বাবা ও পা হারানো তানভীরের সামনে শুধুই অন্ধকার by মরিয়ম চম্পা

একটি দুর্ঘটনা পাল্টে দিয়েছে তানভীরের জীবন। বদলে দিয়েছে চলার পথ। পরিবারে নেমে এসেছে কালো ছায়া। যা গোটা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে তাকে। তার পরিবারকে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে নেয়া এ ঘটনা দুই বছর ধরে বয়ে বেড়াচ্ছেন। তানভীরের কথা, আজীবন তা বয়ে বেড়াতে হবে। দুঃখ আর কষ্টকে আলিঙ্গন করে চলতে হবে বাকিটা জীবন। ২০১৭ সালের ২৫শে জানুয়ারি শিক্ষক পিতা জহিরুল ইসলামের বিদ্যালয় চৌগাছা বহ্নিরামপুর হাই স্কুলের পিকনিক ছিল। দিনাজপুরের স্বপ্নপূরী স্পটের সেই পিকনিকে পিতার সঙ্গে তানভীরও যায়। বাসটি চৌগাছা পুড়াপাড়া রোডে দানবাক্স এলাকায় একটি তাল গাছের সঙ্গে ধাক্কা লেগে উল্টে যায়।
এতে তার পিতা জহিরুল ইসলামসহ ৫ জন নিহত হয়। তানভীর মারাত্মক আহত হয়। পরে তানভীরের একটি পা কেটে ফেলতে হয়। অন্য পাও অবস হয়ে যায়। এই দুর্ঘটনা তানভীরের পরিবারকে তছনছ করে দেয়। গাঢ় অন্ধকার নেমে আসে সংসারে। একমাত্র উপার্জনক্ষম স্কুল শিক্ষক পিতার মৃত্যুতে সংসারে নেমে আসে অভাবের থাবা। তানভীররা এখন ঢাকায় থাকেন। সে বাংলাদেশ নৌবাহিনী স্কুল অ্যান্ড কলেজে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ছে। তানভীরের সম্পূর্ণ সুস্থ হতে আরো ৫টি অপারেশন প্রয়োজন। যার জন্য দরকার ১০ লক্ষাধিক টাকা।
তানভীরের মা কুমকুম হাবিবি বলেন, গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুরের বেদবাড়ীয়া। বর্তমানে পূর্ব কাফরুল আমতলাতে থাকেন। তিন ভাই বোনের মধ্যে তানভীর সবার ছোট। চাকরির সুবাদে বাবা জহিরুল ইসলাম ও মা কুমকুম গ্রামের বাড়িতেই থাকতেন। বড় দুই মেয়ে ঢাকায় অনার্সে ভর্তি হলে ছোট ছেলে তানভীরও বোনদের সঙ্গে ঢাকায় চলে আসে। মিরপুর ১৪নং এ বাংলাদেশ নৌবাহিনী স্কুল এন্ড কলেজে ভর্তি হয়। ২০১৭ সালে বাবার স্কুলের পিকনিকের অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় বাবাকে হারান তানভীর। একই দুর্ঘটনায় তানভীরের ডান পা কেটে বাদ দেয়া হয়। বাম পাও অকেজো হয়ে যায়। পরবর্তীতে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এপর্যন্ত তার শরীরে একাধীক অস্ত্রপচার করা হয়েছে। এখনো তার কোমড়ে, হাঁটুতে এবং উড়ুতে পাঁচটি অপারেশন করতে হবে। আরেকটি কৃত্রিম পা জুড়ে দেয়ার কথা বলেছেন ডাক্তার। ডাক্তাররা জানিয়েছে তার অপারেশনে প্রায় ১০ লাখ টাকারও বেশি খরচ হতে পারে। সড়ক দুর্ঘটনায় বাবা মারা যাওয়ার পরে স্কুলের পক্ষ থেকে সামান্য কিছু আর্থিক সাহায্য করা হয়। এরপর থেকে দুই বোনের টিউশনি আর পার্ট টাইম চাকরির টাকায় চলছে তানভীরের চিকিৎসা। বড় বোনের বিয়ে হওয়াতে ছোট বোনের কাঁধেই এখন পরিবারের ভার।
কখনো হুইল চেয়ারে কখনোবা মায়ের কোলে করে স্কুলে যান তানভীর। দুটি পা হারিয়ে এতোটুকু মনোবল হারাননি তানভীর। দুর্ঘটনার কারনে মাঝে পড়ালেখায় কিছুটা বিরতি থাকলেও নতুন করে স্কুলে নিয়মিত হয়েছে। ৩০ বছর বয়স পর্যন্ত তানভীরকে নিয়মিত চিকিৎসার মধ্যেই থাকতে হবে। এমনটিই জানিয়েছেন ঢামেক চিকিৎসকরা। কিন্তু তানভীরের একটাই চাওয়া মরতে হলেও শিক্ষিত হয়ে মরবো।
তানভীরের মা বলেন, একদিকে স্বামীকে হারালাম। অন্যদিকে একমাত্র ছেলের দুটি পা’ই বাদ হয়ে গেছে। দুর্ঘটনার পর থেকে শুরু হয় আমার জীবন সংগ্রাম। তানভীরের বাবা তেমন কোনো যায়গা জমি কিংবা ব্যাংক ব্যালেন্স রেখে যায়নি। গত তিন বছরে নিজেদের সব দিয়ে ছেলের চিকিৎসা করিয়েছি। মাঝেমধ্যে আত্মীয়স্বজন ও অপরিচিতদের কাছ থেকে অল্পকিছু আর্থিক সাহায্য পেয়েছি। বর্তমানে ছোট মেয়ের টিউশনি আর ছোট একটি খন্ডকালীন চাকরির টাকায় ছেলের চিকিৎসা খরচ চালাচ্ছি। খেয়ে না খেয়ে আমাদের দিন কাটে। ছেলেকে স্কুলে আনা-নেয়া এবং সংসারের যাবতীয় কাজ নিজেকেই সামলাতে হয়। স্কুলে যাওয়ার পথে মাঝে মধ্যে অনেক পথচারি রাস্তা পারাপারে সাহায্য করে। কিন্তু সবসময়তো আর মানুষজন ডেকে সাহায্য চাওয়া যায় না। এতোকিছুর পরেও মা হিসেবে আমার একটাই চাওয়া ছেলেকে যেন কেউ অশিক্ষিত বলতে না পারে। সড়ক দুর্ঘটনায় আমার পরিবার তছনছ করে দিলেও স্বপ্নটা আমি আজও দেখি। ছেলে বড় হয়ে বাবার মতো স্কুল শিক্ষক হবে এটাই আমার স্বপ্ন।

No comments

Powered by Blogger.