ব্যাংকের আসল ‘ডাকাত’ কারা by শওকত হোসেন

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি দেশের ব্যাংকগুলোকে ‘ডাকাত’ বলেছেন। তিনি গত বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে বললেন, ‘পৃথিবীর কোথাও ব্যাংকঋণ ও আমানতের সুদের ব্যবধান ২-৩ শতাংশের বেশি নয়। বাংলাদেশেই এ হার কেবল ৫ শতাংশের ওপরে। এটা রীতিমতো ডাকাতি।’
বাণিজ্যমন্ত্রী পোশাক খাতের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ছিলেন। উচ্চ সুদহারে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগের সমস্যার কথাও তিনি জানেন। তিনি তাঁর বক্তৃতায় সুদের হার ১ অঙ্কে নামিয়ে আনাতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা যে ব্যাংকগুলো মানছে, সে কথাও বলেছেন।
কেবল বাণিজ্যমন্ত্রীর নয়, সুদহার কেন কমছে না—এই প্রশ্ন তো সবার। তবে বাণিজ্যমন্ত্রীর এ বক্তব্যের পর ‘ব্যাংক ডাকাত’দের নিয়ে একটু তত্ত্বতালাশ করা যেতে পারে। ব্যাংকের আসল ‘ডাকাত’ কারা, সেই প্রশ্নেরও উত্তর খোঁজা যায়।
এক বছর আগে ২০১৮ সালের ২০ জুন সরকারের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) ঘোষণা দিয়েছিল, ১ জুলাই থেকে আমানত ও ঋণের সুদহার হবে যথাক্রমে ৬ শতাংশ ও ৯ শতাংশ। এর পরের দিন সরকারি ব্যাংকগুলো একযোগে বিজ্ঞাপন দিয়ে এই সিদ্ধান্ত পালনের কথা জানিয়ে দেয়। তখনই এভাবে সুদহার ঠিক করাকে অনেকে ঠাট্টা করে ‘নয়-ছয়’ বলেছিলেন। রসিকতাটা যে ভুল ছিল না, সেই প্রমাণ তো বাণিজ্যমন্ত্রীর কথাতেই আছে।
ব্যাংক খাত কীভাবে চলবে, তার কিছু আন্তর্জাতিক রীতিনীতি আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক তা অনুসরণ করে। ব্যাংক বিষয়ে যেকোনো নীতি–সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার বাংলাদেশ ব্যাংকেরই। অথচ সুদহার ঠিক করার মতো গুরুত্বপূর্ণ এমন একটি নীতি–সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়াকে তো ‘ডাকাতি’ বলা যায়।
ব্যাংক মালিকদের সুদহার ‘নয়-ছয়’ করার কারণ অবশ্য একটা ছিল। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংকের করপোরেট কর ২ দশমিক ৫ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। এর আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেসরকারি ব্যাংকগুলোর নগদ জমার হার (সিআরআর) ১ শতাংশ কমানো এবং টানা ৯ বছর ব্যাংকের পরিচালক থাকা ও এক পরিবারের ৪ জনকে ব্যাংকের পর্ষদে থাকার সুযোগ করে দেয়। সরকারি আমানত রাখার সীমাও ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ করা হয়। এত সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার বিনিময়েই ব্যাংক মালিকেরা সুদের হার কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রতিশ্রুতি না রেখেই সব সুযোগ-সুবিধা ব্যাংক মালিকেরা ঠিকই ভোগ করছেন।
সুদের হার বৃদ্ধির কারণ বিশ্লেষণ না করে কেবল নির্দেশ দিয়ে তা কখনোই কমানো যায় না। আর সুদের হার বাড়ার অনেক কারণ থাকে। বর্তমানে ব্যাংক খাতে আছে তারল্যসংকট। কোনো কোনো ব্যাংক ১০ শতাংশের বেশি সুদে আমানতই সংগ্রহ করছে। এমন ব্যাংকও আছে যাদের ঋণ-আমানতের সুদের হারের পার্থক্য প্রায় ৮ শতাংশ। সুদের হার কমাতে এই তারল্যসংকটের সমাধান করতে হবে। তা ছাড়া, এখন সুদের হার নির্ধারণ করে বাজার, চাহিদা-জোগানের ভিত্তিতে। তবে তারপরও সুদের হার কিছু কমানো সম্ভব। যেমন খেলাপি ঋণ কমাতে পারলে ব্যাংকগুলো আরও ১ থেকে ২ শতাংশ হারে সুদ কমাতে পারত।
এ ক্ষেত্রে ব্যাংক খাতে আলোচিত ‘ডাকাত’দের কথা বলা যায়। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন গত বছরের ৯ জুন সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন, ‘একশ্রেণির লোক আছেন, যাঁরা ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যাংকের টাকা তছরুপ করেছেন, ব্যাংকের টাকা ডাকাতি করেছেন। আমরা তাঁদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’
সুতরাং খেলাপি ঋণ কমাতে হলে ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। অথচ ঋণখেলাপিদের আরও সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে সরকার। যেমন ঋণের সুদের হার ১২ শতাংশ হলে উদ্যোক্তাকে ফেরত দিতে হবে সব মিলিয়ে ১৩ শতাংশ বা এর চেয়ে বেশি হারে। আর খেলাপি হলে দিতে হবে ৯ শতাংশ হারে, তাও দীর্ঘ সময় ধরে। এই সুবিধা আগামী মে মাস থেকে কার্যকর হবে বলে অর্থমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন। এই যদি অবস্থা হয়, তাহলে ব্যাংকে ঋণ ফেরত দিতে কে আর আসবেন।
এবার বাণিজ্যমন্ত্রী আপনিই বলুন, ব্যাংকের আসল ‘ডাকাত’ কারা।

No comments

Powered by Blogger.