তিতাসের মৃত্যু: আধাঘণ্টা অনুরোধের পর অ্যাম্বুলেন্স ফেরিতে, ছাড়ে দুই ঘণ্টা দেরিতে by সুলতান মাহমুদ ও জহিরুল ইসলাম খান

তিতাস ঘোষ
মামাতো ভাই মিঠুন ঘোষের বিয়েতে যাওয়ার সময় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার হয় ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র তিতাস ঘোষ ওরফে অভিক। বুধবার (২৪ জুলাই) সন্ধ্যার এ ঘটনায় মাথা ও বুকে বড় ধরনের আঘাত পাওয়ায়  তাকে নেওয়া হয় নড়াইল সদর হাসপাতালে। রাতেই তাকে পাঠানো হয় খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাকে ঢাকায় রেফার করেন চিকিৎসকরা।  বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তিতাসকে নিয়ে ঢাকার পথে রওনা হন স্বজনরা। রাত ৮টার দিকে কাঁঠালবাড়ি ফেরি ঘাটে পৌঁছায় তিতাসকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স। ঘাটে তখন ছিল ‘কুমিল্লা’ নামের একটি ফেরি। এ ফেরির সিরিয়াল পাওয়ার জন্য পরিবার সদস্যরা অনেক কাকুতি-মিনতির করতে থাকেন। রোগী বিবেচনা করে আধঘণ্টা পর অ্যাম্বুলেন্সটিকে ফেরিতে উঠতে দেওয়া হয়। কিন্তু, যানবাহনে ভরে যাওয়ার পরও ফেরিটি ছাড়া হয়নি। প্রশাসনের নির্দেশে একজন ‘ভিআইপি’র জন্য অপেক্ষা করে ফেরিটি। প্রায় সোয়া দুই ঘণ্টা অপেক্ষার পর সেই ‘ভিআইপি’ এলে তাকে নিয়ে রাত ১০টা ৪০ মিনিটে ফেরিটি রওনা হয়। এদিকে অসুস্থ তিতাসের অবস্থা অ্যাম্বুলেন্সেই সংকটাপন্ন হতে থাকে। ফেরি মাঝ নদীতে পৌঁছাতে না পৌঁছাতে তার মৃত্যু হয়। তিতাসের পরিবারের সদস্য এবং ফেরি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এই তথ্য পাওয়া যায়।

তিতাস কালিয়া পৌরসভার বড়কালিয়া এলাকার তাপস ঘোষের ছেলে এবং কালিয়া সরকারি পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। ৯ বছর আগে স্বামী তাপস ঘোষের (৪২)  মৃত্যুর পর ছেলে তিতাস ঘোষ ওরফে অভিক এবং মেয়ে তানিশা ঘোষকে নিয়েই জীবন কাটাচ্ছিলেন বিধবা সোনামনি ঘোষ। কিন্তু ছেলের মৃত্যুর পর এখন তিনি বাকরুদ্ধ। সন্তানের অস্বাভাবিক মৃত্যুকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না। ছেলের নাম ধরে ডাকছেন, বারবার জ্ঞান হারাচ্ছেন।

তিতাসের একমাত্র বোন কালিয়া শহীদ আব্দুস সালাম ডিগ্রি কলেজের স্নাতক শ্রেণির ছাত্রী তানিশা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, বুধবার রাতে বরযাত্রী হয়ে মোটরসাইকেলে করে কালিয়া থেকে যশোর যাচ্ছিল তিতাস। রাত ৮টার দিকে নড়াইল-কালিয়া সড়কের নড়াইল সদর উপজেলার আউড়িয়া মোড়ে পৌঁছালে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মোটরসাইকেলটি রাস্তার পাশে খাদে পড়ে যায়।এ দুর্ঘটনায় তিতাস এবং মোটরসাইকেলের অপর আরোহী তিতাসের কাকাতো ভাই অর্নিবাণ ঘোষ সনু (৩৪) আহত  হন। দুই জনের মধ্যে তিতাসের অবস্থা ছিল গুরুতর। তাকে প্রথমে নড়াইল সদর হাসপাতালে এবং অবস্থার অবনতি ঘটলে  খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখান থেকে তাকে ঢাকায় রেফার করা হয়।

তানিশা জানান, দুই জন ডাক্তারসহ গুরুতর অসুস্থ তিতাসকে একটি অ্যাম্বুলেন্সে  করে তিনি, তার মা, তার স্বামী ও মামা বৃহস্পতিবার (২৫ জুলাই) ঢাকার উদ্দেশে  রওনা হন। অ্যাম্বুলেন্সটি রাত ৮টার দিকে কাঁঠালবাড়ি ঘাটে পৌঁছায়। তানিশা বলেন, ‘ঘাটে পৌঁছার পর অ্যাম্বুলেন্স চালকসহ আমরা সবাই ঘাটে কর্তব্যরত পুলিশ এবং ফেরির লোকজনকে বার বার অনুরোধ করি অ্যাম্বুলেন্সটিকে ফেরিতে ওঠার সুযোগ দিতে। বার বার কাকুতি-মিনতি করতে থাকি। যতবারই অনুরোধ করা হয়েছে ততবারই আমাদের বলা হয়েছে ফেরিটি ভিআইপি’র জন্য। একজন  ভিআইপি আসবেন। তিনি আসার পর ফেরিটি ছাড়বে। ঘাটে আধা ঘণ্টার বেশি অপেক্ষার পর বারবার অনুরোধের কারণে অ্যাম্বুলেন্সটিকে ফেরিতে ওঠার সুযোগ দেওয়া হয়।’

তিনি আরও জানান, ‘ফেরিতে ওঠার পরও আমরা বসে ছিলাম। ভিআইপি না আসায় আরও দুই ঘণ্টার মতো অপেক্ষা করতে হয়। রাত  সাড়ে ১০টার পর ওই ভিআইপির গাড়ি ফেরিতে উঠলে ফেরিটি মাওয়াঘাটের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। ততক্ষণে মস্তিকে প্রচুর রক্তক্ষরণে তিতাসের দেহ নিস্তেজ হয়ে পড়ে। তিন ঘণ্টা অপেক্ষার পর মাওয়াঘাটের প্রান্তে ফেরি ভিড়েছে ঠিকই, কিন্তু তিতাসের প্রাণ এরইমধ্যে না ফেরার দেশে চলে গেছে।’

তানিশা বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। তাই ফেরি কর্তৃপক্ষ অবহেলা করেছে। আমার ভাইয়ের মৃত্যুর জন্য দেরিতে ফেরি ছাড়াই দায়ী। ফেরি দেরিতে ছাড়ার জন্য দায়ী সংশ্লিষ্ট সবার বিচার চাই।’

তিতাসের মামা বিজয় ঘোষ বলেন, ‘প্রায় আধা ঘণ্টা অনুরোধ করে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে আমাদের ফেরিতে উঠতে হয়। একজন ভিআইপি আসবেন সেই জন্য বসে থাকতে হয় দুই ঘণ্টার বেশি সময়। কিন্তু আমাদের যা সর্বনাশ তা হয়ে গেছে। তিন ঘণ্টা ফেরিতে থাকার পর মাওয়াঘাটের পৌঁছেছি  ঠিকই, কিন্তু তিতাসের প্রাণ প্রদীপ এরইমধ্যে নিভে গেছে।’

ফেরি সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন

এদিকে ফেরি সংশ্লিষ্টরা জানান, কাঁঠালবাড়ি ১নং ফেরিঘাট দিয়ে অ্যাম্বুলেন্স ও জনপ্রতিনিধি, সরকারি বিভিন্ন দফতরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার দিয়ে পারাপার করা হয়। গত বৃহস্পতিবার এই ঘাটেই আসে সড়ক  দুর্ঘটনায় আহত   স্কুলছাত্র তিতাস ঘোষকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স। ফেরিটি আটকে রাখা হয় নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব পার হবেন-এই তথ্যের ভিত্তিতে।  নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের স্টিকার লাগানো একটি নোয়াহ গাড়ির জন্য ঘাটে অপেক্ষা করছিলেন ফেরিঘাটের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। বিআইডব্লিউটিসি’র সরাসরি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ হিসেবে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় এখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরির নিয়ন্ত্রক। সে কারণে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এসে ফেরি না পেলে কী হবে সেই আতঙ্কে ছিলেন তারা।

তবে জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ঘাটের ম্যানেজারকে কল  দেওয়া হয়েছিল যুগ্ম-সচিব পদমর্যাদায় সরকারের অ্যাক্সেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রকল্পের জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে কর্মরত আব্দুস সবুর মণ্ডলের ব্যাপারে। তার পিরোজপুর থেকে ঢাকা যাওয়ার কথা ছিল।

মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি ঘাটের ব্যবস্থাপক সালাম হোসেন জানান, ‘সকাল থেকে ঘাটের ডিউটি এবং এরপর মাদারীপুর গিয়ে জেলা প্রশাসনে ঈদে ঘাট ব্যবস্থাপনার মিটিংয় শেষে আবার ঘাটে এসে দায়িত্ব পালন করে ৮টার দিকে  খাওয়ার জন্য বাইরে যাই। এ সময় ঘাটে পারাপারের দায়িত্বে ছিলেন উচ্চমান সহকারী (ইউডিএ) ফিরোজ আলম। এই ঘাট দিয়ে একজন  ভিআইপি যাবে এই তথ্য তার কাছে ছিল। অ্যাম্বুলেন্সে জরুরি রোগী আছে তা তিনি জানতেন না। ওই স্কুলছাত্রের পরিবারের সদস্যরা যখন ঘাটের পুলিশ বুথে যান, সেখানকার টিএসআই নজরুল হোসেন  কল  দেওয়ার পরই ফেরিটি চালুর ব্যবস্থা করেন ইউডিএ ফিরোজ আলম। মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যেই ফেরিটি ছাড়া সম্ভব হয়।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঘাটের একাধিক সূত্র জানায়, ফেরি ঘাটে কর্মরত কর্মীদের সংকটের কারণে এখানে একটি দালালচক্র কাজ করে। এখানে ফেরিতে অ্যাম্বুলেন্স ও ভিআইপিদের পারাপারের ফাঁকে অনেক মাইক্রোবাস ও প্রাইভেট গাড়ি ৫শ’ থেকে ২ হাজার টাকার বিনিময়ে তারা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পার করিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে। যেই কারণে নিহত স্কুলছাত্র তিতাস ঘোষকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স ঘাটে পৌঁছালেও তার পরিবারের লোকজন কোনও কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলতে পারেননি। তারা ঘাটের কর্মকর্তা হিসেবে যাদের সঙ্গে কথা বলেছেন তারা মূলত দালালচক্রের সদস্য। তাই তারা অ্যাম্বুলেন্সের রোগী বহনের বিষয়ে কোনও গুরুত্ব দেয়নি।

কাঁঠালবাড়ি ফেরিঘাটের ব্যবস্থাপক সালাম হোসেন আরও দাবি করেন, ‘আমাদের পক্ষ থেকে অ্যাম্বুলেন্সের বিষয়টি জানার পরপরই মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যে ফেরিটি লোড করে ছেড়ে দিতে পেরেছি। ওই স্কুলছাত্রের পরিবার যে অভিযোগ করেছে তিন ঘণ্টা পর ফেরি ছেড়েছে আসলে এটি ঠিক নয়। ঘাটের সবাই সবসময় অ্যাম্বুলেন্স পারাপারের ক্ষেত্রে সব সময়ই অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে আসে। এমনকি রোগী ছাড়া খালি অ্যাম্বুলেন্সও আমরা চলতি ফেরিতে উঠিয়ে দেই।’

সালাম হোসেন বলেন, ‘পদ্মায় স্রোতের কারণে ১৮টি ফেরির মধ্যে মাত্র ৮টি ফেরি চলাচল সম্ভব ছিল। দ্রুত পারাপারের কথা বিবেচনা করে ওই অ্যাম্বুলেন্সটিকে ভিআইপি ফেরিতে ওঠানো হয়। তবে ফেরি ছাড়তে স্বাভাবিক যে সময় লাগে তার বেশি দেরি করা হয়নি।’

এদিকে সোমবার নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম   খান জানান, যুগ্ম সচিব আব্দুস সবুর মণ্ডল নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা নন। তিনি এটুআই প্রকল্পের কর্মকর্তা। তার গাড়িতে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের স্টিকার থাকলে তা কোথা থেকে এলো সেই প্রশ্নও করেছেন তিনি।

মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক ওয়াহিদুল ইসলাম জানান, ‘যুগ্ম-সচিব আব্দুস সবুর মণ্ডল স্যার বৃহস্পতিবার ফেরি পারাপারের ব্যাপারে জানতে চেয়েছিলেন। আমি তখন ঘাটের পরিস্থিতি নিয়ে জেলা প্রশাসনের মিটিংয়ে উপস্থিত ঘাটের ব্যবস্থাপক সালাম হোসেনকে তার পারাপারের বিষয়ে খেয়াল রাখতে বলি। এছাড়া স্যারকে সালাম সাহেবের নম্বর দিয়ে দেই। এরপর আমি ঘাটের কাউকে কোনও  কল  দেইনি। আমার কলের কারণে ফেরি বন্ধ বা আটকে রাখার অভিযোগ সঠিক নয়। এ ধরনের কাজ আমার দ্বারা সম্ভব নয়।’

বিচার দাবি

এদিকে তিতাসের মৃত্যুর জন্য ফেরি কর্তৃপক্ষকে দায়ী করে এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিচারের দাবিতে কালিয়া সরকারি মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক ও কর্মচারীদের আয়োজনে সোমবার বেলা ১১টার দিকে কালিয়া উপজেলা সদরে মানব বন্ধন ও প্রতিবাদসভা অনুষ্ঠিত হয়। মানববন্ধন চলাকালে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন কালিয়া সরকারি পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিএম শুকুর আলী, সাবেক প্রধান শিক্ষক দেব কুমার ঘোষ, সহকারী প্রধান শিক্ষক তরুণ কান্তি মল্লিক, সহকারী শিক্ষক সালমা সুলতানা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সম্পাদক  মো. ইয়াসিন জনি প্রমুখ। মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরাও অংশগ্রহণ করে।
ফেরি কর্তৃপক্ষের বিচার দাবিতে নড়াইলে মিছিল

No comments

Powered by Blogger.