কাশ্মীর নিয়ে যে প্রশ্নটা কখনও করা হয় না by চার্লস গ্লাস

১৯৯৮ সালে সিআইএ ভারতের উপর নজরদারি বাড়ায় যাতে তারা পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার ব্যাপারে তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে। সংস্থাটি স্যাটেলাইট, যোগাযোগ সরঞ্জাম এবং এজেন্ট নিয়োগের মাধ্যমে রাজস্থান রাজ্যের পোখরান পারমাণবিক ফ্যাসিলিটির উপর নজর রাখে। ভারত কোন ওয়্যারহেডের বিস্ফোরণ করতে পারেনি, যেটা হলে পাকিস্তান তাদের বিরুদ্ধে আইনী পদক্ষেপ নিতো, এবং যুক্তরাষ্ট্রের সেখানে আগাম জানার কোন উপায়ও থাকতো না। বা যুক্তরাষ্ট্র অন্তত সেটাই ভেবেছিল।

১৯৯৮ সালের ১১ মে ওয়াশিংটন চমকে যায়, যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী ঘোষণা দেন যে, তার দেশ একটি নয়, বরং পাঁচটি পারমাণবিক ওয়্যারহেডের বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে পোখরানে। বাজপেয়ী ঘোষণা দেন, “ভারত এখন একটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ”। আর জেফরি স্মিথ দুই দিন পর দ্য ওয়াশিংটন পোস্টে জানিয়েছিলেন যে, ভারতের পারমাণবিক কর্মসূচির নজরদারির জন্য যে সিআইএ বিশ্লেষকদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, তারা এ ধরনের পরীক্ষা হতে পারে বলে ধারণা করেনি এবং তারা সেইভাবে সজাগ ছিল না বলে বেশ কিছু কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এক সিনিয়র কর্মকর্তার মতে, তারা বাড়িতে ঘুমাচ্ছিলেন এবং পরদিন সকালে কাজে ফেরার আগ পর্যন্ত তারা স্যাটেলাইট ছবিও যাচাই করেনি। মার্কিন সিনেটার রিচার্ড শ্যালবি এই অবহেলাকে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার ১০ বছর বা আরও দীর্ঘ ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হিসেবে মন্তব্য করেন।

২৮ মে পাকিস্তান তাদের পাঁচটি বোমা পরীক্ষার মাধ্যমে এর জবাব দেয়। যাদুর বাক্স খুলে যায় এবং এশিয়ায় গণ ধ্বংসের জন্য একটা বড় হুমকি সৃষ্টি হয় যদি পাকিস্তান আর ভারতের সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর মুখোমুখি হয় কখনও, যে রেখা দিয়ে বিতর্কিত কাশ্মীর এলাকায় দুই দেশ তাদের সীমানা আলাদা হয়েছে। এক বছর পর সে ধরনের ঘটনা ঘটে যখন পাকিস্তানের আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যরা কাশ্মীরী বিদ্রোহী জিহাদী সেজে কাশ্মীরের কার্গিল এলাকা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ রেখা অতিক্রম করে। ভারতীয় সেনাবাহিনী তাদের মুখোমুখি হয় এবং মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা দেখতে পায় যে, পাকিস্তান কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্রাদিক যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে নিচ্ছে। আমেরিকান কূটনীতিক ব্রুস রিডেল তার তথ্যবহুল বই ‘অ্যাভয়ডিং আরমাগেডন: আমেরিকা, ইন্ডিয়া, এন্ড পাকিস্তান টু দ্য ব্রিঙ্ক অ্যান্ড ব্যাক’ এ লিখেছেন, “ভারত ও পাকিস্তান কারগিল নিয়ে যে যুদ্ধটা লড়েছে, সেটা পারমাণবিক যুদ্ধের দিকে যাওয়ার ‍উপক্রম হয়েছিল”। পারমাণবিক যুদ্ধ হয়নি, কারণ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন পাকিস্তানী প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে তার সেনা প্রত্যাহার করতে বলেছিলেন। শেষ মুহূর্তে সেনা প্রত্যাহার করা হয়েছিল তখন।

সিআইএ যদি ভারত ও পাকিস্তানের উপর এখনও নজরদারি অব্যাহত রাখে, তাহলে সেটা ১৯৯৮ সালের তুলনায় আরও উন্নত হওয়ার কথা। ২০১৯ সালে ভারত কাশ্মীরের আইনগত স্বায়ত্তশাসন বিলুপ্ত করার পর দুই দেশের মধ্যে যে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে, সেখানে এটা দেখা হবে না যে, দুই দেশ কোন পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা করেছে কি না, বরং দুর্ঘটনা ঘটলে দেখা যাবে যে পারমাণবিক বোমায় বহু মিলিয়ন মানুষ মারা যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও অধিকাংশ আন্তর্জাতিক মহল কাশ্মীরকে ভারতের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ বা ‘দ্বিপাক্ষিক ইস্যু’ হিসেবে বর্ণনা করেছে। কিন্তু বাস্তবতা তা নয়। কোন ধরনের পারমাণবিক সঙ্ঘাত হলে সেটা আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার বিঘ্ন ঘটাবে। ভারত ও পাকিস্তানী সশস্ত্র বাহিনীর কাছে কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্রাদি রয়েছে এবং স্থানীয় কমান্ডাররা সেগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে জনবহুল এলাকাগুলোতে ব্যবহার করতে পারে। ১৯৪৫ সালে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক বোমা ব্যবহারের পর এটা হবে প্রথম এ ধরনের অস্ত্রের ব্যবহার।

১৬ আগস্ট পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের আশঙ্কা আরও বেড়ে গেছে। এদিন ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং ভারতের ‘নো ফার্স্ট ইউজ’ নীতি পরিত্যাগ করে এই টুইটে জানিয়েছেন, “ভারত কঠোরভাবে এই নীতি অনুসরণ করে এসেছে। ভবিষ্যতে কি হবে, সেটা পরিস্থিতিই বলে দেবে”। পরিস্থিতি খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়।

কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল এবং সেখানে ব্যাপক দমন অভিযানের কারণে কাশ্মীরে যদি বিদ্রোহ আবার মাথাচাড়া দেয়, তাহলে এ জন্য পাকিস্তানকে দায়ি করবে ভারত, কারণ বহু বছর ধরে তাদের সহায়তা করে এসেছে পাকিস্তান। ২০১৮ সালের আগস্টে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন ইমরান খান এবং ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে হস্তক্ষেপের যে ধারা তার পূর্বসূরীরা চালু করেছেন, সেটা তিনি অনুসরণ করছেন না।

কাশ্মীরে মোদির ষাঁড়াশি অভিযানের পর খান এ ব্যাপারে মধ্যস্থতার জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, জাতিসংঘ, বিভিন্ন মুসলিম দেশের নেতা ও সরকারপ্রধানদের আহ্বান জানিয়েছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উপর যাদের প্রভাব রয়েছে। তার আহ্বানে কেউ সাড়া দেয়নি বলে সম্প্রতি তিনি জানিয়েছেন। তার সমস্যা হলো, যুদ্ধ এড়িয়ে কাশ্মীরের মুসলিমদের সহায়তা করার পথ খুঁজছেন তিনি। সারা ভারতেই মুসলিমদেরকে এখন নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে হচ্ছে এবং মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকারের চাপের ভয়ের মধ্যে বাস করছেন তারা।

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্বন্দ্বের শুরু হয় ফেব্রুয়ারিতে। কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলার পর দুই দেশের মধ্যে পাল্টাপাল্টি বিমান হামলা শুরু হয় এবং পাকিস্তান ভারতের একটি বিমান ভূপাতিত করে এবং বিমানের পাইলটকে আটক করে। পরে ইমরান খান ভারতীয় পাইলটকে ফেরত দিলেও মোদি সমঝোতার কোন মনোভাব দেখাননি। তার সরকার কাশ্মীর নিয়ে আলোচনারও কোন আগ্রহ দেখায়নি। অথচ কাশ্মীরের জনগণকে ১৯৪৭ সালে গণভোটের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। সেই ভোট হয়নি, তবে বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়েছে। প্রশ্ন হলো কাশ্মীরের জনগণ কি চায়? যে অঞ্চলের দুই-তৃতীয়াংশ নিয়ন্ত্রণ করছে ভারত, এক তৃতীয়াংশ রয়েছে পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে। ১৯৪৭ সালে এরা ঘরবাড়িহারা হয়েছিল, এই কাশ্মীরীরা কি চায়? কেউ তাদেরকে সেটা জিজ্ঞাসা করছে না, কিন্তু তাদেরকে রক্ষার জন্য সেটাই সম্ভবত একমাত্র পথ, আর পৃথিবীকে পারমাণবিক যুদ্ধ থেকে বাঁচানোর জন্যও সেটাই একমাত্র উপায়।

No comments

Powered by Blogger.