বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে গুরুত্ব পাবে অর্থনীতি ও রোহিঙ্গা ইস্যু by কামরান রেজা চৌধুরী

বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগের একটি প্রকল্পে বড় ধরনের সঙ্ঘাতের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থায়নের বিষয়ে চীনা নেতাদের সাথে আলোচনার জন্য চীন সফরে যাচ্ছেন।
চীনের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় উপকূলীয় শহর ডালিয়ানে অনুষ্ঠিতব্য ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডাব্লিউইএফ) বার্ষিক বৈঠকে অংশ নিতে ১ জুলাই ঢাকা ছাড়বেন হাসিনা। এরপর ৪ ও ৫ জুলাই তার চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াংয়ের সাথে বৈঠক করার কথা রয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা এ তথ্য জানিয়েছেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন ডিরেক্টর জেনারেল ফয়সাল আহমেদ বেনারনিউজকে বলেন, “ব্যবসা, বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও উন্নয়ন ইস্যু ছাড়াও প্রধানমন্ত্রী হাসিনা চীনা প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর সাথে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে কথা বলবেন”।
২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইন রাজ্যের সহিংসতা থেকে প্রাণ বাঁচাতে যে ৭৪০,০০০ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়, তাদেরকে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে চীন যাতে মিয়ানমারকে চাপ দেয়, সে বিষয়টি বিশেষভাবে চীনের কাছে উল্লেখ করবেন হাসিনা।
বুধবার তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন যে, রোহিঙ্গা সঙ্কটের কারণে বাংলাদেশের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে।
পার্লামেন্ট সদস্যদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “গৃহচ্যুত রোহিঙ্গা যারা মিয়ানমারে মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে, তাদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। তাদেরকে যদি শিগগিরই আমরা ফেরত পাঠাতে না পারি, তাহলে আমাদের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে”।
২০১৮ সালের শুরুর দিকে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ একটা প্রত্যাবাসন চুক্তি স্বাক্ষর করে কিন্তু কোন রোহিঙ্গাই নিরাপত্তা সঙ্কটের কারণে সেখানে ফিরে যেতে রাজি হচ্ছে না।
অর্থনৈতিক আলোচনা
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে অচলাবস্থা নিরসনের প্রচেষ্টার পাশাপাশি বাংলাদেশে চীনা প্রকল্পগুলোর অর্থায়ন নিয়েও কথা বলবেন শেখ হাসিনা।
পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বেনারনিউজকে বলেন, “চীনা পৃষ্ঠপোষকতায় যে প্রকল্পগুলোর কাজ চলছে, সেগুলোর জন্য দ্রুত অর্থ ছাড়ের বিষয়ে আলোচনা করবেন হাসিনা”।
২০১৬ সাল থেকে চীন বাংলাদেশে তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ বহুগুণ বাড়িয়েছে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশে চীনের সার্বিক বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১.০৩ বিলিয়ন ডলার, যেটা দুই বছর আগের তুলনায় ১৬ গুণ বেশি, যে সময় বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৬১ মিলিয়ন ডলার।
এটা তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি যে, হাসিনা ও চীনা নেতারা সম্প্রতি চীন ও বাংলাদেশী কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবেন কি না। আংশিক চীনা অর্থায়নে নির্মিয়মান একটি বিদ্যুৎ প্রকল্পে সম্প্রতি ওই সঙ্ঘাত বাধে।
বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগের অধিকাংশই হলো বিদ্যুৎ খাতে। এর মধ্যে ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার পায়রা বিদ্যুৎ প্ল্যান্টটি নির্মিত হচ্ছে যৌথ কনসোর্টিয়ামের মাধ্যমে যেখান সপ্তাহখানিক আগে সংঘর্ষ হয়েছে।
এই প্ল্যান্টে আমদানি করা কয়লাকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হবে এবং চলতি বছরের শেষ নাগাদ এটা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হবে এবং ২০২২ সালের শেষ নাগাদ এটা পুরোপুরি সচল হবে। কনসোর্টিয়ামের অংশীদার নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশান কোম্পানি লিমিটেড এ তথ্য জানিয়েছে।
পায়রা প্ল্যান্টের নির্মাণ স্থলে ৭০০০ বাংলাদেশী ও ২৭০০ চীনা কর্মী কাজ করছে। সেখানে একজন বাংলাদেশী শ্রমিকের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশী ও চীনা শ্রমিকদের মধ্যে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। গুজব রটে যে, এক চীনা নাগরিক বাংলাদেশীকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল।
সঙ্ঘাত থামাতে কয়েকশ পুলিশকে তলব করা হয়। ওই সংঘর্ষে এক চীনা কর্মী মারা যায় এবং অন্তত সাতজন আহত হয়।
উত্তেজনা প্রশমনের জন্য কর্তৃপক্ষ সকল বাংলাদেশী শ্রমিককে দুই সপ্তাহের ছুটিতে পাঠিয়েছে এবং এ ব্যাপারে তদন্ত করা হবে। চীনা কর্মীরা সপ্তাহ শেষে কাজ শুরু করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের একজন অধ্যাপক বলেছেন, তিনি মনে করেন না যে, একজন চীনা কর্মীর মৃত্যু বাংলাদেশের সাথে চীনের সম্পর্কের উপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে।
মোহাম্মদ রুহুল আমিন বেনারনিউজকে বলেন, “তবে চীন হয়তো তাদের নাগরিকের মৃত্যুর কারণ জিজ্ঞাসা করতে পারে এবং নিশ্চয়ই তারা সেখানে ন্যায়বিচার চাইবে। বাংলাদেশী আইন অনুযায়ী যদি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হয়, তাহলে আমি মনে করি না যে, চীনের সেখানে অন্য কোন উদ্বেগ থাকবে”।
বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভলপমেন্ট বোর্ডের (পিডিবি) চেয়ারম্যান খালেদ মাহমুদ বলেন, “আমরা আশা করি পরিস্থিতি শিগগিরই স্বাভাবিক হবে”।
সহিংসতার ঘটনায় ১৪ জন বাংলাদেশীকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং আরও সন্দেহভাজনকে শিগগিরই গ্রেফতার করার ব্যাপারে আশা করছে পুলিশ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মী বলেছেন যে, প্ল্যান্টে তাকে এবং অন্যান্য বাংলাদেশীর সাথে খারাপ ব্যবহার করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন যে, যেহেতু হাসিনা চীন সফরে যাচ্ছেন, তাই সরকারী কর্মকর্তারা বিষয়টিকে খাটো করে দেখার চেষ্টা করছেন।
ওই কর্মী বলেন বাংলাদেশীদের সহায়তা করার মতো কোন ইউনিয়ন নেই এবং তাদের শ্রম অধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, “ব্যবস্থাপকদের কাছে যখন বিষয়টি জানাই আমরা, তারা আমাদের কথার গুরুত্ব দেন না। আমাদের জন্য এটা দুর্ভাগ্যজনক যে, চীনারা আমাদের মাটিতে আমাদের সাথে দাসের মতো আচরণ করছে”।

No comments

Powered by Blogger.