ইউনান থেকে যে শিক্ষা নিতে পারে ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চল by আশিষ কুন্দ্রা

ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলের অবস্থান আসিয়ানের ঠিক দ্বারপ্রান্তে, যেটা ভারতের ‘অ্যাক্ট ইস্ট নীতির’ মূল অঞ্চল। এ অঞ্চলের উন্নয়নের বিষয়টি এতকাল অভ্যন্তরীণ নীতির বিষয় ছিল কিন্তু এখন এটা জাতীয় কৌশলগত ও অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যের সাথে জুড়ে গেছে। এর অর্থ হলো এতদিনের অবহেলিত এই অঞ্চলটির সীমান্ত দিয়ে পরিচালিত বাণিজ্য অঞ্চলটিতে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিয়ে আসবে। চীন ইউনানের জন্য যে কৌশল গ্রহণ করেছে, সেটার সাথে এ অঞ্চলের একটা প্রতিতুলনা করা যেতে পারে। উচ্চাকাঙ্ক্ষী বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অংশ হিসেবে দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সাথে যোগাযোগের জন্য এই ইউনান অঞ্চলটিকে একটা সেতুবন্ধন হিসেবে গড়ে তুলেছে চীন।

মিল ও অমিল

ইউনান আর উত্তরপূর্বাঞ্চলের অনেক মিল রয়েছে। দুই জায়গাতেই জনসংখ্যার আকার কাছাকাছি, দুটোই পার্বত্য এলাকা, বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায় বাস করে, প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ, দুটো জায়গারই ব্যাপক জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে এবং দুই জায়গাতেই ঐতিহাসিকভাবে উন্নয়ন হয়েছে বেশ কম। ইউনানের সাথে মিয়ানমার, লাওস ও ভিয়েতনামের ৪০০০ কিলোমিটার দীর্ঘ আন্তর্জাতিক সীমান্ত রয়েছে। ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলের ৫০০০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে চীন, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের সাথে। কিন্তু এই মিল থাকার পর দুই জায়গার অর্থনৈতিক বাস্তবতার মধ্যে রয়েছে বিশাল পার্থক্য।

ইউনানের জিডিপি প্রায় ২৬৫ বিলিয়ন ডলার। এর চার ভাগের এক ভাগই আসে পর্যটন থেকে। স্থল সীমান্ত দিয়ে আসিয়ান দেশগুলোর সাথে যে বাণিজ্য হয়, তার পরিমাণ ১৪ বিলিয়ন ডলার। এর অর্ধেকই হয়ে থাকে মিয়ানমারের সাথে। অন্যদিকে, ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলের সম্মিলিত জিএসডিপির পরিমাণ হলো ৬৫ বিলিয়ন ডলার। কঠোর রেগুলেটরি নীতিমালার কারণে আমদানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। মিয়ানমারের সাথে ভারতের সীমান্ত বাণিজ্যের পরিমাণ বেশ কয়েক বছর ধরে ৫০ মিলিয়ন ডলারের আশেপাশেই ঘুরপাক খাচ্ছে। এ জন্য তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি মনোযোগ দেয়া দরকার: সংযোগ, সীমান্ত বাণিজ্য ও ইকোপর্যটন।

উত্তরপূর্বাঞ্চলেও বিমান, রেল ও সড়ক যোগাযোগ বাড়ছে, তবে ইউনানের চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে তারা। ইউনানের সদরদপ্তর কুনমিংয়ে ব্যস্ত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর রয়েছে। এই প্রথমবারের মতো উত্তরপূর্বাঞ্চলের সবগুলো রাজ্যে অন্তত একটি করে কার্যকর বিমানবন্দর তৈরি হয়েছে, যেগুলো কলকাতা ও গোয়াহাটির মাধ্যমে বিমান পরিবহনের সাথে সংযুক্ত। গোয়াহাটি থেকে সম্প্রতি ঢাকার সাথে আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল শুরু হয়েছে এবং ব্যাংককসহ আসিয়ানের আরও চারটি শহরের সাথে বিমান চালুর বিষয়টি প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। ইউনানের রেল নেটওয়ার্ক রয়েছে, যেটার সাথে বেইজিং, সাংহাই ও গুয়ানঝু সংযুক্ত। অন্যদিকে, ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলের রেলের অবস্থা দুর্বল, যদিও কেন্দ্রীয় রেল মন্ত্রণালয় ২০২২ সালের মার্চের মধ্যে এই অঞ্চলের সাথে রেল যোগাযোগ নিশ্চিত করার ইচ্ছার কথা জানিয়েছেন। ইউনানে চমৎকার সড়ক অবকাঠামো রয়েছে যেটা বিভিন্ন শহর ও বন্দরের সাথে সংযুক্ত। উত্তরপূর্বাঞ্চলে সড়ক ও ব্রিজ প্রকল্পে সরকারের বিনিয়োগ বাড়ছে, যেটা থেকে গত কয়েক বছর চমৎকার ফল পাওয়া গেছে, যদিও অভ্যন্তরীণ সড়ক যোগাযোগের বিষয়টি এখনও চ্যালেঞ্জই রয়ে গেছে।

ইউনানের একটা সুপরিকল্পিত বাণিজ্য কৌশল রয়েছে, যেখানে ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলের সীমান্ত বাণিজ্যের অবস্থা তথৈবচ। ইউনানের সাথে মিয়ানমারের বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র হলো রুইলি বর্ডার ইকোনমিক জোন। রুইলি শহরটাকে ঘুমন্ত একটা সীমান্তবর্তী শহর থেকে প্রাণবন্ত বাণিজ্যিক অঞ্চলে রূপ দেয়া হয়েছে। চীন এখন রুইলি ও মিউজের মধ্যে মিয়ানমারের সাথে একটা অর্থনৈতিক জোন গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছে। এই প্রকল্পের অধীনে প্রধান অবকাঠামোগুলো গড়ে তোলা হবে এবং উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাত, বাণিজ্য ও গুদামজাতের জন্য বেসরকারী বিনিয়োগ আহ্বান করা হবে। অন্যদিকে, মিজোরামের জোখাওথার স্থল কাস্টম স্টেশনটির অবকাঠামো ভাঙাচোরা এবং সেখানে খুব সামান্যই আনুষ্ঠানিক বাণিজ্য হয়। মনিপুরের সমন্বিত মোরেহ চেকপোস্টে বাণিজ্যের সম্ভাবনা দেখা গেছে। পর্যাপ্ত অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ, সরঞ্জাম অবকাঠামো, গুদামজাতকরণ ব্যবস্থা ও প্রক্রিয়াজাতকরণের অভাবে এখানে অর্থপূর্ণ বাণিজ্য হতে পারেনি। তাছাড়া কালাদান বহুমুখী ট্রানজিট পরিবহন প্রকল্পের মতো উচ্চাকাঙ্ক্ষী যে সব বহুজাতিক প্রকল্প নেয়া হয়েছে, জমি অধিগ্রহণে ঝামেলার কারণে সেগুলোও শুরু হতে প্রচুর সময় লেগে যাচ্ছে।

বিল্ডিং ব্লকস

স্থানীয় সম্প্রদায়কে অন্তর্ভুক্ত করে কিছু ইকো-ট্যুরিজমের ব্যাপারে সৃজনশীল প্রচেষ্টা নিয়েছে ইউনান। শিশুয়াংবান্না এলাকায় ইকোট্যুরিজমের অধীনে ‘ইকোলজিক্যাল গ্রাম’ তৈরি করা হয়েছে, যেখানে স্থানীয় দাই জাতিগত সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি, কৃষি, প্রথা ও খাবার প্রদর্শিত হচ্ছে। গ্রামবাসীরা বিভিন্ন কোম্পানির সাথে জমি লিজের মাধ্যমে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কাজ করছে এবং এর মাধ্যমে পর্যটকরা দাই জীবনযাত্রার খানিকটা দেখে নেয়ার সুযোগ পাচ্ছে। নাগাল্যান্ড হর্নবিল উৎসব দিয়ে ভালোই শুরু করেছে, কিন্তু অন্যান্য রাজ্যেও সুযোগ রয়েছে। এই পথে হাঁটলে পর্যটন অবকাঠামো খাতে বেসরকারী বিনিয়োগ উৎসাহিত হবে। পরিবেশ, সংস্কৃতি ও জাতিগত সম্প্রদায়গুলোর সাথে মিল রেখে পর্যটন গড়ে তুললে উপজাতীয় জীবনযাত্রা বিঘ্নিত হওয়ার কোন ঝুঁকি থাকবে না এবং একই সাথে অর্থনীতিও লাভবান হবে।

উত্তরপূর্বাঞ্চলের উন্নয়নে মনোযোগ দেয়ায় গত কয়েক বছরে ইতিবাচক ফল পাওয়া গেছে। রাজ্যগুলো যাতে এখন এক একটা ব্লক গড়ে তুলতে পারে, সেজন্য তাদের শক্তি বাড়ানো দরকার। ইউনানের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিতে পারলে এই অঞ্চলটির ভবিষ্যৎ রূপান্তরে সেটা ভূমিকা রাখতে পারবে।

>>>আশিষ কুন্দ্রা একজন আইএএস কর্মকর্তা, যিনি বর্তমানে মিজোরাম সরকারের সাথে কাজ করছেন।

No comments

Powered by Blogger.