দেশে কোনো উপযুক্ত শিক্ষাপ্রাপ্ত স্থপতি ছিল না, সেহেতু সরকার বিদেশি স্থপতিদের নিযুক্ত করেছিল বিভিন্ন সরকারি ভবনের নকশা করার জন্য। কিন্তু তাঁদের কাজের মান নিম্নস্তরের হতো এবং তাতে আধুনিক স্থাপত্যের কোনো গুণাবলি থাকত না। এই বৈরী পরিবেশে স্থপতি মাজহারুল ইসলামকে একা সংগ্রাম করতে করতে এগোতে হয়েছে এবং ওই দুটি ভবন থেকেই সে সময়ের বিদেশি স্থাপত্যের প্রভাব এখানে অস্বাভাবিক কিছু নয়, কিন্তু পরবর্তী সময়ে অচিরেই তিনি এ প্রভাব কাটিয়ে নিজস্ব স্থাপত্য ধারা প্রয়োগ করে বিশিষ্টতা লাভ করেন; এবং এ দেশের কৃষ্টি, সভ্যতা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির সঙ্গে আধুনিক স্থাপত্য ভাবধারা-সংবলিত নান্দনিকতা, ব্যবহারিকতা ও উপকরণের সার্থক সমন্বয় করতে সফলকাম হন। তিনিই এ দেশে ঐতিহ্যবাহী ইটকে লাইনবন্দী, সরাসরি, উন্মুক্ত পলেস্তারাহীন করে পুরোনো রীতিকে নবতররূপে উপস্থাপন করেন। এ ছাড়া স্থাপত্যে শিল্পকর্ম, যেমন: বিশ্ববিদ্যালয় পাঠাগারের দেয়ালে দেয়ালচিত্র সংযোজন করার প্রস্তাব এ দেশে তিনিই প্রথম বাস্তবায়ন করতে পরামর্শ দেন, যার ফলে আমরা নভেরা আহমেদ ও হামিদুর রহমানের দুটি কাজ সেখানে দেখতে পাই এবং এই শিল্পকর্মে স্থাপত্যশিল্পের সঙ্গে অন্যান্য শিল্পের সার্থক যোগাযোগের প্রথম প্রয়াস বলে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
স্থপতি মাজহারুল ইসলামের সম্পন্ন করা সরকারের বহু স্থাপত্যকর্মের মধ্যে উপরিউল্লিখিত দুটি প্রকল্প ছাড়া অন্য প্রকল্পগুলো সরকারি লাল ফিতার কারণে কোনো দিন বাস্তবায়িত হয়নি। এ নিয়ে সরকারের সঙ্গে তাঁর মনোমালিন্য শুরু হয়। এবং এই কারণে ১৯৫৮ সালে তিনি চাকরি থেকে ছাড়পত্র নিতে আবেদন করেন, কিন্তু সেই পত্র তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান খান কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়। অতঃপর স্থাপত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করার জন্য সরকারি বৃত্তি নিয়ে আমেরিকার ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে যান এবং ১৯৬১ সালে ফিরে এসে আবার সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। এই সময়ে ব্যক্তিগত পর্যায়ে ড. কুদরত-ই-খুদার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ১৯৬২ সালে সায়েন্স ল্যাবরেটরি (বিসিএসআইআর) প্রকল্প প্রণয়ন করেন। তদানীন্তন শাসকগোষ্ঠীর একতরফা অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা লাভের কারণে এদেশে তখন তেমন উল্লেখযোগ্য নির্মাণকার্য চলছিল না। এই অবস্থায় স্থপতি মাজহারুল ইসলাম প্রায় এককভাবে সরকারি স্থাপত্য নির্দেশনামা প্রবর্তনের জন্য চেষ্টা করেন কিন্তু সরকারিভাবে তা অনুমোদিত হয়নি। এ নিয়ে সরকারের সঙ্গে আবার বিরোধ বাধে এবং ১৯৬৭ সালে তিনি সরকারি স্থপতির পদ থেকে সম্পূর্ণরূপে পদত্যাগ করেন। পরে এ সময়ই প্রখ্যাত প্রকৌশলী শেখ মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সঙ্গে মিলে বাস্তুকলাবিদ নামে একটি স্থাপত্য উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান গঠিত করে স্থাপত্য চর্চা শুরু করেন। এই বাস্তুকলাবিদই এদেশের প্রথম স্থপতি পরিচালিত পেশাভিত্তিক স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান। কিছুদিনের মধ্যে স্থপতি ইসলামের পরিচালনায় এই প্রতিষ্ঠানটি তদানীন্তন সমগ্র পাকিস্তানে উন্নত স্থাপত্য শিল্পকর্মচর্চার প্রধান প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং এদেশে স্থাপত্যচর্চ ও পেশাকে একটি সম্মানজনক শৈল্পিক পেশা হিসেবে তাঁর প্রখর ব্যক্তিত্য, রুচি, দেশপ্রেম, কাজের প্রতি প্রগাঢ় নিষ্ঠা, পরিপূর্ণ সততা, শৃঙ্খলা, নান্দনিক বিন্যাস ইত্যাদিসহকারে প্রতিষ্ঠিত করেন।
ইতিমধ্যে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য অনুষদে প্রাতিষ্ঠানিক স্থাপত্য শিক্ষা শুরু হয়েছে এবং সবে স্নাতক ডিগ্রিপ্রাপ্ত অনেক নবীন স্থপতি হাতে-কলমে কাজ শেখার জন্য স্থপতি ইসলামের বাস্তুকলাবিদ প্রতিষ্ঠানে কর্মরত হন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই আজ স্বনামধন্য স্থপতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছেন। বাস্তুকলাবিদ প্রতিষ্ঠার পর অনুপম স্থাপত্যগুণ সংবলিত বহু ভবনের নকশা করেন তিনি। তখন ১৯৬৪-৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্টস বিভাগের উত্তরে নিপা ভবন, ১৯৫৫ সালে মতিঝিলে কৃষি ভবন, ১৯৬৫-৬৮ সালে জীবনবীমা ভবন (টাওয়ার বাদে), ১৯৬৬ সালে মিরপুরের রোড রিসার্চ ল্যাবরেটরি প্রকল্পের ভবনসমূহ এবং অসংখ্য বসবাস গৃহের পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। স্থপতি ইসলাম ও তাঁর বন্ধু বিখ্যাত আমেরিকার স্থপতি টাইগারম্যানের যৌথ উদ্যোগে ১৯৬৫ সালে বাংলাদেশের পাঁচটি শহর যথা বরিশাল, পাবনা, রংপুর, সিলেট ও বগুড়াতে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট প্রকল্পের ভবনসমূহের নকশা করেন। তিনি ১৯৬৪-৬৮ সালে নতুন প্রস্তাবিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১৯৬৯-৭০ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্প দুটির মহাপরিকল্পনা ও বিভিন্ন নকশা প্রণয়ন করেন যা তাঁর স্থাপত্য জীবনের অন্যতম প্রধান উল্লেখযোগ্য কীর্তি বলে বিবেচিত। যদিও বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই দুটি বিশ্ববিদ্যালয় বিশেষ করে জাহাঙ্গীরনগরের কাজ থেকে তাঁকে অজ্ঞাত কারণে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এ ছাড়া যৌথভাবে স্থপতি আলমগীর ও ইয়াফেস ওসমানের সঙ্গে জয়পুরহাট চুনাপাথর প্রকল্পের আবাসিক ভবনের নকশাও স্থপতি ইসলাম প্রণয়ন করেন যা বাংলাদেশ আমলে বাস্তবায়ন হয়।
এখন ভাবলে অবাক লাগে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে যে স্থপতি এত ব্যস্তভাবে কাজ করে গেছেন, এ সময় তাঁর হাতে কোনো কাজ নেই। প্রশ্ন জাগে, এর কারণ কী? তৃতীয় বিশ্বের সংবেদনশীল বুদ্ধিজীবীরা বাস্তব জীবনে একটু সফল হলেই তাঁরা এই অভাগা দেশের অবহেলিত জনগণের মৌলিক চাহিদার দাবিতে খুব সংগত কারণেই বিবেকের তাড়নায় সোচ্চার হন, যা আবার শাসকগোষ্ঠীর পছন্দ নয় এবং এই শাসকগোষ্ঠী আবার জনগণের পছন্দ নয়। তাই স্বাভাবিকভাবেই জনগণ-সমর্থিত শিল্পী-স্থপতিরা সরকারের কাজ পান না এবং এভাবে তাঁরা নিজেদের পেশাচর্চার ক্ষতি করেন। অন্যান্য উন্নত দেশে এ ধরনের স্থপতিদের কোনো দৈনিক দায়বদ্ধতা থাকে না। উপরন্তু তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন জাতীয় বুর্জোয়ারা। তাই তাঁদের কোনো অসুবিধা হয় না। সরকারের পাশাপাশি আরও একটি বেসরকারি জনগণ সমর্থিত ধারা বয়ে যায় যার প্রচলন হওয়া আমাদের দেশে অচিন্তনীয় এবং অসম্ভব, যেহেতু এরাও শাসক সমর্থক, তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই মাজহারুল ইসলামের মতো স্থপতিরা কর্মহীন থাকেন, যা আমাদেরদেশ ও জাতির জন্য দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কিছু নয়।
স্থাপত্যকর্ম ছাড়াও স্থপতি মাজহারুল ইসলাম এদেশের উপযুক্ত স্থাপত্য শিক্ষার সঠিক প্রসার ও শিক্ষার্থীদের জন্য উপযুক্ত স্থাপত্য পরিবেশ নির্মাণে এবং স্থাপত্য পেশার সুষ্ঠু আন্দোলন গঠনে সচেষ্ট হন। স্থাপত্য শিক্ষাকে একটি স্বাধীন স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে বাস্তবায়ত করার জন্য স্থপতি ইসলামের উদ্যোগে ১৯৫৯ সালে ফোর্ড ফাউন্ডেশনের সাহায্যক্রমে জাতীয় শিক্ষা কমিশনের আমন্ত্রণে পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শক্তিশালী দল ঢাকায় উচ্চমানের স্থাপত্য শিক্ষার প্রচলনের সম্ভাবনা যাচাই করতে আসেন। কিন্তু তাঁর সে চেষ্টা সফল হয়নি। ১৯৬৬ থেকে ’৬৮ পর্যন্ত তিনি ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্প উপদেষ্টা ছিলেন। তাঁর প্রস্তাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলনায়তন, একাডেমিক ভবন ও কিছু আবাসিক ভবন নকশা করার জন্য পৃথিবী বিখ্যাত আমেরিকান আধুনিক স্থপতি, তাঁর শিক্ষক এবং তৎকালীন ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য অনুষদের প্রধান পল রুডলফকে মনোনীত করা হয়। এই ভবনগুলো আমাদের দেশের আধুনিক স্থাপত্যের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
১৯৫৯ সালে পাকিস্তানের লাথিয়াগলিতে গভর্নর্স কনফারেন্স গৃহীত তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে দ্বিতীয় রাজধানী নির্মাণের যে প্রস্তাব আনা হয় তার বাস্তবায়নে ১৯৬৪ সালে তদানীন্তন কেন্দ্রীয় পূর্তমন্ত্রী মরহুম ফজলুল কাদেরচৌধুরী ইসলামাবাদে নিয়ে গিয়ে স্থপতি ইসলামকে সরাসরি ওই দ্বিতীয় রাজধানীর পরিকল্পনা ও নকশা করতে অনুরোধ জানান। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিজে না করে মন্ত্রীকে তিনি কোনো পৃথিবীখ্যাত স্থপতি দ্বারা পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন করতে অনুরোধ জানান। মন্ত্রী সম্মতি প্রকাশ করেন এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতেই বর্তমানের শেরেবাংলা নগরের পরিকল্পনা বিশ্ববিখ্যাত আমেরিকান স্থপতি লুই কান দ্বারা সম্পন্ন হয় যা বিংশ শতাব্দীতে নির্মিত স্থাপত্যগুণ-সংবলিত বিশটি শ্রেষ্ঠ ভবনগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি বলে স্বীকৃত। প্রকৃতপক্ষে স্থপতি মাজহারুল ইসলাম এদেশের আধুনিক স্থাপত্যে বিদেশি শ্রেষ্ঠ স্থপতিকৃত সৃষ্টকর্ম বাস্তবায়নে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে সচেষ্ট হয়েছিলেন এই মনে করে যে তরুণ স্থপতিদের সম্মুখে ভবিষ্যতে এই ভবনগুলোর উন্নত উদাহরণ এবং চিরকালের জন্য তাদেরপ্রেরণা ও সুস্থ স্থাপত্যের মূল উৎস হয়ে থাকবে। তাঁর এই প্রচেষ্টার পরোক্ষ অবদান আমাদের নবীন স্থপতিদের মধ্যে অপরিসীম। স্থাপত্য সংগঠক হিসেবেও তিনি তার স্থাপত্য ধারণায় শক্তিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি যখন তদানীন্তন পাকিস্তানি স্থপতি ইনস্টিটিউটের সভাপতি ছিলেন সে সময় ১৯৬৮ সালে ঢাকায় প্রথমবারের মতো দেশের সব স্থপতি কর্তৃক একটি সেমিনার খুব সফলভাবে অনুষ্ঠিত হয়।দেশে প্রকৌশলী, পরিকল্পক ও স্থপতিদের সুস্থ ও সঠিক পেশাচর্চার দিকনির্দেশনা ও বিভিন্ন দিক নিয়ে সেখানে আলোচনা হয়। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময়ে পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত দেশের মতো স্থাপত্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় নামে একটি পৃথক মন্ত্রণালয় গঠনের জন্যও তিনি বহুদিন ধরে কাজ করেছেন এবং এই প্রস্তাবের গুরুত্ব স্থাপত্য জগতে অপরিসীম বলে বিবেচিত। যদি কোনো দিন কালক্রমে এটির বাস্তবায়ন হয় তবে তা স্থপতি ইসলামের স্বপ্ন ও দূরদৃষ্টির সার্থকতা প্রকাশ করবে।
স্থপতি মাজহারুল ইসলাম এদেশের একমাত্র আন্তুর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন স্থপতি ছাড়াও একজন স্থাপত্য বিচারকও। দেশি-বিদেশি বহু আন্তর্জাতিক স্থাপত্য প্রতিযোগিতার তিনি অন্যতম বিচারক হিসেবেও তাঁর বিচক্ষণতার প্রমাণ দিয়েছেন। ১৯৮০-৮১ সালে সৌদি আরব সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রধান ভবন এবং আগাখান শীর্ষক স্থাপত্য প্রতিযোগিতার অন্যতম প্রধান বিচারকের ভূমিকা পালন করেন। আমাদের দেশের জাতীয় স্মৃতিসৌধের নকশা-নির্বাচনেও তিনি মুখ্য ভূমিকা রাখেন। স্থপতি ইসলাম শুধু স্থপতি শিক্ষা, পেশা, সংগঠন এবং আন্দোলনে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি, তিনি নবীন ও উৎসাহী স্থপতি এবং ছাত্রদের নিয়ে সব শিল্পমাধ্যমের সৃষ্টিশীল শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, প্রত্নতাত্ত্বিক, ভূগোলবিদ, ইতিহাসবিদদের সমন্বয়ে ‘চেতনা’ নামে একটি পাঠচক্রও গঠন করার মূলে অবদান রেখেছেন। স্থাপত্য শিল্প ক্রমান্তর জটিল ও পরিবর্তনশীল। সামপ্রতিক স্থাপত্য বিশ্বে কী পরিবর্তন, উন্নয়ন এবং পরিবর্তন ঘটছে; বিষয়, দর্শন ও উপকরণ নিয়ে নিজের দেশের ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য সম্বন্ধে জানা ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়ে সম্যক ধারণালাভের উদ্দেশ্যেই এই পাঠচক্র। স্থপতি ইসলামের প্রেরণা, উৎসাহ ও নবীন স্থপতিদের অদম্য উদ্দীপনা, কার্যক্ষমতা ইতিমধ্যে সুধীমহলে ‘চেতনার’ কার্যক্রম বিশিষ্টতা অর্জন করেছেন। বাংলাদেশের এই পথিকৃৎ স্থপতিকে যেমন কর্মবিহীন করে রাখা হয়েছে অথবা বলা যায় বর্তমানের অসুস্থ স্থাপত্য পেশা ও স্থপতি নির্বাচনের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে নিজেকে খাপ খাওয়ানোর অপারগতায় অপরাধী করে রাখা হয়েছে, এদেশে পদক কিংবা স্বাধীনতা পদক বা সামাজিক কোনো সম্মানেও তাঁকে ভূষিত করা হয়নি, কিন্তু যা ভাবতে অবাকই লাগে। দেশের বাইরে সমপ্রতি স্থপতি মাজহারুল ইসলাম সামগ্রিকভাবে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের স্থাপত্য চেতনা বিকাশে অপরিসীম অবদান রাখার জন্য ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টসের পশ্চিমবঙ্গ শাখা কর্তৃক বিশেষভাবে সম্মানিত হয়েছেন। সম্মাননাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে যে এই সম্মান তাঁকে দেওয়া হয়েছে আধুনিক স্থাপত্যের মূলধারার সঙ্গে দেশজ বা আঞ্চলিক রীতির মেলবন্ধনে, স্থাপত্যশিল্পে উপযোগিতা ব্যবহারিকতার সঙ্গে উপাদানরীতি উপকরণ কৌশলের সার্থক সমন্বয় সাধনে তাঁর নিরলস সংগ্রাম ও প্রচেষ্টার অপূর্ব অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে। এই প্রথমবারের মতো অন্যান্য দেশের পৃথিবীখ্যাত স্থপতিদের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো স্থপতি স্থাপত্য জগতের এ রকম একটি দুর্লভ ও আন্তর্জাতিক সম্মানে বিভূষিত হলেন। এই সম্মান স্থপতির জন্য তো বটেই, সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের মুখও সহস্র গুণ উজ্জ্বল করেছে।
বাংলাদেশের আধুনিক স্থাপত্যের পথিকৃৎ প্রবীণ স্থপতি মাজহারুল ইসলাম এদেশের স্থাপত্য জগতের ইতিহাসে তাঁর নীরব, দৃঢ় ও নান্দনিক ঐতিহ্যময় অবদানের জন্য চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

No comments

Powered by Blogger.