প্রকৌশলী থেকে জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট

মিসরে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম ও একমাত্র প্রেসিডেন্ট ড. মোহাম্মদ মুরসি মৃত্যুবরণ করেছেন। ৬৭ বছর বয়সী সাবেক এই প্রেসিডেন্ট সোমবার দেশটির আদালতে শুনানি চলাকালে এজলাসেই মৃত্যুবরণ করেন। মিসরের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত প্রথম বৈধ প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি।
মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট ড. মোহাম্মদ মুরসির পুরো নাম মোহাম্মদ মুরসি ইসা আল-আইয়াত। তিনি ১৯৫১ সালের ২০ আগস্ট মিসরের শারকিয়া প্রদেশের আল-আদওয়াহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন কৃষক ও মা ছিলেন গৃহিনী। স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাগ্রহণ করার পর নিজের মেধার জোরে ১৯৭৫ সালে মোহাম্মদ মুরসি কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং (প্রকৌশল) বিষয়ে স্নাতক পড়া শুরু করেন। কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে স্নাতক ডিগ্রী সম্পন্ন করেন তিনি। এরপর ১৯৭৮ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন তিনি।
ছাত্রজীবনে তিনি এতই মেধাবী ও সম্ভাবনাময় ছিলেন যে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জনের জন্য তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তৎকালীন সময়ের সর্বোচ্চ স্কলারশিপ নিয়ে ভর্তি হন এবং অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে তিনি ১৯৮২ সালে পিএচডি ডিগ্রী লাভ করেন।
এরপর তিনি কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে তার কর্মজীবন শুরু করেন। পরে সাউথ ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ ১৯৮২-৮৫ সাল পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। পরে তিনি নাসায় কাজ করার সুযোগ পান এবং সেখানে তিনি সুনামের সাথে স্পেস শাটল ইঞ্জিন উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
কিন্তু পরে নিজ দেশের মায়ায় মার্কির যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে ১৯৮৫ সালে নিজ জন্মভূমি শারকিয়া প্রদেশের জাগাজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে যোগদানের উদ্দেশে মিসর ফিরে আসেন। তিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি ১৯৮৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত জাগাজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্বপালন করেন।
এরমধ্যে ২০০০ সালে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মুরসি। সে সময় রাজনৈতিকভাবে রাষ্ট্র কর্তৃক মুসলিম ব্রাদারহুড নিষিদ্ধ থাকায় মোহাম্মদ মুরসি মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্য হলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেই নির্বাচনে অংশ নেন এবং নির্বাচিত হন।
পরে ২০১১ সালে মুসলিম ব্রাদারহুডের আদলে ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি (এফজেপি) গঠন করে পার্টির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন মুরসি। ২০১২ সালে মিসরে দুই পর্বে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। উভয়পর্বে সর্বমোট ৫২ শতাংশ ভোট পেয়ে মিসরের ইতিহাসে প্রথমবারের মত গণতান্তিকভাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ড. মোহাম্মদ মুরসি।
তিনি ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি (এফজেপি) থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেও নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তাকে জয়ী ঘোষণার পর মুসলিম ব্রাদারহুড ও এফজেপি থেকে মোহাম্মদ মুরসিকে অব্যাহতি দিয়ে মিসরের সর্বস্তরের মানুষের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
তবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসার একবছরের মাথায় ২০১৩ সালে অন্যায়ভাবে ড. মোহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করে মিসরের সেনবাহিনী। আর এই কাজে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও সেনাপ্রধান এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট আবদুল ফাত্তাহ আল সিসি।
পশ্চিমাবিশ্বের সহায়তায় প্রেসিডেন্টের পদ ক্ষমতাচ্যুত করার পর আটক ও প্রহসনমূলক বিচারের মুখোমুখি করা হয় ড. মোহাম্মদ মুরসিকে। সেই প্রহসনের বিচারে মুরসিকে একপর্যায়ে মৃত্যুদণ্ডও দেয়া হয়। পরবর্তীতে তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ বাতিল করে কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.