প্রেমে-অপ্রেমে ইসমত-মান্টো by মহুয়া ভট্টাচার্য

ইসমত একদিন মান্টোকে বলছেন-‘ও মান্টো সাহেব! একটা বেশ গরমাগরম প্রেমের গল্প শোনান না! যা আপনার জীবনে ঘটেছিলো।’ মান্টো বলতে লাগলেন- ‘পূর্ব পুরুষের দেশ কাশ্মীর গেলাম টিবি রোগ সারানোর জন্য হাওয়া বদল করতে। কাশ্মীর উপত্যাকায় রোজ কম্বল গায়ে রোদ্দুরে গিয়ে বসে থাকতাম, জ্বর আসতো বলে। একটা বাচ্চা মেয়ে অদূরে ভেড়া চড়াতো। আমি খালি তার কাফতানের ফাঁকে কনুইয়ের অংশ দেখতে পেতাম। আমার সঙ্গে চোখে চোখ পড়লে হেসে পালিয়ে যেতো। একদিন সাহস করে কাছে এলো। হাতটা পেছনে মুঠো করে রাখা। আমি জোর করে হাত থেকে কেড়ে নিয়ে দেখি একটা মিছরির ডেলা-আমার জন্য এনেছে।’
গল্প শেষ। মান্টো চুপ।
ইসমত বললেন- ‘আরে মেয়েটার কি হলো ?’
মান্টো বললেন, ‘ও, আমিতো শরীর সেরে যাওয়ায় চলে এলাম। আর মিছরির ডেলা? ও ড্রয়ারে রাখা ছিলো। একদিন দেখি পিঁপড়ে খেয়ে নিয়েছে।’
ইসমত বললেন- ‘ধ্যাত্তেরি! এই আপনার গরমাগরম প্রেম!? এমন ভিজে ন্যাতা ন্যাতা প্রেম জীবনে শুনিনি। বড় বাহাদূর! প্রেম করতে গিয়ে কনুই দেখে ফিরে এলো! হাতে মিছরির ডেলা! ছোঃ!’
মান্টো রেগে কাঁই! বললেন- ‘কীরকম হলে খুশি হতেন? এই বাচ্চা মেয়েটিকে অবৈধ সন্তানের মা বানিয়ে এলে?’
এই হলেন মান্টো! যিনি এক নির্জন পাহাড়ি উপত্যকায় একটি মেয়ের কনুইটুকু দেখার জন্য সারাজীবন অপেক্ষারত থাকতে পারতেন। তার বিরুদ্ধে সেই চল্লিশের দশকে অশ্লীল লেখার দায়ে মামলা হয়েছিল। অথচ মান্টো ছিলেন বাস্তবতার কাছে দায়বদ্ধ এক লেখক, অশ্লীলতা ছিল কেবল তার শব্দের গাঁথুনিতে, তিনি ছিলেন সমাজের অসঙ্গতি প্রকাশে বদ্ধপরিকর এক অসাধারণ লেখক। তিনি তাঁর যুগের চাইতে এগিয়ে ছিলেন বহুগুণ।
আর ইসমত? সিভিল সার্ভেন্ট পিতা, প্রতিষ্ঠিত লেখক মির্জা আজিম বেগ চুঘতাই এর বোন আর চলচ্চিত্র পরিচালক স্বামী শহীদ লতিফের স্ত্রী ইসমত। একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পারিবারিক বলয়ে জীবন যাপন করেও নিজের লেখায় তুলে এনেছিলেন সমকামীতা, যৌনতা। এতে তাঁকেও পোহাতে হয় মামলা। হতে হয়েছে বিতর্কিত। আর নিবিড় প্রেমে জড়িয়েছিলেন আরেক বিতর্কিত, চাল-চুলোহীন, সুরায় আসক্ত?, ব্রীজপ্রেমী মান্টোর সাথে।
উর্দূ সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক জুটি ইসমত চুঘতাই এবং সাদাত হাসান মান্টো। আজকাল আধুনিক সাহিত্য জগতে লেখক-লেখিকাদের যেমন একটি ভক্তকুল, ফ্যানক্লাব গড়ে ওঠে, ইসমত-মান্টোরও তেমনি একটি বিস্তৃত পরিসরের ভক্তকুল ছিলো। তাদের ভক্তরা তাদের লেখা, ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে চর্চা করত। তাঁরা দুজনেই দীর্ঘদিনের বিবাহিত জীবনে আবদ্ধ থাকা সত্ত্বেও, তাঁদের প্রেম ছিলো প্রকাশ্য। ভক্তকুল আশা করতেন ইসমত- মান্টোর প্রেমের পরিণতির। উর্দু সাহিত্যের কালজয়ী এই দুজন সাহিত্যিকের সৃষ্টি সম্পর্কে জানা নেই এমন পাঠক কমই আছে। তবে তাদের মধ্যে পারস্পারিক মতানৈক্য, দ্বন্দ্ব সংকুল ঈর্ষা কাতরতা- সবকিছুর সাথেই সমান্তরালভাবে চলত প্রেম। এ এক রহস্যময় সম্পর্কের গাঁথুনি। দুজনের মতাদর্শের, যাপিত জীবনের হাজারও পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তাদের দুজনের অখন্ড মিল ছিলো উচ্চকন্ঠে প্রতিবাদ, আবেগহীন বাস্তবতার চিত্র পট অঙ্কন আর নান্দনিক দৃষ্টিতে যৌনতার উপস্থাপনে। দেশ বিভাগের সময়টাতে এ-বিষয় নিয়ে লেখা, কোন লেখকের পক্ষে তো বিপদজনক ছিলোই- একজন নারী লেখকের জন্য তো আরো বেশি বৈপ্লবিক।
তাঁরা দুজনই লেখার সময় নারী না পুরুষ, কোন পরিবারে জন্ম এসব নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। তাঁরা দায়বদ্ধ ছিলেন বাস্তবতা ও শিল্পের প্রতি। তেমনি পরস্পরের প্রেমের সম্পর্কেও তাঁরা ছিলেন উদার। মামলার শুনানির জন্য লাহোর গিয়ে দুজনে ঘুরে বেড়িয়েছেন অবাধ। নিজেদের প্রেমকে তাদের নানা সাক্ষাৎকারে তুলে ধরেছেন অকপট।

ইসমত চুঘতাইকে বলা হত উর্দু সাহিত্যের ‘চেঙ্গিস খান’। লেখক হিসেবে তিনি সমসাময়িক নারী লেখক তো বটেই, পুরুষ লেখকদেরও টেক্কা দিতে সক্ষম হন। তিনি ছিলেন সেই সময়কার উর্দু সাহিত্যের কিংবদন্তি মান্টোর প্রায় সমপর্যায়ের। ফলে অহর্নিশ প্রতিদ্বন্দ্বিতার তুমুল ঝড় উঠতো দুজনের মধ্যে। ‘লিহাফ’ বা ‘লেপ’ ইসমতের বহুল আলোচিত সমালোচিত গল্প। এই গল্পের জন্য তাকে আদালত অব্দি যেতে হয়েছে। তৎকালীন সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের নারীর জন্য এযে কতখানি বিপদসঙ্কুল, দুর্গম পথ ছিল তা বলাবাহুল্য। এমনকি এ সময়টাতে তিনি তাঁর আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত চলচ্চিত্র পরিচালক স্বামী শহীদ লতিফের নির্ভরতাও পাননি। তিনি তাঁর বিভিন্ন সাক্ষাৎকারেও বলেছেন, সে সময় তাঁর স্বামী আদালতের বিষয়টি আপোষে নিষ্পত্তির প্ররোচনা দিতেন। পরবর্তী সময়ে এই ‘লিহাফ’ গল্পেকে কেন্দ্র করে বিতর্কের কারণে তাঁর বিবাহিত জীবনেও তালাকের সংশয় দেখা দিয়েছিল। ইসমত তখন দুই কন্যা সন্তানের জননী এবং সর্বদা কুন্ঠিত থাকতেন লতিফের তালাক প্রদানের আশংকায়। মান্টো ইসমতের সকল নারীসুলভ ভীরুতা নিয়ে চরম ভর্ৎসনা করলেও তিনিই ছিলেন মূলত ইসমতের যোগ্য সহচর। মান্টো পারিবারিক মজলিসে, বন্ধু বান্ধবের সামনে ইসমতকে জেদী, একরোখা আখ্যায়িত করে ইসমতের সামনেই তার চরিত্রের নেতিবাচক দিক নিয়ে পরস্পর প্রচন্ড বাত-বিতন্ডায় লিপ্ত হতেন। এমনও হত তাঁদের ভক্তকুল ভাবত এরপর থেকে হয়তো দুজনকে আর ইহজনমে একসাথে দেখা যাবে না। কিন্তু পরদিন অথবা হপ্তাখানেক পর হয়তো মাঝরাতে ইসমত আইসক্রিম কামড়ে-কামড়ে তুফান বেগে লিখে চলেছেন। সেই সময়ই শব্দ আর ইসমতের মধ্যকার শেলক ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে সুরার বোতল হাতে মান্টো উপস্থিত হয়ে যেতেন সস্ত্রীক। তারপর কোনকিছু ধার না ধরে ইসমতের রান্নাঘরে মান্টো তাঁর স্ত্রী আরো কয়েকজন সঙ্গী সাথী জুটিয়ে নিজেরা রুটি গোশত বানিয়ে উদরপূর্তি করে নিতেন! শেষে সুরার বেতলের শেষ ফোঁটাটুকুও গলায় ঢেলে ফের ইসমতের লেখার খাতার দিকে তাকিয়ে তার আঁকাবাঁকা লেখার জন্য যারপরনাই হেনস্তা করে সে রাতের মতো ক্ষান্ত হতেন।

আবার এই মান্টোই ছিলেন ইসমতের লেখার প্রবল অনুরাগী। ইসমতের বিরুদ্ধে মামলা রজু হওয়ার প্রথম থেকে শেষদিন অব্দি তিনি ছিলেন ইসমতের পাশে।
অশ্লীলতার দায়ে দায়ের করা মামলার শুনানিতে উপস্থিত হতে ইসমত চুঘতাই এবং সাদাত মান্টো দুজনেই লাহোর গিয়েছিলেন। সেসময় তাদের জুটি এত জনপ্রিয় ছিল যে, লাহোর আদালতে দলবেঁধে ছাত্র-ছাত্রীরা আসতো তাদের দেখতে। ইসমত ও মান্টোর বন্ধুত্ব ও প্রেমের সম্পর্ক উদার পাঠকের মনে এক ভিন্নতর চিন্তার স্ফুরণ ঘটায়। ইসমতের ‘লিহাফ’ গল্পটি অভিযুক্ত হয় অশ্লীলতার দায়ে, ঠিক ঐ সময়েই মান্টোও অভিযুক্ত হন একই অভিযোগে। যদিও মান্টো পরপর ছয়বার আদালতে অভিযুক্ত হয়েছিলেন তাঁর লেখার জন্য। ইসমতের কোলে তখন তার শিশুকন্যা। এই অবস্থাতেই তাকে মামলা লড়ে যেতে হয়। পরিবার এবং রাষ্ট্রপক্ষও ইসমতকে চাপ দিচ্ছিল মামলাটি আপোষে নিষ্পত্তির কিন্তু তিনি তা করেননি।আর মান্টো? তিনি তাঁর খামখেয়ালি জীবন, অপরিমিত মদ্যপান এবং ফলশ্রুতিতে নিদারুণ দারিদ্র বয়ে চলা জীবনে মামলার খরচ যোগানোর মতো অর্থ যোগাড় করতে পারেননি, পারেননি কোন চৌকস উকিল ধরতে। কিন্তু মৃত্যুর আগ অব্ধি কলম থামেনি তাঁর। এই সময় ইসমত চুঘতাই নিজের মামলা চলাকালে আদালতেও মান্টোকে সমর্থন করে বলেছিলেন, ‘সমাজে বাজে জিনিসের অস্তিত্ব আছে বলেই মান্টো তা লিখছেন।’ সাদাত ইসমতের এই ক্ষুরধার, আপোষহীন চরিত্রকে ভালোবাসতেন। তিনি ইসমতকে দেখতে চাইতেন, ‘যে নারী পুরুষের পাশাপাশি যুদ্ধের মাঠে লড়ে, পাহাড় কাটে আর গল্প লিখতে লিখতে ইসমত চুঘতাই হয়। সেই নারী আবার হাতে মেহেন্দিও পড়ে।’ মান্টো ইসমতকে ভালোবাসতেন। মান্টো লিখেছেন- ‘ইসমতের ক্রোধ শিশুসুলভ। তবে তার কলম এবং মুখ দুটোই ধারালো’ (গাঞ্জে ফরিস্তে)। ইসমতের তীক্ষ্ম নজরে রান্নাঘরের খবরদারি থেকে শুরু করে, স্থির, অবিচল অধ্যাবসায়ে বাচ্চার ফ্রক সেলাই-কোনটাই মান্টোর চোখ এড়াতো না। একি কেবল গল্পের খোঁজে! না! আসলে মান্টোর চোখই ইসমতে মুগ্ধ ছিল। দর্জি হিসেবেও ইসমতের দক্ষতা পাঠককের সামনে মান্টোই এনেছিলেন। নিজের বাচ্চাদের ফ্রক তিনি নিজেই সেলাই করতেন। মান্টো বলতেন, ইসমতের পাতার পর পাতা আঁকাবাঁকা হাতের লেখায় দুএকটা বা তারও বেশি ভুল বানান থাকতেই পারে, কিন্তু বাচ্চার ফ্রক সেলাইয়ে ফোঁড়ের এদিক-ওদিক হয়না কখনো! কোথাও এক ইঞ্চি ঝুল মাপে কমবেশি হচ্ছে না। চারপেয়েতে কনুইয়ে ভর দিয়ে কাত হয়ে বালিশের ওপর কাগজ নিয়ে ইসমত লিখতেন। একহাতে ফাউন্টেনপেন অন্যহাতে আইসক্রিমের ডাঁটি।
ইসমত বরফ খুব পছন্দ করতেন। আইসক্রিম খেতে খেতে তিনি তাঁর বহু গল্প লিখেছেন। শিশুদের মতো চিবিয়ে চিবিয়ে তিনি আইসক্রিম খেতেন। এই সমস্ত বিবরনই মান্টো তাঁর ‘গাঞ্জে ফরিস্তে’ বইটিতে লিখে গিয়েছেন। মান্টো অনেক লিখেছেন ইসমতকে নিয়ে, সে তুলানায় ইসমতের লেখায় ‘মান্টো ভাই’ কিংবা ‘মান্টো সাহাব’ কেই বেশি পাওয়া গেছে। ব্যক্তি মান্টো-যাঁকে ঘিরে ইসমতের প্রেম ও নিবিড় বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল অথবা ইসমত যে মান্টোর সৃষ্টির প্রেরণা ছিলেন, তাঁকে নিয়ে ইসমত খুব কমই লিখেছেন। অথচ নিজে কিন্তু লেখার সময় পেয়েছিলেন মান্টোর চেয়ে বেশি! ইসমতকে জানতে জানতে পাঠক মান্টোকেই ভালোবেসে ফেলবে অবশ্যম্ভাবী। কারণ ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশে মান্টো ছিলেন অবিচল। নিজেকে তিনি পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন অকপট। মান্টো অন্য কারো চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হতে ঘেন্না করে। তার ধারণা যারা তাকে শিক্ষা দিতে যায়, তারা ইডিয়ট ছাড়া আর কিছু নয়। ‘আমি তোমাদের খুব জোর গলায় বলতে পারি যে মান্টো, যার বিরুদ্ধে এত অশ্লীলতার অভিযোগ রয়েছে, আদতে সে আগামাথা ভদ্রলোক। কিন্ত এ-কথাও বলে রাখি এর সঙ্গে যে, সে আসলে নিরন্তর ঝাড়পোছ করে চলেছে নিজেকে।’ এই হল মান্টোর নিজের সম্পর্কে নিজের ব্যাখ্যা! যে মানুষ নিজকে এতটা ভালো চেনে তারপক্ষেই তো সম্ভব অন্যের মন বোঝা। হাতের কাছে পেয়েওছিলেন ইসমতের মত একজনকে। মান্টোতো লিখেইছেন- ইসমতের মধ্যে নারীসত্তা ও পুরুষ প্রকৃতির মধ্যে আজব ধরণের জেদ ও অসম্মতি বিদ্যমান। হয়তো প্রেমে একেবারে হাবুডুবু খাচ্ছে কিন্তু প্রকাশ্যে অনীহা প্রকাশ করে যাচ্ছে। চুমো খাবার জন্য হয়তো প্রাণ তার মাথা কুটে মরছে, কিন্তু চুমোর বদলে সে গালে সুঁচ চালিয়ে দিয়ে তামাশা দেখবে। তার প্রেম খেলাচ্ছলে শুরু হয়ে ক্রমান্বয়ে তা ফল্গুধারা হয়ে পরিণতি প্রাপ্ত হয়। ুপ্রথমদিন দেখা সেই ববছাঁট, চিকনপাড়ের শাড়ি আর আঁটসাট ব্লাউজ পরনের নারীটি, যার নাকি অল্প হাসিতেই গালে টোল পড়ত- মান্টো আজীবন সেই নারীর লাবণ্যময়তাকে অন্তরে ধারণ করেছিলেন। আর ইসমতের কথা তেমন জানিনা, কারণ মান্টো নিজেই তো বলেছেন, ইসমত চুমু খাওয়ার সময়ও গালে সুঁচ ফুটিয়ে মজা দেখার মত গভীরেই লুকিয়ে রাখতেন সমস্ত মনোবাসনা!
ইসমত মান্টোর বিয়ের বিষয়টি ছিল বহুল আলোচিত। ভক্তদের কৌতূহল ছিল মান্টো ইসমতকে বিয়ে করছেন না কেন! আশ্চর্যজনকভাবে এই বিষয়ে দুজনেই ছিলেন উদাসীন। ইসমতকে বিয়ে করা না করা নিয়ে মান্টো একটি সুন্দর উপমা দিয়েছিলেন- ‘ক্লিওপেট্রার নাক যদি এক ইঞ্চির আঠারো ভাগের একভাগ বড় হত, তাহলে তার প্রভাবে নীলনদের ইতিহাসের কি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করত।’ সংবেদনশীল পাঠক ভক্ত এই কথার অন্তর্নিহিত রস গ্রহণ করতে পারলেও বহু আলোচক সমালোচকের চক্ষুশূল ছিল তাদের এই উদাসীনতা। এক হায়দ্রাবাদী বন্ধুর চিঠির জবাবে মান্টো তাকে একটি উত্তর পাঠিয়েছিলেন। সেখানে তিনি ইসমতকে নিকাহ করা না করা নিয়ে লিখেছিলেন, “Had we thought of getting married, than instead of drowing others in wonder and agitation we ourselves would have been drowned in it. And when we would have come to our sense after the initial shock, than our wonderments and agitation would have changed not in to joy but sorrow. Ismat and Manto nikha and marriage -what a ludicrous idea!” মান্টোকে জানতে জানতে মনে হতেই পারে মান্টো শুধুই সুরাসক্ত, ব্রীজপ্রেমী আর ইসমতের একনিষ্ঠ প্রেমে মজে থাকা এক পুরুষ। আসলে কিন্তু তা নয়! মান্টো ছিলেন উদার স্বামী, প্রেমময় পিতা। তিনি তাঁর স্ত্রীর কাপড় ইস্তিরি করে দিতেন। সে যুগে যখন পুরুষ জল গড়িয়ে খেতে সম্মানহানি ভাবতো মান্টো তখন রান্না করতেন। তিনি তাঁর সৃষ্টিতে ও যাপিত জীবনে আধুনিক ছিলেন। তেমনি ইসমতের সাথেও মান্টোর স্ত্রী সাফিয়ার গভীর সখ্যতা ছিল। সাফিয়া প্রায় ইসমতকে বলতেন, সা’সাহাব (সাদাত সাহেব) এর কথা তিনি বলতে পারবেন না, তবে নিজে ইসমতের প্রেমে মুগ্ধ। আর ইসমত তার স্বভাবজাত ক্ষুরধার জবাবে বলতেন, ‘তোমার বয়েসী মেয়ের বাপেরা অব্দি আমার প্রেমে পড়ে! ’ বম্বে টকিজ-এ ইসমত মান্টো একসাথে বহু কাজ করেছেন। বলা যায় সেই সময়টা তাদের শ্রেষ্ঠ সময় ছিল। ইসমতের প্রতি মান্টোর প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় ছিল সবার চেয়ে বেশি। ইসমতের বড়ভাই মির্জা আজিম বেগ চুঘতাইকে নিয়ে ইসমত একটি গল্প লিখেছিলেন, নাম ‘দোজখী’। কিছু অকাট সত্যকথনের জন্য গল্পটি নিন্দিতও হয়েছিল তখনকার সময়ে। মান্টোর বোন-ইকবাল বলেছিলেন, ‘হতচ্ছাড়ি নিজের মৃত বড়ভাইকেও রেহাই দিলনা।’ মান্টো তখন বলেন,চইকবাল, আমার মৃত্যুর পর এমন একটি গল্প যদি তুমি লিখবে বলে কথা দাও, আমি আজ, এক্ষনি মরতে প্রস্তুত।’
মান্টো ইসমতের প্রথম যে গল্পটি পড়েন, সেটি হল ‘লিহাফ’। যেহেতু তাদের দুজনারই লেখার বিষয় মূলত সমাজের রন্ধ্রে লুকিয়ে থাকা অসংগতি, মান্টোর নজর কাড়ে গল্পটি। মান্টো চাইলেন এই গল্পের লেখকের সাথে আলাপ করতে। দেখা হতেই মান্টো ইসমতকে বললেন, ‘আপনার লেহাপ গল্পটি পড়েছি। গল্পের বর্ণনায় আপনার সংযম অতুলনীয়। কিন্তু আমি ভেবে পাইনা আপনি গল্পের শেষে এই কথাটা কেন লিখলেন যে-“এক ইঞ্চি উপরের দিকে উঠানে লেপের ফাঁকে দিয়ে আমি কি দেখেছি, লক্ষ টাকা দিলেও আমি কাউকে তা বলব না।” ইসমত তখন বললেন,‘কেন এ লাইনটায় অসংগতি কোথায় ?’ মান্টো ফের কিছু বলতে যাবার আগেই ইসমত মান্টোর কথার মর্মার্থ বুঝে ফেলেন, আর লজ্জিত হন। আসলে ইসমত সেই সময়কার সমাজের দৃষ্টিতে অনৈতিক অথচ নিত্য ঘটে যাওয়া সত্যের বিবরণ তার লেখনীতে প্রকাশ করতেন নানা উপমায়। যৌনতা, সমকামিতা, নারীর প্রতি পুরুষের বৈষম্যমূলক আচরণ সবই তুলে ধরেছেন তার গল্পে একটি সংযত ভাষাশৈলীর আড়ালে। কিন্তু মান্টোর লেখার ধাঁচ ছিল তাঁর মুখের মতই আড়হীন। তাঁর কলম ছিল উলঙ্গ। হিন্দুস্থানে নানা চরাই-উৎরাই পেড়িয়ে ইসমত শক্তপোক্ত স্থান দখল করে নিলেন বটে, মান্টোর তা হলো না। দেশবিভাগের পর ইসমত হিন্দুস্থানে রয়ে গেলেন, মান্টো তার বন্ধুদের আপত্তি সত্ত্বে চলে যান লাহোর। তিনি কেন যে এতটা বেতাব ছিলেন লাহোর যাবার জন্য তা রহস্যময়। অথচ তখন বম্বে ফিল্ম ইন্ড্রাস্টিতে মান্টোর ক্যারিয়ার তুঙ্গে। তখন খুব কম শিল্পী, সাহিত্যিকই হিন্দুস্থান ছেড়ে ছিলেন। দেশবিভাগের সাথে সাথেই মান্টো লাহোর চলে আসেন। আর লাহোরে কাটানো জীবনের বাকি সময়টুকুই ছিল তাঁর জীবনের অগ্নিপরীক্ষা। ইংরেজ সরকার কর্তৃক দায়ের করা অশ্লীলতার অভিযোগে নবগঠিত পাকিস্তান সরকারও তুলে নিলেন না। ফলত লাহোর গিয়েও মান্টের রাষ্ট্র ও ধর্মব্যবসায়ী চক্রের ক্ষোভের হাত থেকে মুক্তি মেলেনি। মান্টোর সত্য প্রকাশের দুর্নিবার আকর্ষণ তাকে প্রগতিশীল লেখক সংঘেরও বিরুদ্ধ করে তুলেছিল। সে সময় কোন সংবাদপত্রই মান্টোর লেখা প্রকাশ করতে আগ্রহী হত না, মামলার ভয়ে। অথচ তখন এটাই ছিল মান্টোর উপার্জনের একমাত্র রাস্তা। নিম্নমানের সুরাপান, দারিদ্র্য, একের পর এক মামলা, গ্রেফতারি পরোয়ানা মান্টোর জীবন অতিষ্ঠ করে তোলে। দেশবিভাগের রক্তাক্ত দলিল বসে গেল দুটি দেশের মানুষের অন্তরে। প্রেম, সমপ্রতি, ভ্রাতৃত্বের মাঝখানের কাঁটাতারের বেড়া দুর্বল তো হলোই না , পরতে-পরতে বেড়েই গেল। বাড়লো ধর্মের নামে হানাহানি। মান্টোর কলম সেখানেও থামেনি। লাহোর গিয়ে শুরু হয় মান্টোর নতুন জীবন, নতুন সংগ্রাম। একদিকে মামলা, গ্রেফতারী পরোয়ানা, অন্যদিকে সংসারের নিদারুণ দারিদ্র্যের কষাঘাত। মান্টো এতটাই বেপর্দাভাবে সমাজের কুলীন সমাজের নোংরা কাহিনী ও দেশবিভাগের পরবর্তী সহিংসতা তুলে আনছিলেন যে, তিনি সকলের চক্ষুশূল হয়ে গেলেন। তাঁর নতুন প্রকাশিত কোন গল্পের কাহিনী পত্রিকায় এলেই সুশীল সমাজ ভয়ে তটস্থ হত- না জানি এবার কার ভান্ড উজাড় হল এই ভেবে!
লাহোরে এসে মান্টোর জীবনে নেমে আসে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ, সীমাহীন অর্থকষ্ট। একসময় মান্টো মানসিক ভারসাম্য হারান। তাঁকে মেন্টাল এস্যাইলামে রেখেও সুস্থ করার চেষ্টা চালান স্ত্রী সাফিয়া। দেশ বিভাগের বিয়োগান্তক স্মৃতি, চারপাশের নির্বান্ধব পরিবেশ, পদে পদে চতুর সম্রাজ্যবাদী মুদ্রাওয়ালাদের কাছে হেরে যাওয়া মান্টোর কাছে বিষবত মনে হচ্ছিলো। মান্টোর লেখার ভক্ত ছিল, মান্টোর বইয়ের কাটতি ছিলো কিন্তু রাষ্ট্র ও ধর্মব্যবসায়ী সুবিধাবাদী চক্রকে টেক্কা দিয়ে মান্টোর লেখা ছাপানোর মতো সাহসী প্রকাশক, সম্পাদক ছিল না। আবার অনেকে মান্টোর বিষয়বুদ্ধিহীনতার সুযোগ নিয়ে তাকে না জানিয়েই তার বইয়ের সংস্করণ বের করে অর্থ লুটে নেয়। মান্টো এসব কিছুই বুঝতেন না। কাগজ, কলম আর সুরা ছাড়া মান্টোর কোনো আসক্তি ছিলোনা। ফিল্মের নামী হিরোইন থেকে শুরু করে মজলিসের নৃত্য শিল্পী অব্দি মান্টোর গল্পের প্রেমে মুগ্ধ ছিলো। পতিতার শয়নকক্ষ থেকে পর্দার আড়ালে অন্তরীণ গৃহবধূর অলস দুপুরেও মান্টোর বই রাজত্ব করত। মান্টো এসব নারীর কথাই তার লেখনীতে তুলে আনতে পেরেছিলেন, যা একজন পুরুষ লেখকের জন্য বিস্ময়। তিনি নারীর শরীর, নারীর প্রতি মোহকে ছাপিয়ে নারীর চোখের জল দেখেছিলেন। এত জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও মান্টোর দারিদ্র্য তাকে রেহাই দেয়নি। জীবনের শেষদিকে তিনি লিভারসিরোসিসে আক্রান্ত হন। মান্টোর লাহোরে আসার পরের যে নিদারুণ দুর্ভোগ এতে আর ইসমতকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি সশরীরে। চিঠিপত্রের আদান প্রদানের একপর্যায়ে হতোদম্য মান্টো বারবার ইসমতকে লিখেছেন-‘আমাকে যে করেই হোক এখান থেকে নিয়ে যাও, এখানে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।’ অথচ ইসমতের তেমন কোন ভূমিকা আর দেখা যায়নি। মান্টো ঠকতে ঠকতে বুঝে গিয়েছিলেন বিষয়বুদ্ধি তার এ জীবনে হবে না। তাই তার সমস্ত বইয়ের স্বত্বাধিকারী করে যান তার স্ত্রী সাফিয়াকে। মাত্র ৪৩ বছর বয়সে লিভারসিরোসিসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন মান্টো। জীবিতকালে নিজের সৃষ্টির কোনো মূল্যায়ন দেখে যেতে পারেননি। ইসমত পেয়েছেন দীর্ঘজীবন। তাকে নিয়ে বায়োপিক, সচিত্র প্রতিবেদন কম হয়নি। এত যুগ পেরিয়েও পাঠকের মনে ইসমত-মান্টোর গ্রহণযোগ্যতা কমেনি এতটুকু। সবকিছু ছাপিয়ে মান্টো এখনও হৃদয়রাজা!

No comments

Powered by Blogger.