লন্ডন বাংলাটাউনের বাঙালিরা কোথায়? by শাকিল বিন মুশতাক

বদলে যাচ্ছে এককালের বাঙালি অধ্যুষিত ব্রিক লেনের চেহারাঃ
লন্ডনের এক সড়কের কোনায় পর্যটকদের একটা ছোট্ট দল তাদের গাইডের কথা মন দিয়ে শুনছিল। এলাকার বিবরণ দিচ্ছিলো গাইড। এক পর্যটক গাইডকে থামিয়ে দিয়ে জানতে চাইলেন, তুমি বলছো এটা বাংলাটাউন, তাহলে বাঙালিদের দেখা যাচ্ছে না কেন? দেয়ার মতো তেমন জবাব অবশ্য ছিল না গাইডের কাছে।
ইংল্যান্ডের পূর্ব লন্ডনের একটি সড়কের নাম ব্রিক লেন। দুই কারণে এলাকাটি বিখ্যাত: গ্রাফিতি আর ভারতীয় খাবারের রেস্তোরাঁ। গ্রাফিতিগুলো তৈরিতে বাঙালিদের ভূমিকা নেই। কিন্তু প্রায় প্রতিটি ভারতীয় খাবারের রেস্তোরাঁর মালিকই বাঙালি, চালাচ্ছেনও তারা। বাংলাটাউন ছাড়া কারি ক্যাপিটাল নামেও ডাকা হয় এলাকাটাকে।
পুরো উনবিংশ শতক এমনকি বিংশ শতকের শুরুতেও ইহুদিরাই ছিল এ এলাকার প্রধান জনগোষ্ঠী। কিন্তু বিংশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে বাঙালি অভিবাসীরা সংখ্যাগুরু হয়ে ওঠে এখানে। জনসংখ্যার এই বিবর্তনের প্রতীক হিসেবেই একটা সিনাগগ রূপান্তরিত হয়ে লন্ডন জামে মসজিদে রূপ নিয়েছে। সিনাগগটাও এক সময় চ্যাপেল ছিল। সেই সাথে বিখ্যাত খাবারের রেস্তোরাঁগুলো চালু হয়েছে বাঙালিদের রসনা বিলাস মেটাতে।
কিন্তু এই ইতিহাসও অতীত হতে চলেছে। গ্রাফিতিগুলো এখনও রয়েছে, কিন্তু রেস্তোরাঁর সংখ্যা কমে যাচ্ছে, একইভাবে কমছে বাঙালির সংখ্যাও। বাঙালিরা এই এলাকা ছেড়ে লন্ডনের অন্যান্য এলাকা যেমন ইস্ট হ্যাম, ইলফোর্ড অথবা বার্কিংয়ের মতো জায়গায় চলে যাচ্ছে। এই এলাকায় এখন খুব সামান্যই বাঙালি তৎপরতা বা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চোখে পড়বে। অনেক বাঙালিই অন্যান্য কমিউনিটিগুলোতে চলে গেছে। রেস্তোরাঁগুলোর মালিকানাও বদল হয়েছে। এককালের বিখ্যাত বাঙালি রেস্তোরাঁ ‘ক্লিফটন্স’-এর জায়গায় এখন দাঁড়িয়ে আছে তুর্কী চেইনশপ ইফেস।
এই মিনি-বাংলাদেশকে কিভাবে দেখেন প্রবাসীরা?
ওসমান গনি ব্রিক লেনের একজন প্রবীণ কমিউনিটি নেতা। এখানে আসেন ১৯৭৬ সালে। তিনি বললেন, “পরিবারের প্রবীণদের দেখাশোনা করা আমাদের সংস্কৃতির অংশ। তাই যখনই নতুন প্রজন্মের কেউ এই এলাকা ছেড়ে অন্যত্র গেছে, তারা পরিবারের অন্যদেরও সাথে নিয়ে গেছে।”
ওসমান গনি বললেন, “পরবর্তী প্রজন্মের কাউকে দোষ দেয়া যায় না। কারণ তারা সরাসরি বাংলাদেশ থেকে আসেনি। তাদের জন্ম এখানে, ব্রিটিশ নাগরিক হিসেবেই বড় হয়েছে তারা। তাই ব্রিক লেনের বাঙালি চারিত্রগুলো দেখাশোনা করার ব্যাপারে তাদের দৃষ্টিভঙ্গী আমাদের চেয়ে ভিন্ন হতেই পারে। এটা ধ্বংস হয়ে যাক, সেটা হয়তো তারা চায় না, কিন্তু এ জন্য আলাদা করে সময় দেয়ার মতো অবস্থাও তাদের নেই।”
পুরনো দিনের কথা স্মরণ করলেন গনি। কমিউনিটির তখন স্বর্ণযুগ। স্পাইটালফিল্ডস আর বাংলাটাউন ওয়ার্ডে প্রায় ৫০ হাজার বাঙালি বাস করতো সে সময়। এদের অধিকাংশই লন্ডনে এসেছেন ১৯৭৬ আর ১৯৯০ সালের মাঝামাঝি। সরকারের কিছু পদক্ষেপ আর ব্রিটিশ বাঙালিদের কঠিন চেষ্টার কারণে বাংলাটাউন হিসেবে পরিচিতি পায় এই এলাকা।
গনি বলেন, “অনেকে এমনকি চায়নাটাউটনের যে প্রতীকী মূল্য, তার সাথে বাংলাটাউনকে তুলনা করেন। কিন্তু চায়নাটাউন হলো বাণিজ্যিক আর বিনোদনের জায়গা, কিন্তু বাংলাটাউন হলো একটা সংস্কৃতির পরিমণ্ডল.. বাংলাটাউন সত্যিকার অর্থেই টাউন, কোন বাণিজ্যিক এলাকা নয়।”
শাহ মুনিম একজন প্রথম সারির ব্যবসায়ী ও কমিউনিটি নেতা। নব্বই দশকের শেষের দিকে এখানে আসেন তিনি। এখন “স্বাদ গ্রিল” নামের বিখ্যাত এক রেস্তোরাঁসহ বেশ কিছু ব্যবসা রয়েছে তার। এই এলাকায় বাঙালিদের সংখ্যা কমে যাওয়ার ব্যাখ্যাটা তার কাছে খুবই সহজ: “অর্থের দরকার রয়েছে। মানুষ ঘরবাড়ি বিক্রি করে দিয়েছে (যেহেতু জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে).. আর আপনি বাড়ি বিক্রি করলে অন্য কমিউনিটির মানুষ এসে সেগুলো কিনবে। স্বাভাবিকভাবেই তাদের সংখ্যা এখানে বাড়বে।”
মুনিম আরও বললেন, “এটা সত্যি যে, আমাদের ঐতিহ্যগুলো তুলে ধরতে বা এগুলোর যত্নের ব্যাপারে আমরা বাঙালিরা অতটা ঐক্যবদ্ধ নই। আমরা এমনকি বাঙালি স্মৃতিগুলো ধরে রাখার জন্য ভালো একটা দোকান চালু করিনি। খাবারের ঐতিহ্যটা কিভাবে ধরে রাখা যায়, সে ব্যাপারেও আমাদের কোন গবেষণা নেই। এর পরও কমিউনিটি সদস্যরা যদি একসাথে দাঁড়িয়ে যায়, আমাদের অনেক সম্ভাবনা রয়েছে।”
মুনিম মনে করেন, “আমরা যদি এখনই পদক্ষেপ না নিই, তাহলে বাংলাটাউন হারিয়ে যাবে।”
গনি অবশ্য অন্যভাবে দেখছেন। তার বিশ্বাস ভবিষ্যতেও বাঙালিরা এখানে থাকবে, কিন্তু হয়তো সেভাবে সঙ্ঘবদ্ধভাবে নয়।

No comments

Powered by Blogger.