এরকম ভয়াবহ অতীত ভুলে কী স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন সিনটয়া ব্রাউন? by সাইকা তাসনিম

সিনটয়া ব্রাউন, সদ্য ৩০ বছরে পা দেওয়া এক তরুণী। ফেডারেল কয়েদীর ধূসর রং এর পোশাক পরে আদালতকক্ষে বসে থাকা এই মেয়েটির বয়স প্রথম দেখায় যে কেউ ১৬-১৭ বছর মনে করে ভুল করতে পারে। তবে আপাতদৃষ্টিতে নিষ্পাপ এই তরুণীর এটাই প্রথম আদালত দর্শন নয়, আদালতের বারান্দায় হাতকড়া পরে চক্কর কাটার অভিজ্ঞতা তার হয়ে গেছে সেই ১৫-১৬ বছর বয়স থেকেই। তাও কোন ছিঁচকে অপরাধের কারণে না, মানুষ খুনের দায়ে!
২০০৪ সালের আমেরিকার টেনেসীর একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা ছিল সিনটয়া ব্রাউনের কেস, যেটি নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে জোর তর্ক-বিতর্ক চলছে এখনো। ১৬ বছর বয়সী সিনটয়া ব্রাউন ঘুমন্ত অবস্থায় মাথার পেছন থেকে গুলি করেন জনি এলেন নামের এক ব্যক্তিকে, আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে। উল্লেখ্য যে সিনটয়া ব্রাউনকে জনি শারীরিক উপভোগের উদ্দেশ্যে ভাড়া করে তার বাসায় নিয়ে গিয়েছিল।
১৯৮৮ সালে জন্ম নেওয়া সিনটয়া ব্রাউনের কোন পিতৃপরিচয় পাওয়া যায়নি। সিনটয়ার মা জর্জিয়া হতাশায় সিনটয়াকে নিয়ে প্রেগন্যান্ট থাকার সময়ে প্রচন্ড পরিমান মদ খেতেন ও এলকোহোলিক হয়ে যান। পরবর্তীতে তার প্রভাব সিনটয়ার উপরে পড়ে। জন্মথেকেই সিনটয়া Fetal Alcohol Syndrome নামের মানসিক রোগে আক্রান্ত ছিলেন যার কারণে তার ব্রেইন ক্ষতিগ্রস্থ ছিল।
এছাড়াও সিনটয়ার আচার আচরণ ও ব্যবহারেও অসাম্যঞ্জস্যতা ছিল অন্যান্য যেকোন শিশুর তুলনায়। স্কুলেও অন্যান্য বাচ্চাদের চেয়ে পিছিয়ে ছিলেন। জর্জিয়া একটি মামলায় শাস্তিপ্রাপ্ত হয়ে জেলে যাওয়ার কারণে সিনটয়া ১৮ মাস বয়স থেকে তার পালক পরিবারে থাকতে শুরু করেন। সেখানেও দুর্ভাগ্য সিনটয়ার পিছু ছাড়েনি। পালক বাবার দ্বারা তিনি এবিউজের স্বীকার হন।
১৬ বছর বয়সে ট্রায়ালে সিনটয়া ব্রাউন
১২ বছর বয়সে বন্ধুদের সাথে এক বাসায় চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েন সিনটয়া আর জুভেনাইল কোর্টে তার জন্য জেলও খাটেন। পরবর্তীতে তার মানসিক অবস্থার কথা চিন্তা করে তার চিকিৎসার জন্য তাকে মেন্টাল হেলথ ইনস্টিটিউটে ভর্তি করানো হলে তিনি সেখান থেকে পালিয়ে যান। ১৬ বছর বয়সে একদম পুরোপুরিভাবেই তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। থাকতে শুরু করেন ২৪ বছর বয়সী গ্লারিয়োনের সাথে।
গ্লারিয়োন নিজে একজন মাদকাসক্ত ছিল ও একই সাথে কোকেইন বিক্রি করত। গ্লারিয়োন সিনটয়াকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করত। এই সময়েই সে সিনটয়াকে কোকেইনে আসক্ত করে ফেলে। গ্লারিয়োন সিনটয়াকে পতিতাবৃত্তিতে নামতে বাধ্য করে। শুধু তাই নয়,সে নিজেও তার উপর নানা ধরনের জোর খাটাতো। পতিতাবৃত্তি করে কামানো প্রতিটি টাকা সিনটয়াকে গ্লারিয়োনের হাতে তুলে দিতে হত।
২০০৪ সালে আগস্টের ৪ তারিখেও গ্লারিয়োন সিনটয়াকে বাধ্য করে বাইরে গিয়ে টাকা উপার্জন করে নিয়ে আসতে। আর সিনটয়াকেও সেই জন্য বের হতে হয়। টেনেসির রেড লাইট ডিস্ট্রিক্ট এরিয়ার সনিক ফুডকোর্টের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে ৪৪ বছর বয়সী জন এলেনের সাথে তার কথা হয়। এলেন তার কাছে টাকার অংক জানতে চাইলে সিনটয়া তার কাছে ২০০ ডলার চায়। পরবর্তীতে তা ১৫০ ডলারে দফারফা হয়। সিনটয়া তাকে হোটেলে যেতে বললেও এলেন নিজের বাড়িতেই তাকে  নিয়ে যায়।

এলেনের বাড়িতে যাওয়ার পথে কথায় কথায় এলেন তাকে জানায় যে তিনি একসময় আর্মিতে শার্পশুটার হিসেবে কাজ করতেন। এলেনের বাড়িতে গেলে সিনটয়া সেখানে খাবার খেয়ে নিজের গোসলও সেরে নেয়। গোসল থেকে বের হয়ে সিনটয়া এলেনের ব্যবহারে কিছুটা অস্বাভাবিকতা লক্ষ করেন। এলেন তাকে নিজের বন্দুকের কালেকশন দেখায়। এলেন সিনটয়ার সাথে ঘনিষ্ঠ হতে চাইলে সিনটয়া তাকে ঘুমিয়ে পড়তে বলে নিজেও শুয়ে পড়ে।
কিছুক্ষন পর সিনটয়া খেয়াল করে যে এলেন হাত বাড়িয়ে কিছু একটা নিতে চাচ্ছে কিংবা কিছু করতে চাচ্ছে। তখনই সিনটয়া ভয় পেয়ে যায়। সিনটয়ার মাঝে ধারণা ঢুকে হয়ত এলেন তাকে মেরে ফেলতে চায় কিংবা নির্যাতন করবে। আর সেই ভয় থেকে সিনটয়া তার পার্স ব্যাগ থেকে ছোট পিস্তল বের করে যেটা তাকে গ্লারিয়োন দিয়েছিল সঙ্গে রাখার জন্য। আর সেই পিস্তল দিয়েই সে গুলি করে বসে। গুলি করার সাথে সাথেই এলেন মারা যায়। সিনটয়া সেখান থেকে পালিয়ে যায় কিন্তু অর্ধেক পথ গিয়ে তার মনে হয় যে খালি হাতে গ্লারিয়োনের কাছে গেলে, সে তাকে আবার নির্যাতন করবে। তাই আবার সে এলেনের বাসায় যায়। হাতের সামনে এলেনের ওয়ালেট সহ যা কিছু পায়, তা নিয়েই এলেনের ট্রাক চালিয়ে সে পালিয়ে চলে আসে। এলেনের ট্রাক ওয়ালমার্টে পার্ক করে সিনটয়া নিজেই পুলিশের কাছে  তার কথা জানায়।
জনি মিশেল এলেন
বিচার শেষে সিনটয়ার মার্ডার চার্জ ও ডাকাতির অভিযোগে যাবজ্জীবন জেল হয়ে সিনটয়ার। অন্যান্য আর সব কয়েদীদের মত হয়ত সিনটয়াও সারাজীবন জেলে থেকে যেত। কিন্তু ঘটনার মোড় ঘুড়ে যায় ২০১১ সালে, সিনটয়ার জীবনের উপর তৈরী করা ডকুমেন্টরি “Me facing life” এর পর থেকে। এই ডকুমেন্টরির মাধ্যমেই সবার নজরে চাইল্ড ট্র্যাফিকিং ও প্রস্টিটিউশনের কথা সবার আসে একই সাথে সিনটয়ার দুর্ভাগ্যজনক জীবনের কথাও উঠে আসে। শুধু সিনটয়া নয় বরং সিনটয়ার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যদেরই রয়েছে মানসিক সমস্যা। কিন্তু বিচারাধীন অবস্থায় তা প্রকাশ পায়নি। সিনটয়ার মানসিক অসুস্থতার কথাও ড্যানিয়েল এইচ বার্ম্যান ইনকর্পোরেশন এর তৈরী এই ডকুমেন্টারিতে প্রকাশ পায়।
বিভিন্ন সাইকিয়াট্রিস্টদের পরীক্ষার পরে জানা যায় যে অন্যান্য সবার সিনটয়ার মানসিক অবস্থা সবার মত এক নয়। বরং ২৩-২৪ বছর বয়সে সিনটয়ার মানসিক অবস্থা একটা ১০-১৪ বছর বয়সী বাচ্চার মত। ২০১৫ সালে সিনটয়া লিপসকম্ব ইউনিভার্সিটি থেকে তার এসোসিয়েট ডিগ্রি অর্জন করেন। সিনটয়ার এডভোকেটদের মতে জেলে থাকা অবস্থায় সিনটয়া নিজের মাঝে অনেক পরিবর্তন এনেছেন। অন্য সবার মত তিনি এখন স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে চান।
সম্প্রতি ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে সিনটয়ার কেস আবার সবার সামনে উঠে আসে। বিভিন্ন এ-লিস্ট সেলিব্রেটিরা সিনটয়ার ক্লেমেন্সির জন্য আবেদন করে। তার মধ্যে সংগীতশিল্পী রিহানা, রিয়েলিটি সেলিব্রেটি কিম কারদেশিয়ান, অভিনেত্রী এ্যাশলে জুড অন্যতম। শুধু সেলিব্রেটি নয় বরং বিভিন্ন কংগ্রেসম্যান ও টেনেসির আইনজীবিরা সিনটয়ার জন্য আবেদন করেন।
অবশেষে সিনটয়ার ক্লেমেন্সির এই আবেদন টেনেসি সরকার মঞ্জুর করে। এই বছরের আগস্টের ৭ তারিখ ১৫ বছরের কয়েদীজীবন শেষে সিনটয়া আবার নতুন করে স্বাভাবিকভাবে সবার মত করে জীবন শুরু করতে পারবে সেই আশা আর শুভকামনাই আমরা করতে পারি।

No comments

Powered by Blogger.