গণহত্যার শিকার রোহিঙ্গা সংখ্যালঘু সম্প্রদায় by ফ্রান্সিস বুলাতসিঙ্ঘালা

রোহিঙ্গা মুসলিমদেরকে (তারা মিয়ানমারের মোট জনসংখ্যার চার শতাংশ) বিশ্বের সবচেয়ে বন্ধুহীন হিসেবে অভিহিত করা হয়, বিশ্বজুড়ে তাদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা বর্তমান সময়ে তথাকথিত ‘মানবাধিকার’ কতটা তামাশার বস্তুতে পরিণত হয়েছে, তাই দেখাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সরকারের ভয়াবহ সহিংসতা আমাদের সামনে আরো দেখাচ্ছে যে যারা একসময় নির্যাতিত হয়েছিল, তারা অবশেষে মানবাধিকারের প্রবক্তা হবে, এমনটা নিশ্চিত নয়। এ ব্যাপারে উদাহরণ হলেন স্টেট কাউন্সিলর (প্রধানমন্ত্রীর সমতুল্য) আং সান সু চি। একসময় তিনি মিয়ানমারের সামরিক জান্তার হাতে নির্যাতিত হয়েছিলেন। সামরিক স্বৈরাচারের হাতে নির্যাতিত সু চি ১৯৯১ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছিলেন।
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর পরিচালিত নির্যাতন নিয়ে অনেক কিছু লেখা হয়েছে। এসব লোক যে বর্বরতার শিকার হয়েছে, তারা যে অসহায় অবস্থায় থাকতে বাধ্য হয়েছে, তা বিশ্বের সচেতনতায় এখনো প্রবেশ করেনি। এ দিক থেকে শ্রীলঙ্কার প্রবীণ সাংবাদিক লতিফ ফারুক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। অর্ধ শতাব্দির পেশাজীবনে তিনি মানবতার সেবায় নিয়োজিত হয়েছেন। আর তা করেছেন সাংবাদিক এবং ১৯৭০-এর দশক থেকে মধ্যপ্রাচ্যে সম্পাদক ও গ্রন্থকার হিসেবে। তার বইগুলো তার জন্মস্থান শ্রীলঙ্কায় (তিনি বর্তমানে এখানেই বাস করেন) মুসলমানদের জন্য অবশ্য পাঠ্য। তার সর্বশেষ গ্রন্থ হলো ‘দি জেনোসাইড অব রোহিঙ্গা মাইনোরিটিস’। এতে রোহিঙ্গা জনসাধারণ নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোর পাশাপাশি বিশ্লেষণও স্থান পেয়েছে।
ফারুক প্রায় ৩০ বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যের সংবাদ সংস্থাগুলোর সাথে জড়িত ছিলেন। ১৯৭৬ সালে তিনি নতুন করে ইংরেজি ভাষার গালফ নিউজে কাজ শুরু করেন, পরে সাত বছর খালিজ টাইমসে কাজ করেন। ১৯৮৭ সালে আবার গালফ নিউজে যোগ দেন। ২০০৩ সালে দেশে ফিরে তিনি ৫টি বই লিখেছেন: ওয়ার অন টেরোরিজম – দি আনটোল্ড ট্রুথস, নোবডিস পিপলস; দি ফরগোটেন প্লাইট অব শ্রীলঙ্কান মুসলিমস, আমেরিকাস নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার; এক্সপোর্টিং ওয়ার্স। আর তার সর্বশেষ গ্রন্থ হলো দি জেনোসাইড অব রোহিঙ্গা মাইনোরিটিস। তার গ্রন্থটি মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ডা. মাহাথির মোহাম্মদ, নোবেল পুরস্কারজয়ী হ্যারল্ড পিন্টার, নোবেলজয়ী তাওক্কুল কারমান, আমেরিকান সাংবাদিক পল ক্রাইগ রবার্টসের প্রশংসা পেয়েছে।
ফারুক বিশেষ করে বিশ্বজুড়ে মুসলিমসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর দিকে নজর দেন তার গ্রন্থগুলোতে। অবহেলার শিকার কিংবা অযৌক্তিক যেসব অভিযোগ তাদের ওপর আনা হয়, সেগুলো অপনোদন করেন। পরাশক্তিগুলোর সম্পর্ক মুসলিমদের ওপর কী প্রভাব ফেলছে, তার ওপরও আলোকপাত করেন তিনি। রোহিঙ্গাদের নিয়ে তার বই লেখার কারণ হলো তিনি রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারে যে নৃশংসতা চালানো হয়েছে, সেব্যাপারে বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন। এর মধ্যেই তার একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ হলো, তিনি নিজের খরচে বই প্রকাশ করে বিনামূল্যে বিতরণ করে চলেছেন।
দি জেনোসাইড অব রোহিঙ্গা মাইনোরিটিস গ্রন্থে তিনি ১৯৪৮ সাল থেকে মিয়ানমারে মুসলিমরা যে খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সে দিকে আলোকপাত করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, ১৯৭৫ সাল থেকে রোহিঙ্গাদের ওপর ১৩বার সামরিক অভিযান চালানো হয়েছে। তারা অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ আর ভূমি দখলের শিকার হয়েছে। তিনি আরো জানিয়েছেন, মিয়ানমারে মুসলিমরা বাস করছে সেই প্রথম খ্রিস্টাব্দ থেকে।
রোহিঙ্গাদের ইতিহাস ও পরিক্রমা নিয়ে প্রায় দেড় শ প্রতিবেদন সমৃদ্ধ গ্রন্থটি মিয়ানমার ও বাংলাদেশে বসবাসরত রাষ্ট্রহীন এই জনগোষ্ঠীটির দুর্দশার মূল কারণ অনুসন্ধান করেছে। এতে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের ওপর বর্তমানে যে জাতিগত শুদ্ধি অভিযান চালানো হচ্ছে, তার পেছনে রয়েছে ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন। এতে রোহিঙ্গাদের অবৈধ অভিবাসী হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এরা এসেছে ব্রিটিশ উপনিবেশ আমলে, তারা মূলত বাঙালি। বইটিতে রোহিঙ্গাদের আবাসিক বিদেশী হিসেবে চিহ্নিত করে তাদেরকে দুই সন্তানের বেশি গ্রহণ করতে না দেয়া, সরকারি অনুমোদন ছাড়া অন্য কোথাও যেতে না দেয়ার মতো ঘটনাও তুলে ধরা হয়েছে।
মিয়ানমারের বৌদ্ধ ও রোহিঙ্গা মুসলিমদের মধ্যকার অতি সাম্প্রতিক প্রক্সি যুদ্ধে ২০১৬ ও ২০১৭ সালে ১০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গার নিহত হওয়ার কথা তুলে ধরা হয়েছে। আরো আছে ২০১৭ সালে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের গণ-অভিবাসন। তাছাড়া ২০১৫ সালে মিয়ানমারের মুসলিমমুক্ত নির্বাচনের কথাও বলা হয়েছে।
রোহিঙ্গাদের ওপর দীর্ঘ দিন ধরে নির্যাতন চললেও বিশ্ব কেন এ দিকে নজর কেন দিচ্ছে না, সে ব্যাপারেও আলোকপাত করা হয়েছে বইতে। রোহিঙ্গা প্রশ্নে জাতিসঙ্ঘের প্রতিক্রিয়া, রোহিঙ্গাদের ক্ষুধা নিয়ে জাতিসঙ্ঘ প্রতিবেদনও তুলে ধরা হয়েছে এতে।
দি জেনোসাইড অব রোহিঙ্গা মাইনোরিটিস বইটির পাঠক এতে থাকা তথ্যে আতঙ্কিত হবেন। বিশেষ করে গার্ডিয়ানের যে প্রতিবেদনটি এখানে পুনঃমুদ্রিত করা হয়েছে, তাতে শিউরে উঠার মতো তথ্য রয়েছে। মিয়ানমার সরকারের অনুরোধে জাতিসঙ্ঘ বিশ্বখাদ্য কর্মসূচির প্রতিবেদন প্রত্যাহার করার ঘটনাও প্রকাশ করা হয়েছে। পুরো বইতেই এমন এক বিশ্বের ছবি ফুটে ওঠেছে যেখানে মানবাধিকার কার্যত প্রহসনে পরিণত হয়েছে। এতে দেখানো হয়েছে, একমাত্র যে অধিকার আছে তা হলো জুলুমতন্ত্র। কায়েমি স্বার্থবাদী আর শক্তিশালীদের রক্ষা করার ব্যবস্থাই আছে বিশ্বজুড়ে।
বইটির একটি প্রতিবেদন প্রথম প্রকাশ পেয়েছিল ইন্টার প্রেস সার্ভিস নিউজ এজেন্সিতে। লিখেছিলেন তালিফ দিন। তিনি দেখিয়েছেন যে রাশিয়া, ইসরাইল ও চীনের সামরিক সম্ভার পেয়েই মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী বেপরোয়া হয়ে পড়েছে।
বইয়ের প্রতিবেদনগুলোতে একটি বিষয় পরিষ্কার। তা হলো, মিয়ানমারের ধর্ম বৌদ্ধ মতবাদে অহিংসার কথা বলা হলেও সন্ন্যাসী বিরাথু বৌদ্ধের সহানুভূতি, সহমর্মিতার কথা প্রচার করছেন না। তিনি মিয়ানমারের মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রচার করছেন।
এই গ্রন্থটি বৌদ্ধধর্মকে সত্যিকারের অর্থে জানে, এমন কোনো বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পড়েন, তবে মিয়ানমারের সন্ন্যাসী অশ্বিন বিরাথুর প্রচার করা গণহত্যা পড়ে খুবই কষ্ট পাবেন। এই সন্ন্যাসী তার ক্যারিয়ারের প্রায় ৫০ বছর ধরে প্রচার করে আসছেন যে রোহিঙ্গা মুসলিমেরা ‘কুকুর’ ও ‘সাপ।‘ তিনি রোহিঙ্গা মুসলিমদেরকে মাগুর মাছ হিসেবেও অভিহিত করেছেন। তার মতে, এসব মাছ যেমন দ্রুত বৃদ্ধি পায়, অন্যান্য প্রজাতিকে সমূলে শেষ করে দেয়, পরিবেশকে ধ্বংস করে দেয়, রোহিঙ্গারাও তেমন করে। ফারুক নিজে শ্রীলঙ্কার লোক হওয়ায় দেশটিতে বৌদ্ধ চরমপন্থীদের উত্থানের পরিণতি সম্পর্কে অবগত। বিরাথু নিজে ২০১৪ সালের মাঝামাঝি সময় শ্রীলঙ্কা সফর করেছেন। ওই সময়ের দিকে মুসলিমবিরোধী দাঙ্গার সৃষ্টি করেছিলেন শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধ সন্ন্যাসী গনানসারা থেরো। তিনি কুখ্যাত বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী সংগঠন বদু বালা সেনার (বিবিএস) সাধারণ সম্পাদক।
বইয়ের একটি প্রতিবেদনে নিকো হিনেসের অভিযানের কথাও বলা হয়েছে। এতে বর্ষীয়াণ এই মুভি পরিচালকের ক্যামেরায় জঙ্গলে বিরাথুর অপকর্মের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। তিনি দুজন সহকারী, ডিজিটাল ক্যামেরা নিয়ে জঙ্গলে ঢুকেছিলেন বিরাথুর ভয়াবহ কর্মকাণ্ড সচিত্রভাবে তুলে ধরার জন্য। তার ক্যামেরায় এত দিন লোকচক্ষুর অগোচরে থাকা অনেক কথাই প্রকাশিত হয়েছে।
বইটিতে আবেগগত এমন অনেক ভাষ্য দেয়া আছে যার ফলে কয়েকটি অধ্যায় পাঠ করাই অসম্ভব হয়ে পড়ে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর যৌন সহিংসতার ভাষ্য স্নায়ুকে বিকল করে দেয়। এই যৌন সহিংসতার রেশ ধরেই ২০১৭ সালে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। পালিয়ে আসা লোকজন সাথে করে ভয়াবহ নির্যাতনের নানা কাহিনীও সাথে করে নিয়ে আসে। এসব কাহিনীর ভয়াবহতা যেকোনো লোককে নাড়া দিয়ে যায়।
এই বইটি পাঠ করার সময়ই সশস্ত্র গ্রুপ আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) সৃষ্টির নেপথ্য কাহিনী উঠে আসে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে সক্রিয় এই গ্রুপটি। মিয়ানমার সরকার অভিযোগ করছে, বিদেশী ইসলামপন্থীরা আরসাকে তহবিল দিচ্ছে। কিন্তু মিয়ানমার সরকার বুঝতে চাচ্ছে না যে নির্যাতনের কারণেই এই গ্রুপের সৃষ্টি।
বইটিতে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের একটি প্রতিবেদনও সংযোজন করা হয়েছে। এতে উত্তর রাখাইনকে রোহিঙ্গা মুসলিমশূন্য করার মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
লতিফ ফারুকের বইটি গবেষকদের জন্য একটি আদর্শ উদাহরণ হতে পারে। বিভিন্ন ক্যাম্পে অসহায়ভাবে অবস্থান করা লাখ লাখ রোহিঙ্গা সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে এই গ্রন্থে। বইতে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গণহত্যার শেষ ধাপটি শেষ হলেও তাদের দুর্ভোগ কিন্তু শেষ হয়নি এবং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী অবিচারের মুখে পড়ার জন্য বিশ্বও অপরাধী।

No comments

Powered by Blogger.