প্রযুক্তির প্রভাবে মন্দা বাংলাদেশের ‘চটি উপন্যাসের’ বাজার by শফিক রহমান

‘যদি এই বাস্তবধর্মী উপন্যাসটি পড়ে বর্তমান যুব সমাজ সামান্যতমও জ্ঞান লাভ করে সেই মতো চলার প্রেরণা পায়, তবে নিজেকে ধন্য মনে করব।’ এমন দাবি ও প্রত্যাশা বাংলাদেশের বহুল বিক্রিত বইয়ের (উপন্যাস) লেখক কাসেম বিন আবুবাকারের। তার প্রথম উপন্যাস ‘ফুটন্ত গোলাপ’ এর ভূমিকায় তিন এ কথাগুলো লিখেছেন। যে উপন্যাসটিতে তিনি নির্মাণ করেছেন ইসলামী আদর্শ ও হুকুম-আহকাম মেনে চালা এক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রী ও একই ভাবাদর্শে বিশ্বাসী এক ছাত্রের প্রেম-বিবাহ ও সংসার জীবনকাহিনী। গল্পের ভাঁজে ভাঁজে আবার রেখেছেন বন্ধুদের সঙ্গে বন্ধুদের কূট-কৌশলে বিরহ, বিচ্ছেদ অতপর মিলন…।
কাসেম বিন আবুবাকার ‘ভিন্ন ধারার’ লেখক। ওই পথে তিনি পৌঁছেছেন লাখ লাখ পাঠকের কাছে। ১৩৬ পৃষ্ঠার ফুটন্ত গোলাপেরই ৩২তম সংস্করণ শেষ। কাজ চলছে পরবর্তী সংস্করণের। বইটির প্রকাশক এবং নূর-কাসেম পাবলিশার্সের স্বত্বাধিকারী মো. সায়ফুল্লাহ খাঁন বলেন, পাঠকের কাছে বইটি ‘অঘোষিত পাঠ্যবই’ (স্কুল-কলেজের পাঠ্যবই বুঝাচ্ছেন)।
দেশের পুস্তক প্রকাশনা ও বিক্রির বড় মোকাম হিসেবে পরিচিত পুরান ঢাকার বাংলাবাজার কেন্দ্রীক প্রকাশনী সংস্থা ‘সাহিত্যমালা’ ১৯৮৬ সালে বইটি প্রথম প্রকাশ করে। ১০ বছর কপিরাইট মেয়াদ শেষে ১৯৯৬ সালে প্রাকশনার দায়িত্ব পায় নূর-কাসেম পাবলিশার্স। সায়ফুল্লাহ খাঁন জানান, ১৯৯৭ সাল থেকে তিনি ৩২টি সংস্করণ শেষ করেছেন। বিক্রি করেছেন কয়েক লাখ কপি। আগের হিসাব তার জানা নেই।
তবে শুধু ‘ফুটন্ত গোলাপ’ই নয় বাসর রাত, বালিকার অভিমান, বিদেশী মেম, বিদায় বেলায়, বিলম্বিত বাসর, অবশেষে মিলন, প্রেম যেন এক সোনার হরিণ, একটি ভ্রমর পাঁচটি ফুল, সংসার সুখের হয় রমনীর গুণে, আমিও মানুষ, তুমিও মানুষ, শ্রেয়সী এবং ক্রন্দসী প্রিয়াসহ শতাধিক উপন্যাস লিখেছেন কাসেম বিন আবুবাকার। এর মধ্যে বিদেশী মেম উপন্যাসটির চলছে ১৭তম সংস্করণ, ক্রন্দসী প্রিয়া’র ১৬তম, বাসর রাত’র ১৪তম এবং বিদায় বেলায়’র ১১তম সংস্করণ। একটু পুরনোর মধ্যে সবচেয়ে কম সংস্করণ ‘শবনম’ শিরোনামের উপন্যাসটির। সেটিরও পঞ্চম সংস্করণ বাজারে।
বর্তমানে ৮১ বছর বয়সী এই লেখকের ধারায় আরও লিখছেন অনেকে। যুক্ত হয়েছেন তার ছেলে সায়ফুল্লাহ খাঁনও। পুস্তক প্রকাশনার পাশাপাশি তিনি লিখছেন গল্প-উপন্যাস। বাজারে তার বই ১৫টি। ২০০১ সালে প্রকাশ হয় তার প্রথম উপন্যাস ‘প্রথম প্রেম’। বর্তমানে ১০৩ পৃষ্ঠার ওই বইটির দ্বাদশ সংস্করণ বাজারে। বইটিরও হাজার পঞ্চাশেক কপি বিক্রি হয়েছে বলে জানান সায়ফুল্লাহ খাঁন। তিনি বলেন, লেখার মধ্যে আমরা সহজ ভাষায় গল্প বলি। পাঠক তৈরি করি। পরবর্তীতে তারা যাতে সিরিয়াস গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ পাঠে আগ্রহী হয়।
তাদের এ ধারায় আরও সহজ করে বর্তমানে যারা ‘উপন্যাস’ লিখছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন মো. আকাশ চৌধুরী (বকুল), মো. আরিফুল ইসলাম (আরিয়ান), মো. আবু ইউসুফ (সৌরভ), মো. কহিনূর ইসলাম (শিশির), ফরহাদ হাসান সবুজ, মো. কামরুল হাসান, খোরশেদ আলম, মোস্তাক আহমেদ, শুভশ্রী নুপুর, সুমনা আক্তার সুমী, এমডি মুরাদ, এম এ কালাম। বাহারি নামে এবং বলিউড, ঢালিউড (ঢাকাইয়া চলচ্চিত্র) এবং টালিউডের (কলকাতার চলচ্চিত্র) বিখ্যাতসব নায়িকাদের ছবি দিয়ে প্রচ্ছদ সাজানো তাদের ওই লেখাগুলো ‘চটি উপন্যাস’ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু অশ্লীল নয়। তবে বিষয় মূলে ‘কিশোর প্রেম’।
এদের মধ্যে এম এ কালামের ২০০৪ সাল থেকে লেখা ২১টি উপন্যাসের মধ্যে তৃতীয় উপন্যাসটিরই নাম ‘প্রিয়া এখন অন্য কারো’। বলিউড অভিনেত্রী ভূমিকা চাওলার ছবি নিয়ে প্রচ্ছদ সাজানো ৪৮ পৃষ্ঠার বইটিতে গল্প এঁটেছেন স্কুল পড়ুয়া কিশোর-কিশোরীর প্রেম কাহিনী। কাহিনীতে প্রেম নিবেদন পর্যায়ে গল্পের মূল চরিত্র প্রিয়ার ভাইয়ের হাতে বেদম পিটুনি খায় আশিক। আশিকের বয়ানে তখন লেখক এম এ কালাম ছন্দ মিলিয়ে লিখছেন, “জাল যখন পুকুরে ফেলেছি, মাছ আমি ধরবো। মাইর যখন খেয়েছি প্রিয়াকে আমি ভালোবাসবো”।
গল্পের ধারাবাহিকতায় আশিকের প্রস্তাবে সাড়া মিললেও প্রিয়ার বিয়ের আয়োজন হয় আরেক জনের সঙ্গে। আবার আশিকের জবানে লেখক লিখছেন, “হায়রে ভালোবাসা, একজন কাঁদে আরেক জন সুখের ঘর বাঁধে। এর নাম কি ভালোবাসা”। লেখক আরও লিখছেন, “এভাবে শেষ হয়ে যায় একটি প্রেমের নিষ্ঠুর…কাহিনী, প্রিয়া এখন অন্য কারো।”
বর্তমানে এ ধারার লেখকদের প্রতিনিধিত্ব করছেন এই এম এ কালামই। যিনি স্কুল-কলেজের শিক্ষা সহায়ক বইয়ের (বাংলাদেশে যা গাইড বই হিসেবে পরিচিত) প্রকাশনী সংস্থা অবস্মরনীয় পাবলিকেশন্সের বিক্রয় প্রতিনিধি। পেশার পাশাপাশি এসব বই লিখছেন, আবার নিজের প্রকাশনী সংস্থা ‘কালাম বুক হাউজ’র ব্যানারে অন্য লেখকদের বই প্রকাশও করছেন। বাংলাবাজারের আলী রেজা মার্কেটের সাগর বুক ডিপোর সামনে একটি ব্যানারে ঝুলছে এম এ কালামের ছবি সস্বলিত বিজ্ঞাপন। লেখা রয়েছে, ‘এম এ কালাম- এই প্রজন্মের প্রতিভাবান তরুণ লেখক’। তিনি জানান, তার প্রথম উপন্যাস ‘প্রথম দেখায় তোমাকে আমি ভালোবেসেছি’ আর দ্বিতীয় উপন্যাস ‘এই জীবনে তোমাকে ভালোবেসে পেলাম না’।
বাজারে খুঁজে পাওয়া এই ধারার আরও কিছু ‘উপন্যাসের’ মধ্যে রয়েছে সুমনা আক্তার সুমীর ‘দুফোটা চোখের জল’, শুভশ্রী নুপুরের ‘বড় বেশি ভালোবাসি তোমাকে’, ফরহাদ হোসেন সবুজের ‘ভালোবাসা হলো সংসার হলো না’, মো. কামরুল হাসানের ‘স্বার্থপর ভালোবাসা’, নুরুজ্জামান শেখ সোহাগের ‘কণ্ঠের মাধুর্যে প্রেম করা ভুল’, মো. আকাশ চৌধুরী বকুলের ‘না বলা ভালোবাসা’, মো. আরিফুল ইসলাম আরিয়ানের ‘শুধু তোমার জন্য’ এ এম সোহাগের ‘এই মন তোমাকে দিলাম’ এবং মো. আবু ইউসুফ সৌরভের ‘ভালোবাসার শেষ নেই’।
তবে সম্প্রতি বাজার অনুসন্ধানে জানা গেছে, নামে এমন আকর্ষণীয় ও বাহারি হলেও বর্তমানে বিক্রিতে মন্দা এসব ‘চটি উপন্যাসের’। আগে যেখানে বাংলাবাজারের সোহেল বুক ডিপো, তানিয়া বুক ডিপো, হিমু প্রকাশনী, মনিহার বুক ডিপো, একতা প্রকাশনী, শরীফ বুক ডিপো এবং সাগর বুক ডিপোসহ বেশ কয়েকটি প্রকাশনা সংস্থা এসব ‘চটি উপন্যাস’ প্রকাশ ও বিক্রির সঙ্গে যুক্ত ছিল। সম্প্রতি বাংলাবাজার খুঁজে শুধু সাগর বুক ডিপোতে উপরে উল্লেখিত লেখকদের বইকয়টি পাওয়া গেছে। সাগর বুক ডিপোর কর্ণধার সাগর হোসেন বলেন, এসব বই এখন আর চলে না। কেউ প্রকাশও করে না। সপ্তাহ খানেক হলো ১০ কপি করে কয়েকজন লেখকের বই উঠিয়েছি। প্রতি কপি বইয়ের দাম ১৫ টাকা। কিন্তু এক কপিও বিক্রি হয়নি।
২০১০ সালের দিক থেকে মন্দার এ ধারা শুরু হয়েছে বলেও জানান সাগর হোসেন। কারণ হিসেবে তিনি দায়ি করেন ইন্টারনেট, ফেসবুক, ইউটিউবকে। এসব বইয়ের আগের বাজার চাঙ্গার কথা জানিয়ে এই প্রকাশক ও বিক্রেতা বলেন, “গফ্ফার হোসেন নামের একজন লেখক ছিলেন। ২০০১ সালে তার লেখা ‘কেউ বুঝেনা দুঃখ আমার’ এবং ‘আমি ভুল করেছি ছাত্রজীবনে তোমাকে ভালোবেসে’ শিরোনামের দুইটা বই আমি প্রকাশ করেছিলাম। বই দুইটির কয়েক লাখ কপি বিক্রি হয়েছে। ২০০২ সালে প্রকাশ করেছিলাম জালিশ মাহমুদ সাগরের ‘চোখ যে মনের কথা বলে’। এই বইটিরও অনেক সাড়া পেয়েছিলাম। এর আগে ১৯৯৫ সালের দিকে হাফিজ লাইব্রেরী প্রকাশ করেছিল এম ডি মুরাদের ‘হৃদয় দেবে কি দেবে না’। ওই সময়ে এই বইটিও অনেক সাড়া জাগানো বই ছিল।”
মজার বিষয় হলো সেই এম ডি মুরাদ এখনও লিখছেন। সাগর বুক ডিপোতেই পাওয়া গেল তার উপন্যাস ‘প্রেম দেবে কি দেবেনা’। কিন্তু এবার আর সাড়া জাগছে না। জানা গেছে, ওই সময়ে পাঠক প্রিয় লেখকদের তালিকায় আরও ছিলেন- সোহেল রানা, আবু হানিফ, হুমায়ুন কবির মৃধা, চঞ্চল চৌধুরী ও এইচ এম আলম হৃদয়। সোহেল রানার আলোচিত বই ‘অনেক স্বপ্ন ছিল তোমাকে নিয়ে’।
কালাম বলেন, লেখকের অভাব নেই। পুরনোদের জায়গায় নতুনরা এসেছেন। কিন্তু পাঠকেরই অভাব। মোবাইল, ইন্টারনেট, ফেসবুক ও ইউটিউব সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। মাত্র একটা ক্লিকেই সবাই পেয়ে যাচ্ছেন দুনিয়ার সব বিনোদন। আমাদের বই পড়ে বিনোদনের যুগ বুঝি শেষ হয়েই গেল।
শহরের ফুটপাতে হকারদের বসায় কড়াকড়ির কথাও তুলে ধরেন এম এ কালাম। তিনি জানান, গ্রাম-গঞ্জে স্কুল-কলেজ পড়ুয়াদের মধ্যে আমাদের পাঠক ছিল। এছাড়া শহরাঞ্চলের বিশেষ করে ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামসহ যেখানে যেখানে গার্মেন্টস শিল্প কারখানা রয়েছে ওইসব এলাকার শ্রমিকদের আসা যাওয়ার রাস্তার ফুটপাতে বিক্রি হতো এসব বই। এখন ফুটপাতে বিক্রিও কমে গেছে।
ফলে ‘প্রযুক্তি’ যার প্রভাবে পাঠক পেয়েছে ভিন্ন স্বাদের পথ, তাতে সমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে এদেশের আদি একটি অধ্যায়ের। প্রশ্ন হচ্ছে, কালাম, মুরাদ, নুপুর ও সূমীরা কি খুঁজে নিতে পারবে নতুন কোন পথ?

No comments

Powered by Blogger.