‘আল্লাহর তরফ থেকে জেলেদের পাঠানো হয়’ -বেঁচে ফেরাদের মুখে মর্মস্পর্শী বর্ণনা

ভূমধ্যসাগরে বড় বোট থেকে ছোট একটি প্লাস্টিকের বোটে তোলা হলো প্রায় ৭৫ জন অভিবাসীকে। তাদের মধ্যে একজন বাংলাদেশের সিলেট জেলার বাসিন্দা আহমেদ বিলাল। বোটটি এতই ছোট ছিল যে, একসঙ্গে এত মানুষের স্থান সংকুলান হচ্ছিল না তাতে। গাদাগাদি করে তাতেই উঠতে হয় বিলালদের।
বোটে ওঠার   মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যে প্রচণ্ড ঢেউয়ের আঘাতে ডুবে যায় এটি। আর চোখের সামনে একে একে মানুষ নির্মমভাবে মরতে থাকে। বিলালেরও ঠাণ্ডা পানিতে ডুবে মরার উপক্রম হয়েছিল। তবে ঠিক তখনই একটি জেলে নৌকা তাদেরকে উদ্ধারে এগিয়ে আসে।
জেলে নৌকায় উঠে এ যাত্রায় কোনোমতে নিজের প্রাণ বাঁচিয়েছেন বিলাল।
তবে বোটে থাকা বেশির ভাগেরই ভাগ্য সহায় হয়নি। জেলেরা মাত্র ১৬ জনকে জীবিত উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। বিলাল তাদের মধ্যে একজন। কিন্তু সাগরে ডুবে মরতে হয়েছে বাকি ৬০ অভিবাসীর। সাহায্যের জন্য করুণ আকুতি তখন সমুদ্রপৃষ্ঠে ছড়িয়ে পড়েছে। দূরে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এসেছে সেই আহাজারি। কিন্তু শূন্য সমুদ্রে তাকিয়ে স্বজনের মৃত্যু দেখা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না ৩০ বছর বয়সী বিলালের। এমন মৃত্যু আর ভয়াবহতা দেখে তিনি চিৎকার শুরু করেছিলেন। বলেছেন, বয়সে ছোট আমার দুই নিকট আত্মীয় পানিতে হারিয়ে গেল। তাকিয়ে দেখলাম আর চিৎকার করলাম। কান্না থামাতে পারছিলাম না কোনোভাবেই।
সেই ভয়াবহ দৃশ্যকে কোনোভাবেই ভুলতে পারছেন না বিলাল। এখনো হাউমাউ করে কাঁদছেন তিনি। মৃত্যুবিভীষিকা তার বুকে সৃষ্টি করেছে এক আতঙ্ক।
তিউনিশিয়া উপকূলে নৌ-ডুবিতে মারা গেছেন কমপক্ষে ৬০ অভিবাসী। এর বেশির ভাগই বাংলাদেশি। জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে ১৬ জনকে। তার মধ্যে ১৪ জনই বাংলাদেশি বলে জানাচ্ছে রেডক্রিসেন্ট। তাদের অন্যতম আহমেদ বিলাল। তিনি বলেছেন, ৬ মাস আগে থেকে তার ইউরোপ যাত্রার মিশন শুরু হয়েছিল। অন্য তিনজনকে সঙ্গে নিয়ে তিনি চলে যান দুবাইয়ে। সেখান থেকে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে। ইস্তাম্বুল থেকে তারা একটি ফ্লাইটে করে চলে যান লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলি। বিলাল বলেন, সেখানে আরো প্রায় ৮০ জন বাংলাদেশির সঙ্গে যোগ দেই আমরা। আমাদেরকে তিন মাস লিবিয়ার পশ্চিমাঞ্চলে একটি রুমে আটকে রাখা হয়েছিল। এ অবস্থায় মনে হয়েছিল, ওই লিবিয়াতেই বুঝি মারা যাবো। দিনে মাত্র একবার আমাদেরকে খাবার দেয়া হতো। তাও পরিমাণে কম। এই ৮০ জন মানুষের ব্যবহারের জন্য ছিল মাত্র একটি টয়লেট। আমরা গোসল করতে পারতাম না। পারতাম শুধু মুখ ধুতে। দিন-রাত শুধু কাঁদতাম আমরা। খাবার চেয়ে কান্নাকাটি করতাম।
আহমেদ বিলাল যখন বাড়ি ছাড়েন তখন আন্দাজ করতে পারেন নি এই সফরের পরিণতি কি হতে পারে। সিলেটে থাকা অবস্থায় তিনি দেখেছেন বহু মানুষ ইউরোপে বসবাস করছেন। তারা উন্নত জীবনযাপন করছেন। তা দেখে তিনি প্রলুব্ধ হয়েছিলেন। তাই জমি বিক্রি করেছেন। ‘গুড লাক’ ডাকনামের এক বাংলাদেশি পাচারকারীর হাতে এই সফরের জন্য দুই সন্তানের জনক বিলাল তুলে দিয়েছেন প্রায় ৭ হাজার ডলার। তিনি বলেন, ওই পাচারকারী বলেছিল, আমার জীবন উন্নত হবে। সব পাল্টে যাবে। আমরা তাই বিশ্বাস করেছিলাম। আমি নিশ্চিত তিনি এই পথে যত মানুষ পাঠিয়েছেন তার বেশির ভাগই মারা গেছেন।
বার্তা সংস্থা এএফপিকে বিলাল জানিয়েছেন,  ছয় মাস আগে তাদের যাত্রা শুরু হয়। প্রথমে তারা যান দুবাই। সঙ্গে ছিল আরো দুজন। সেখান থেকে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে। পরে আরেকটি ফ্লাইটে লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলিতে। ত্রিপোলিতে আরো প্রায় ৮০ জন বাংলাদেশি তাদের সঙ্গে যোগ দেন। এরপর পশ্চিম লিবিয়ার কোনো একটা জায়গায় একটি রুমে তাদের তিন মাস আটকে রাখা হয়। তিনি বলেন, আমার মনে হয়েছিল আমি লিবিয়াতেই মারা যাবো। আমাদের দিনে মাত্র একবার খাবার দেয়া হতো। অনেক সময় তারও কম। আশি জন মানুষের জন্য সেখানে টয়লেট ছিল একটি। আমরা শৌচকর্ম পর্যন্ত করতে পারতাম না। আমরা খাবারের জন্য কান্নাকাটি করতাম। এরপর একদিন তাদেরকে উত্তর-পশ্চিম লিবিয়া থেকে একটি বড় নৌকায় তোলা হয়। সেখান থেকে সাগরের মাঝে তাদের ওই ছোট নৌকায় তোলা হয়।
আহমেদ বিলালের সঙ্গে ঐ একই নৌকায় ছিলেন একজন মিশরীয় নাগরিক মনজুর মোহাম্মদ মেতওয়েলা। তিনি জানান, এই ছোট নৌকাটি সঙ্গে সঙ্গে ডুবে যেতে শুরু করে। তিনি বলেন, আমাদেরকে বড় বোট থেকে ছোট বোটে নামানো হলো। এর পরপরই তা ডুবে যেতে শুরু করে। আমরা সারারাত সাঁতার কাটতে থাকি হিম ঠাণ্ডা পানিতে। এ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছেন সিলেটের বিলালও। তিনি বলেছেন, এক পর্যায়ে বেঁচে থাকার আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু আল্লাহর তরফ থেকে আমাদের কাছে পাঠানো হয়েছে ওই জেলেদের। তাদের বদৌলতে আমরা জীবন ফিরে পেয়েছি। জেলেরা উদ্ধার করেছেন ১৪ জন বাংলাদেশি, মরক্কোর একজন নাগরিক ও মিশরের মেতওয়েলাকে। এ জীবনকে তারা দ্বিতীয় জীবন বলে আখ্যায়িত করছেন। এ জীবনেও এক অন্ধকার ভবিষ্যৎ বিলালের সামনে। তিনি বলেন, আমি সবকিছু হারিয়েছি। এখন আমার আর সম্বল বলতে কিছুই নেই। তাই জীবন বাঁচাতে, পরিবারকে বাঁচাতে এখনো আমি অর্থ উপার্জনের জন্য ইউরোপে যেতে চাই। যে ঝুঁকি নিয়েছি, সেভাবে আর যেতে চাই না।
দাতব্য সংস্থা ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস (এমএসএফ)-এর হিসাবে লিবিয়ায় ৬০০০ অভিবাসীকে আটক করে রাখা হয়েছে এমন এক অবস্থায় যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড থেকে অনেক নিচে। পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার খলিফা হাফতার গত মাসে ত্রিপোলিকে দখলে নেয়ার অভিযান শুরু করেন। এতে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সেনাবাহিনীর সঙ্গে এ লড়াইয়ে কমপক্ষে ৪৫০ জন মানুষ নিহত হয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.