দক্ষিণ এশিয়ার ঐতিহ্যবাহী ঘাসের মাদুর by ড. রেঅপামুদ্রা মৈত্র বাজপাই

সম্প্রতি অবসরে যাওয়া প্রখ্যাত আমলা সিলেটি-বংশোদ্ভূত গুরুসাদে দত্ত বাংলার লোককলা ও শিল্প রক্ষায় ভূমিকা রাখার জন্য সুপরিচিত।
বাংলার হস্তশিল্পের গুরুত্ব সম্পর্কে তিনি লিখেছেন যে এই অঞ্চলের লোকজ শিল্প সাধারণ কৃষকদের আনাড়ি হাতের শিল্প নয়, বরং তা প্রতিটি ব্যক্তির সামাজিক মাত্রার মধ্যে তার শিক্ষা ও অবস্থানের মাত্রার বহিঃপ্রকাশ। আর কারিগর ও তাদের পৃষ্ঠপোষকেরা ভিন্ন কেউ নন, বরং একই সাংস্কৃতিক ধারার অংশবিশেষ।
হস্তশিল্পের সাথে জড়িতরা কোনো ভৌগোলিক আয়তনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, তাদের উপস্থিতি অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। আর এই শিল্প বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে যোগসূত্র সৃষ্টি করে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্লাটফর্মও শিল্পীদের মধ্যে সংযোগ সাধনের কাজ করে। এ ধরনের একটি প্লাটফর্ম হলো ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ প্লাটফর্ম।

গত ৬ ডিসেম্বর দক্ষিণ কোরিয়ার জেজু আইল্যান্ডে এর দ্বাদশ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ইন্টারগভার্নমেন্টাল কমিটি অব ইউনেস্কো বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী শীতল পাটিকে ইনটেনজিবল কালচারাল হেরিটেজ (আইসিএইচ) হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে। শিল্পপ্রেমীদের কাছে এটি একটি বিরাট মুহূর্ত।
শীতল পার্টির অন্তর্ভূক্তির ফলে তালিকায় বাংলাদেশের পণ্যসংখ্যা দাঁড়াল চারে। অন্যগুলো হলো পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা (২০১৬), জামদানি শাড়িতে ঐতিহ্যবাহী নক্সা (২০১৩) ও বাউল সঙ্গীত (২০০৮)।
শীতল পাটি বোনা হয় বেত-জাতীয় গাছের আঁশ থেকে। এই গাছটি মোস্তাক, পাটিপাতা, পাটিবেত ও পৈতারা। এই গাছটি সিলেট, সুনামগঞ্জ, বরিশাল, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফেনি, চট্টগ্রামে জন্মায়।
শীতল পাটি সত্যিকার অর্থেই একটি বিরাট শিল্পকর্ম। এই কাজে নারীরা বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এই শিল্পের সাথে জড়িতরা তাদের অঞ্চলের নক্সা ও মটিফকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন।

আফগানিস্তান পরিচিত তার চমৎকার ছোট গালিচা ও কার্পেটের জন্য। বিশেষ করে দক্ষিণ আফগানিস্তানে উষ্ণ জলবায়ু এই শিল্পের জন্য বিশেষ ভূমিকা পালন করছে।
পার্বত্যপূর্ণ ভুটানে বাঁশ হস্তশিল্পের জন্য প্রধান কাঁচামাল। মধ্য ও পশ্চিম ভুটানে জন্ম নেয়া ছোট বাঁশ ব্যবহৃত হয় ম্যাট, বেড়া বা ছাদ দেয়ার কাছে।
ভারতে শুকনা ঘাস, বেত ও বাঁশের মাদুর-বোনা বেশ জনপ্রিয়। মেঘালয়ে বাঁশের স্লিপিং ম্যাটের বেশ কদর রয়েছে। ত্রিপুরার চাটাই পর্যটকদের মধ্যেও চাহিদা রয়েছে।
শীতল পাটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরাতেও পৌঁছে গেছে। কড়া/কড়াই নদীর তীরে জন্মানো ঘাস দিয়েও একই ধরনের পাটি বোনা হয় অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু ও কর্নাটকে। কেরালায় পাট দিয়ে বানানো কার্পেট বেশ জনপ্রিয়।
মালদ্বীপে একসময় থুনদুকুনা ম্যাট রাজকীয় উপহার হিসেবে পরিচিত ছিল। মালদ্বীপের সুলতানেরা ডাচ ও ব্রিটিশ গভর্নরদের এ ধরনের মূল্যবান উপহার দিতেন। নারীরাই এই ম্যাট তৈরির সাথে জড়িত ছিল। বর্তমানে দাধধু দ্বীপেই মূলত এসব ম্যাট তৈরি হয়। তবে যে নলখাগড়া দিয়ে এসব ম্যাট তৈরি হয় সেগুলো পাওয়া যায় ফিয়োরি দ্বীপে।

নেপালে খড় থেকে ম্যাট বানানো হয়। স্থানীয়রা একে বলে গুনদ্রি। একসময় নারীরাই জড়িত ছিল এই শিল্পে। এখন পুরুষেরাও হাত লাগিয়েছে। নভেম্বর-ডিসেম্বরে ধান কাটা হয় সেখানে। তারপর খড় সংগ্রহ করে মাঘ ও ফাগুন মাসে বোনা হয় এসব ম্যাট। তাদের কাজ দেখে মনে হয় খুব সহজ। কিন্তু করতে গেলে টের পাওয়া যায়, কত দক্ষতার প্রয়োজন এতে।
পাকিস্তানের নদীগুলোর ধারে এক ধরনের নরম ঘাস জন্মায়। এগুলো জায়নামাজ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। নারী-পুরুষ সবাই ঘাসের জায়নামাজ তৈরির সাথে জড়িত।
শ্রীলঙ্কায় নলখাগড়া থেকে তৈরি করা হয় জটিল ম্যাট। এসব ম্যাট মেঝ ঢাকতে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। নানা ফুল-পাখির নক্সা আঁকা থাকে এসব ম্যাটে।

No comments

Powered by Blogger.