বাংলাদেশের পানি সঙ্কট : একটি জেন্ডার কাহিনী by নেহা থিরানি বাগরি

বিয়ের সময় খাদিজা রহমানের বয়স ছিল ১৪ বছর। শ্বশুরবাড়ি উপকূলীয় সাতক্ষীরা জেলায়। তখনো তিনি বুঝতে পারেননি, পানির কষ্ট তার জীবনে কী দুর্ভোগটাই না নিয়ে আসছে। বিয়ের ১০ বছর পর এখন প্রতিটি দিনই এই সঙ্কট তাকে ভোগাচ্ছে।
তার গ্রামের নাম কচুখালি, সুন্দরবনের কাছে। তাকে কেবল পানির সঙ্কটেই ভোগায় না, পানির প্রাচুর্যও তাকে যন্ত্রণায় ফেলে। একদিকে খাবার এবং দৈনন্দিন কাজের পানি নেই, আবার জোয়ার কিংবা ঝড়ের সময় সাগরের নোনা পানি সবকিছু ভাসিয়ে দেয়। এমনকি সাধারণ পানির পুকুরগুলোও তখন লবণে ভরে যায়। পানির বিশাল উপস্থিতিতেই তখন পান করা আর গৃহস্থালী কাজের পানি হয়ে যায় দুর্লভ।
খাদিজা জানান, আমরা লবণাক্ত পানি পান করতে পারি না, এ দিয়ে গোসল করা যায় না। বাসন-পেয়ালা এই পানিতে ধুলে সেগুলো নষ্ট হয়ে যায়।
খাবার পানির এই সঙ্কট বিশেষভাবে নারীদের ভোগায় সবচেয়ে বেশি। প্রচলিত রীতিনীতি অনুযায়ী, নারীদেরই এই পানি সংগ্রহ করতে হয়।
বর্ষাকালে একদিক থেকে কষ্টটা কম হয়। তবে বৃষ্টির সময় তাদেরকেই প্লাস্টিকের বালতি, ড্রামে পানি ধরে রাখতে হয়। কিন্তু শুষ্ক মওসুমে পানির স্তর নেমে যায়। পানির আকাল দেখা দেয় তখন। ওই সময় কখনো কখনো তাকে পানি আনতে এক কিলোমিটার হেঁটে যেতে হয়। প্রচন্ড গরমে ঘামে ভেজা পোশাক পরেই তাকে ওই সামান্য পানি সংগ্রহ করতে হয়।
ওই এলাকার ৭০ ভাগ লোক পান এবং গৃহস্থালী কাজের পানির জন্য পুকুরের ওপর নির্ভর করে থাকে। ভূগর্ভের পানি লবণাক্ত হয়ে পড়ায় তা ব্যবহার করা যায় না।
বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্স স্টাডিজের ফেলো গোলাম রাব্বানির মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পানি নিয়ে প্রতিদিনকার সংগ্রাম তীব্র হয়েছে। গত ৩৫ বছরে বাংলাদেশের প্রায় ২৬ ভাগ এলাকায় লবণাক্ততার বিস্তার ঘটেছে।
বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০৫০ সাল নাগাদ নদী ও ভূগর্ভের পানিতে লবণের পরিমাণ ভয়াবহ মাত্রায় বেড়ে যাবে। ফলে খাবার পানির সঙ্কট আরো তীব্র হবে। এতে করে অন্তত ২৯ লাখ গরিব মানুষের জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পানির অভাবে ইতোমধ্যেই ২৫ লাখ লোক ভুগতে শুরু করেছে।
লবণমুক্ত পানির অভাবে যে কেবল খাদিজাদের জীবনই বিষিয়ে ওঠেছে, তা-ই নয়, ধানচাষসহ কৃষিকাজেও ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে।
পানির কষ্ট থেকে মুক্তি পেতে অনেকে তো ঢাকামুখী রাস্তা ধরেছে। অনেকের মতো খাদিজার স্বামী হাবিবুর রহমানও শেষ পর্যন্ত রাজধানী শহরে আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি কখনো পোশাক কারখানা, কখনো রিকশা চালানো, কখনো নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কাজ করেন। যা আয় হয়, তার একটি অংশ তিনি পাঠান খাদিজার কাছে।
প্রায় দুই দশক আগে ১৫ বছর বয়সে হাবিবুর ঢাকায় এসেছিলেন। তখনো তিনি কচুখালিতে কর্মসংস্থান করতে পারেননি।
কাজ না থাকায় হাবিবুরদের মতো আরো অনেক তরুণ শহরে পাড়ি দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছে না।
বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় চার লাখ লোক ঢাকায় পাড়ি জমিয়েছে। এ ধরনের ১৬০টি বাড়িতে সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে, তাদের ৬৬ ভাগ ঢাকা এসেছেন জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট সঙ্কটের কারণে।
আর খাদিজাদের মতো যারা থেকে গেছেন, তারা পানির কষ্ট ছাড়াও নানা ধরনের দুর্ভোগে আছেন। স্কুল, চিকিৎসা ইত্যাদি সমস্যা তাদের কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। শিশুরা পর্যন্ত নানা স্বাস্থ্যগত জটিলতায় ভুগছে। এই খাদিজার ৫ বছরে ছেলে মুত্তাকিন আমির প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ে। ডায়রিয়াসহ নানা রোগে আক্রমণ করে তাকে।
বিশ্বব্যাংকের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের উপকূল একটি ‘ফ্রন্ট লাইন।’ ২১০০ সাল নাগাদ বিশ্বজুড়ে যে কোটি কোটি লোক উদ্বাস্তু হবে, তাদের একটি অংশ হবে বাংলাদেশে।
এই সমস্যার সমাধান কী? বাংলাদেশ সরকার মনে করে না যে, ঘরবাড়ি ছেড়ে গেলেই সমাধান পাওয়া যাবে। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব নুরুল কাদির বলেন, এসব মানুষ খুবই সংগ্রামী। তারা এখানে জন্মগ্রহণ করেছে, এখানেই বেড়ে ওঠেছে। তারা জানে কিভাবে বাঁচতে হয়। তারা অন্য কোথায় যেতে চায় না। যখন আর কোনো উপায় থাকে না, তখনই কেবল চলে যায়।
তিনি জানান, সরকার এখন চাচ্ছে তারা যেন পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে চলতে পারে, তার ব্যবস্থা করা। সরকার বিকল্প কর্মসংস্থানের চেষ্টা করছে। সাগরের পানি যাতে প্রবেশ করতে না পারে, বৃষ্টির পানি যাতে ধরে রাখা যায় সে চেষ্টা চলছে। তাছাড়া ড্রেনেজব্যবস্থা ভালো করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, যাতে লবণাক্ত পানি পুকুরে না জমে।
তবে জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব উদ্যোগ সাময়িকভাবে কাজে লাগলেও চূড়ান্ত পর্যায়ে অকার্যকর।

No comments

Powered by Blogger.