১১ বছরেও কি নেপালের প্রজাতন্ত্র সফল হয়েছে? by পিটার গিল

নেপালে ২০০৮ সাল থেকে ২৮ মে পালিত হয় প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে। ওই সময় নির্বাচিত সংবিধান পরিষদ দেশের কয়েক শ’ বছরের প্রাচীন রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে একে ফেডারেল, গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করে। গত বছর রাষ্ট্রপতি ও একজন মন্ত্রী মধ্য কাঠমান্ডুতে নারায়নহিতি নামে পরিচিত একটি রাজকীয় প্রাসাদ মাঠে দিনটির স্মরণে নতুন রিপাবলিক মেমোরিয়াল উদ্বোধন করেন। তবে ভিআইপিরা চলে যাওয়ার পর পরিকল্পনা অনুযায়ী জনসাধারণের জন্য এটি খোলা হয়নি। আরো অনেক সরকারি নির্মাণ প্রকল্পের মতো এটির নির্মাণও ২০১২ সাল থেকে বিলম্বিত হচ্ছে।
মেমোরিয়ালের বন্ধ ফটকের সামনে থাকা রাস্তায় ছোট একটি চায়ের দোকান আছে। সকাল বেলা সেখানে অফিসকর্মী আর স্থানীয় যুবকরা জড়ো হয়। দোকানটির মালিক হরি বল্লভ পান্ত কাছের একটি এলাকায় বড় হয়েছেন, তিনি বছরের পর বছর ঘটে চলা ঘটনাগুলো দেখেছেন। রাজতন্ত্রের আমলে তিনি নারায়নহিতি প্যালেসের ভেতরে কার্পেট শ্যাম্পু করার ব্যবসা পরিচালনা করতেন। নতুন রিপাবলিক মেমোরিয়াল বলতে কী বোঝে, এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বেশ ঝাঁঝাল জবাব দেন।
তিনি নেপালের প্রাক-গণতান্ত্রিক ও গণতন্ত্র-পরবর্তী ক্ষমতায় থাকাদের প্রসঙ্গে বলেন, দেখুন, প্রথমে রানারা জনগণকে শোষণ করত। তারপর এলো রাজতন্ত্র। পরে কংগ্রেস এবং এখন কমিউনিস্টরা। রাজনৈতিক পরিবর্তন নেতাদের কাছে হয়তো কিছু বোঝায়। কিন্তু আমাদের মতো সাধারণ লোকের কাছে কোনো ভিন্নতা নেই।
বর্তমান সময়ে নেপালের রাজনীতি সম্পর্কে হতাশা সাধারণ বিষয়। ২০০৮ সালে প্রজাতন্ত্র ঘোষণা হওয়ার পর থেকে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা যাওয়া সত্ত্বেও রাজনীতি নিয়ে আশাবাদী হতে পারছে না জনসাধারণ। ২০০৮ সালে নাগরিক সমাজের নেতা, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলো ও সাবেক বিদ্রোহী মাওবাদীরা গণআন্দোলনের মাধ্যমে নেপালের রাজা জ্ঞানেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ দেবকে উৎখাত করেছিল। তাদের লক্ষ্য ভিন্ন ভিন্ন হওয়ায় জোটটি ছিল অস্বস্তিতে। ২০০৫ সাল থেকে স্থগিত হয়ে থাকা গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার দাবি জানাচ্ছিল সবাই। যে সব দাবিতে তারা তখন সোচ্চার হয়েছিল, ১১ বছর পরও সেগুলো বাস্তবায়িত হয়নি। এবং রিপাবলিক মেমোরিয়াল পর্যন্ত অসম্পূর্ণ হয়ে রয়েছে।
নির্বাচন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিনিধিত্ব
মৌলিক দিক থেকে নতুন প্রজাতন্ত্র সফল হয়েছে। নির্বাচন হয় অনেকটাই স্বাধীন ও নিরপেক্ষ, ভোটারদের উপস্থিতি হয় ভালো। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর গঠিত পরিষদের দায়িত্ব ছিল নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা। তখন নির্বাচনে ৬০ শতাংশ ভোট পড়ে। কিন্তু তারা নির্ধারিত সময়ে তা করতে পারেনি।
২০১৩ সালে দ্বিতীয় পরিষদ নির্বাচনের সময় ভোট পড়ে ৭৮ শতাংশ। এই পরিষদ ২০১৫ সালে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করে। এতে সেক্যুলারবাদ ও ফেডারেলবাদকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে। তারপর ২০১৭ সালে তৃতীয় সাধারণ নির্বাচন হয়। এই নির্বাচনেও ভোটার উপস্থিতি ছিলো ব্যাপক – স্থানীয় নির্বাচনে প্রায় তিন-চতুর্থাংশ ভোট পড়ে।
ফেডারেলবাদ ও সেক্যুলারবাদ
বিদ্রোহের সময় মাওবাদীরা ফেডারেল রাষ্ট্র কাঠামোর কথা বলত। তাদের মতে কাঠমান্ডুতে সব ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত না থেকে যাতে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ সম্ভব হয়। তবে কেবল বিকেন্দ্রীকরণই ক্ষমতাসীনদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার জন্য যথেষ্ট নয়। একারণেই ২০১৭ সালের নির্বাচনের পর স্থানীয় ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে বিরোধ লেগে আছে – কার কাছে কী ক্ষমতা আছে, তা নিয়ে। বিশেষ করে করারোপ ও প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর কার নিয়ন্ত্রণ থাকবে, তা নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছে।
সেক্যুলারবাদ নিয়েও বিরোধ রয়েছে। ২০১৫ সালে হিন্দু ধর্মের ওপর থেকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। তারপরও হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মকে কিছুটা সুবিধা দেয়া হয়েছে এই সংবিধানে। গরু জবাইয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা বহাল রয়েছে। জনমত জরিপে দেখা যায়, হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকজন সেক্যুলারবাদকে তেমনভাবে গ্রহণ করছে না।
নাগরিক আন্দোলনকারীদের ওপর দমন-পীড়ন
নেপালি ইতিহাসে আগের আমলগুলোতে প্রতিবাদ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। ২০০৮ সাল থেকে মিশ্র অবস্থা দেখা যাচ্ছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা যেমন রয়েছে, আবার এর ওপর বিধিনিষেধ আরোপের অনেক ঘটনাও দেখা যায়।
২০১৭ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসা কমিউনিস্ট জোট এনসিপি পুরনো আইন ব্যবহার করে দমন-পীড়ন চালাচ্ছে। ২০১৮ সালেই ছয় সাংবাদিককে গ্রেফতার করা হয়েছে।
এনসিপি সরকার বলছে, অনলাইন অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণের জন্য কথা বলার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ দরকার। তারা ভুয়া খবরের উদারণ দিচ্ছে।
মাওবাদের ইতিহাস লেখক আদিত্য অধিকারী মনে করেন, বর্তমান সরকারের কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা নতুন কিছু নয়। নেপালের রাজনৈতিক মহলের মধ্যে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অভাব থাকায় এমনটা হচ্ছে।
সাপ্তাহিক সংবাদপত্র অন্নপূর্ণা এক্সপ্রেসের সম্পাদক বিশ্বাস বড়াল বলেন, এনসিপি নেতারা উদ্দীপনার জন্য নেপালের প্রতিবেশীর দিকে হয়তো তাকায়। চীনা প্রেসিডেন্ট শি যেভাবে সব ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করেছেন, নেপালের প্রধানমন্ত্রী খড়গ প্রাসাদ অলিও হয়তো তেমন কিছু করতে চাচ্ছেন।
বড়াল বলেন, অলি ভারতের নরেন্দ্র মোদির দিকেও তাকাতে পারেন। নবনির্বাচিত মোদিও ক্ষমতা সুসংহত করেছেন, কর্পোরেট-নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ার কাছ থেকে ইতিবাচক সমর্থন পেয়েছেন। অলি হয়তো মনে করতে পারেন, যে পন্থায় ক্ষমতায় এসেছেন, সে পন্থাতেই ক্ষমতা সুসংহত করতে হবে।
প্রবৃদ্ধি ও এর অতৃপ্তি
রিপাবলিক মেমোরিয়ালের বাইরে দাঁড়ালে কাঠমান্ডুর স্কাইলাইনে নতুন নতুন বিলাসবহুল হোটেল, আকাশচুম্বি মল, অ্যাপার্টমেন্ট চোখে পড়ে। চায়ের দোকানদার হরি বল্লভ বলেন, ছোট ছোট বাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়ে বড় বড় ভবন করা হচ্ছে। ধনীরা আরো ধনী হচ্ছে, গরিবরা হচ্ছে আরো গরিব।
প্রজাতন্ত্র ঘোষিত হওয়ার পর নেপালে জিডিপি বেড়েছিল ২০১৪ পর্যন্ত। ২০১৫-১৬ সালের ভূমিকম্পের পর পল্লী এলাকায় ধসের সৃষ্টি হয়। তারপর আবার প্রবৃদ্ধি বাড়তে থাকে।
তবে স্থানীয় চাকরির সুযোগ বেশ কম। অর্থনীতি প্রবাসীদের আয়ের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। শ্রম দফতর ২০০৮ সাল থেকে ৩৫ লাখ ট্রাভেল পারমিট ইস্যু করেছে। বেশির ভাগই মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়ায় কাজ করার জন্য।
আরো বড় কথা হলো, বৈষম্য বাড়ছে বলে ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। সম্প্রতি জাতীয় একটি থিঙ্ক ট্যাঙ্ক জানিয়েছে, রাজনীতি, সরকারি প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি খাতে স্বজনপ্রীতি বাড়ছে। ফলে দুর্নীতির লাগাম টানা কঠিন হয়ে পড়ছে।
বৈষম্য ও দুর্নীতি বাড়ার ফলে জনসাধারণের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে। এর রেশ ধরে একটি কট্টরপন্থী কমিউনিস্ট দল নতুন বিপ্লবের ডাক দিয়েছে।
লেখক: কাঠমান্ডুভিত্তিক সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.