মুসলিম নাম নিয়ে বেড়ে ওঠা, আমি এসব কাহিনী জানি by লায়লা খান

নয়া দিল্লিতে একটি মুসলিম নাম নিয়ে বেড়ে ওঠায় নাজিয়া ইরামের ‘মাদারিং এ মুসলিম: দি ডার সিক্রেট ইন আওয়ার স্কুলস অ্যান্ড প্লেগ্রাউন্ড’ আমাকে অবাক করেনি। ইসলামফোবিয়ার ঘটনা নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার এবং আমরা যারা এসবের শিকার হই, সহজেই বুঝতে পারি। ইরামের বইটির সবচেয়ে বড় অর্জন হলো, যারা এসব সহজে বুঝতে পারে না কিংবা এমনকি এসবের অস্তিত্ব আছে বলে কল্পনাও করে না, তাদের কাছে প্রামাণ্যভাবে তুলে ধরা। আর তিনি এ বইটির মাধ্যমে ভারতীয় সাহিত্যের একটি বড় শূন্যস্থান পূরণ করা শুরু করলেন।
তিনি কেবল একটি বিশেষ বদ্ধমূল ধারণার দিকেই মনোযোগ আকর্ষণ করেননি, বরং সেইসাথে তার গবেষণা প্রমাণ করেছে, সমস্যাটি ব্যাপক পরিসরে বিদ্যমান, এলিট স্কুল ও শিশুদের মধ্যেও তা বিরাজ করছে। বইটিতে যেসব স্কুলের কথা বলা হয়েছে, আমি নিজে তার একটিতে ছিলাম। ফলে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, বইটিতে অতিরঞ্জিত কিছু বলা হয়নি। তিনি যেসব গল্প বলেছেন, সেসব গতিশীল ও শক্তিশালী।
ইরাম তার বইতে ইসলামফোবিয়ার নানা মাত্রা নিয়ে আলোচনা করেছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, স্কুলে এক মুসলিম ছাত্রকে যখন তার ক্লাসমেটরা একটি সন্ত্রাসী হামলা নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করল, তখন তিনি শিক্ষকের নীরবতা, ওই মুসলিম শিশুটির ভয়, ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর স্কুলের মনোভাবে পরিবর্তনের ব্যাপারে তার মা-বাবার উপলব্ধিও তুলে ধরেছেন।
এসব ঘটনা সাধারণভাবে স্বীকার করে নেওয়া হয় না। বিশেষ করে মুসলিম স্কুলের অনুপস্থিতি তাদের সমস্যা প্রকট করে তোলে। মুসলিম ছাত্রের সংখ্যাই কেবল কম নয়, মুসলিম শিক্ষকের সংখ্যা আরো কম। সমস্যা আরো জটিল হয়ে যায়, মুসলিম শিশুরা তাদের কষ্টের কথা অন্য ছাত্রদের সাথে শেয়ার করতে না পারায়। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্য হিসেবে এসব প্রতিষ্ঠানের সামনে হাজির হতেও সমস্যায় পড়ে মা-বাবারা।
অনেক ক্ষেত্রে বিভাজন বাড়িয়ে দেয় খোদ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোই। উদাহরণ হিসেবে ভুপালের স্কুলগুলোর কথাই বলা যায়। সেখানকার স্কুলগুলোতে ছাত্রদের সংস্কৃত ও উর্দু বেছে নিতে বলা হয় ছাত্রদের। গ্রহণ করা ভাষার ভিত্তিতে শাখা ভাগ করা হয়। মুসলিম ছাত্ররা উর্দু নেয়, অমুসলিমরা নেয় সংস্কৃত।
ইরাম জানিয়েছেন, এসব স্কুলে উর্দু শাখাগুলোর সাথে ‘গোলযোগ সৃষ্টিকারী ছাত্র’ ও ‘খারাপ ছাত্রদের’ জুড়ে দেওয়া হয়। এ কারণে আহমদ সমির সংস্কৃত শাখায় ভর্তি হয়। স্কুলের একেবারে প্রথম দিন শিক্ষিকা তার সুপরিচিত ছন্দে রোলকল শুরু করেন। কিন্তু তার নামের কাছে এসেই তিনি থমকে যান। তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আহমদ, তুমি কি সংস্কৃত শাখায়?’ সে যখন বলে, জি। তখন তিনি বলেন, ‘ভালো,… খুব ভালো।’ ইরাম বলেন, শিক্ষিকা সমিরের সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানান। কিন্তু রোল কলের মাঝামাঝিতে বিরতি দেওয়াটা ছিল আরো বড় সঙ্কেত। তা হলো সমির হলো বহিরাগত, ক্লাসের অন্য ছাত্রদের মতো নয়। কথাটা তাকে বারবার স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়।
তবে ইরাম কেবল সমস্যার কথাই তুলে ধরেননি, অনেক সমাধানের সুপারিশও করেছেন। তিনি ইতিবাচক থাকার কথা বলেছেন। সেইসাথে বৈষম্যের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’, ‘বিশ্বাসের প্রতি আঘাতের ব্যাপারে সচেতন’ থাকতে বলেছেন, নানামুখী নেতৃত্ব তৈরি করতে বলেছেন।
মুসলিমবিদ্বেষ ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর বাড়ার কয়েকটি উদাহরণ বইতে তুলে ধরা হয়েছে। জারিন সিদ্দিক জানিয়েছেন তার সাড়ে ছয় বছরের মেয়ে সামিরা মুসলিম হওয়ার কারণে স্কুলে কিভাবে নির্যাতিত হয়েছে।
একই বেঞ্চে বসা এক ছাত্র তাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘তুমি মুসলিম?’ সামিরা হ্যাঁ জবাব দিলে সে জানায়, ‘আমি মুসলিমদের ঘৃণা করি।’
জারিন বলেন, তার বড় সন্তান একই স্কুলে কয়েক বছর পড়েছে। সে কখনো এ ধরনের সমস্যায় পড়েনি। গত কয়েক বছরে এ ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে।
এমনকি স্কুলে নয়, মুসলিম নামের কারণে রাস্তায় চলাচলে পর্যন্ত সমস্যা হয়। তিনি জানান, তিনি উবার চালকদের তার নাম বলেন না। বাসে-ট্রেনে তারা এখন মুসলিম পরিচিতিসূচক পোশাক পরে চলাচল করতে গেলে সন্ত্রস্ত্র থাকেন।
এই সমস্যা দূর করার জন্য দরকার সম্মিলিত দায়দায়িত্ব। এ ব্যাপারে প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে সমস্যাটি স্বীকার করে নেওয়া। আর তা হতে হবে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে। তখনই সমাধান বের করা সহজ হয়ে পড়বে।
ইরামের বইটি ব্যাপকভাবে পঠিত হওয়া দরকার। এটি প্রত্যেকের দরজায় কড়া নাড়া ইসলামফোবিয়ার বিষয়টি সামনে নিয়ে এসেছে। ভারতকে নিমজ্জিত করতে শুরু করা গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য এটি একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ও সাহসী পদক্ষেপ।
লেখিকা: নয়া দিল্লিতে বেড়ে ওঠেছেন, পড়াশোনা করেছেন। এখন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াহয়োর ওবেলিন কলেজের আন্ডারগ্রাজুয়েট

No comments

Powered by Blogger.