অন্ধকার গলি থেকে সন্তানকে রক্ষার পণ by মোহাম্মদ ওমর ফারুক

অন্ধকার পল্লীতেই জন্ম হাজেরার। এখানেই শিশু থেকে যুবতী হওয়া। মায়ের পথ ধরেই হাজেরা হাঁটতে শিখে যৌনপল্লীর অন্ধকার গলি। শত পুরুষের মন জয়ের হাতিয়ার হয়ে উঠে। এভাবেই কেটেছে জীবনের চল্লিশটি বছর। এখন হাজেরা দুই সন্তানের মা। এক ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়ের বয়স বারো, ছেলের সতেরো।
হাজেরা চাননি তার সন্তানরাও এই পল্লীর বাসিন্দা হোক। তাই দুই জনইকেই পড়াশোনা করাচ্ছেন সোনার বাংলা চিলড্রেন হোমে। হাজেরা বলেন, সারাজীবন এ পল্লীতেই থেকেছি। আমার মাকেও দেখেছি এই পল্লীতে থাকতে। কোনো দিন সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারিনি। যেখানেই যাই সবাই বাঁকা চোখে তাকায়। আমি চাই না আমার মতো আমার সন্তানদের এমন দশা হোক। আমি চাই সন্তানরা মানুষের মতো মানুষ হোক। মাথা উঁচু করে বাঁচুক।
টাঙ্গাইল শহরের কান্দাপাড়ায় প্রায় ২০০ বছরের পুরনো যৌনপল্লীতে জন্ম নেয়া শিশুরা যখন অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল তখনই এসএসএস তাদের তুলে আশ্রয় দেয় সদর উপজেলার মগড়া ইউনিয়নের কুইজবাড়ি গ্রামের সোনার বাংলা চিলড্রেন হোমে। এখানে প্রতিটি শিশুর জন্য থাকা, খাওয়া, শিক্ষা, চিকিৎসা, চিত্তবিনোদনসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। শিশুদের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের জন্য নানা কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। কেউ বায়োলিন বাজাচ্ছে, কেউ নাচ, গান আবার কেউ মার্শাল আর্টে পারদর্শী। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাধারণ আট-দশজন শিশুর চেয়ে তারা এগিয়ে। শুধু তাই নয় এসব শিশুদের বড় করে বিয়ে এবং চাকরি দেয়ার নজির রয়েছে এখানে।
তারা যৌনকর্মী মায়ের সন্তান। বেশির ভাগ মা থাকেন শহরের কান্দাপাড়া যৌনপল্লিতে। আর এই হোমে শিশুরা বেড়ে উঠছে সমাজের আর দশটা শিশুর মতোই। এখানে শিশুরা প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত পড়ে। তারপর টাঙ্গাইলের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়তে যায় তারা।
চিলড্রেন হোমে কথা হয় কয়েকজন শিশুর সঙ্গে। যারা প্রতিনিয়ত বেড়ে উঠছিল অবহেলা আর মানুষের কটু কথা শুনে। মূলধারার শিশুর সঙ্গে মেশা ছিল তাদের বারণ। কথা হয় এখানকার শিক্ষার্থী শিউলী আক্তারের সঙ্গে। শিউলী বলেন, একেবারে ছোট বয়সে এখানে এসেছি। আমার বয়স তখন চার বছর। এখন নবম শ্রেনীতে পড়ছি। সোনার বাংলা চিলড্রেন হোম যদি না থাকতো,হয়তো আমিও মায়ের মতো হয়ে যেতাম। মায়ের জন্য খুব খারাপ লাগে। কারো কাছে বলতে পারি না, মা কি কাজ করে। এসব বিষয় মনে হলে চোখ ফেটে কান্না আসে। কিন্তু এখন আমি বাচার স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন দেখি অনেক বড় হবো।
সপ্তম শ্রেনীর শিক্ষার্থী সোহেল রানা বলেন, এখানে এসে সবধরনের সুযোগ সুবিধা পাচ্ছি। আমি মার্শাল আর্ট করছি, কয়েকবার বিদেশ গিয়েছি। পুরস্কার পেয়েছি। যেটা আমি মায়ের সঙ্গে থাকলে কখনো হতো না।  এমনটা দেখেই মা আমাকে এখানে দিয়ে গেছে। বেসরকারি সংস্থা তেরে দেস হোমস্‌ নেদারল্যান্ডসের সহায়তায় টাঙ্গাইলের বেসরকারি সংগঠন সোসাইটি ফর সোশ্যাল সার্ভিস (এসএসএস) কান্দাপাড়া যৌন পল্লির শিশুদের পুনর্বাসন ও সমাজে পুনঃ একত্রীকরণের জন্য হোমটি পরিচালনা করছে ১৯৯৮ সাল থেকে। হোমের ভেতরে ছেলেমেয়েদের জন্য পৃথক থাকার ব্যবস্থা আছে। শিশুদের বাণিজ্যিক যৌন শোষণ থেকে রক্ষা করার জন্য ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের আর্থিক সহযোগিতায় তেরে দেস হোমস্‌ নেদারল্যান্ডসের কারিগরি সহায়তায় বেসরকারি সংস্থা সোশ্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক এনহ্যান্সমেন্ট প্রোগ্রাম সিপ, ব্রেকিং  দ্য সাইলেন্স এবং টাঙ্গাইলের এসএসএস প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।
হোমের শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক শিক্ষা শেষে টাঙ্গাইল শহরে এসএসএস-পৌর আইডিয়াল হাইস্কুলে মাধ্যমিক শিক্ষাগ্রহন করেন। স্কুলপড়ুয়া শিশুদের মায়েরা যৌনপল্লি এবং কেউ কেউ পল্লির বাইরে বাসা ভাড়া করে সন্তানদের বড় করছেন। স্কুলে বিভিন্ন শ্রেনীতে পড়ুয়া যৌনকর্মী মায়ের সন্তানদের  নিয়ে আছে শিশু সংগঠন। স্কুলটিতে এই শিশুদের সঙ্গে হরিজন এবং সমাজের অন্য শিশুরা একসঙ্গে পড়াশোনা করছে।
বর্তমানে সোনার বাংলা চিলড্রেন হোমে আছে ১শ শিশু। এর বাইরে এসএসএস নিজস্ব অর্থায়নে হোমের প্রায় ২০ থেকে ২৫ জন রয়েছে যাঁদের বয়স ১৮ বছরের বেশি। তারা তাঁদের সহযোগিতা করছে। যাদের মধ্যে হোমে থাকা শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ টাঙ্গাইলের নামকরা সরকারি কলেজে অর্নাস পড়ছে, কেউ নার্সিং প্রশিক্ষন সমাপ্ত করেছেন। কেউ কেউ পড়ছেন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকার বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তাঁরা চাকরিও করছেন। এ পর্যন্ত এখান থেকে  ১৪ জন মেয়েকে বিয়ে দেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে তাঁদের পরিচয় গোপন করা হয়নি।
এ ব্যাপারে সোনার বাংলা চিলড্রেন হোমের অধ্যক্ষ মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এসব শিশুদের পরিচর্যা করা প্রথমে একটু কষ্টসাধ্য। তাদের প্রথমে অনেক কিছু শেখাতে হয়। কিন্তু তারা ধীরে ধীরে অনেক ভালো করে। অনেকে সমাজের আটদশটি শিশুদের চেয়ে মেধাবী এবং প্রতিভাবান হয়ে ওঠে। আমরা তাদেরকে যোগ্য মানুষ করে গড়ে তুলার জন্য নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছি।
সোশ্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক এনহ্যান্সমেন্ট প্রোগ্রাম-সিপ এর নির্বাহী পরিচালক মো. ফাইজুল হক চৌধুরী বলেন, এই প্রকল্পটি খুব চমৎকার একটি উদ্যোগ। এমন শিশুদের অধিকার নিয়ে কাজ করতে পেরে আমাদের ভালো লাগছে। আমরা চেষ্টা করছি তাদের একটি সুন্দর আগামী উপহার দেয়ার জন্য।
ব্রেকিং দ্য সাইলেন্সের নির্বাহী পরিচালক রোকসানা সুলতানা বলেন, যৌনপল্লির এসব শিশুদের কাউন্সিলিং করাটা খুব জরুরী। তারা যে জায়গা থেকে ওঠে আসে এর পরবর্তীসময়টা তাদেরকে মানসিক ভাবে তৈরী করতে আমরা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেই। তাদের সমস্যা সম্ভাবনা গুলো টাচ করার চেষ্টা করি।
তেরে দেস হোমস্‌ এর বাংলাদেশ কান্ট্রিডিরেক্টর মাহমুদুল কবির বলেন, প্রতিটা শিশুরই ভালোভাবে, সুন্দরভাবে বাচার অধিকার আছে। তাদের সেই অধিকার বাস্তবায়নে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আমরা চাই না কোনো শিশু তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হোক। আর যৌন পল্লির শিশুদের তো আরো ভয়াবহ অবস্থা। তাদেরকে সুন্দর আগামী দেয়ার জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি।

No comments

Powered by Blogger.