রাতভর অবস্থানের পর আলটিমেটাম

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম (এসএম) হলে এক শিক্ষার্থীকে মারধরের বিচার চাইতে গিয়ে ছাত্রলীগের হামলা ও লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুরসহ প্রতিবাদী শিক্ষার্থীরা। এ ঘটনার বিচার চেয়ে ভিসি বাস ভবনের সামনে অবস্থান নিয়েছিল শিক্ষার্থীরা। মঙ্গলবার রাত পৌনে ৮টায় শুরু হওয়া  এ অবস্থান কর্মসূচি চলে গতকাল সকাল ৯টা পর্যন্ত। সকালে ভিসি ঘটনাস্থলে এসে কর্মসূচি পালনরত শিক্ষার্থীদের নিজ কার্যালয়ে নিয়ে যান। সেখানে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ভিসির ঘণ্টাব্যাপী আলোচনা হয়। আলোচনা শেষে নিজেদের কর্মসূচি স্থগিত করেছে আন্দোলনকারীরা। দাবি আদায়ে প্রশাসনকে আগামী সোমবার পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে।
এ সময়ের মধ্যে হামলার বিচার না হলে ফের কর্মসূচি দেয়া হবে বলে ঘোষণা করেছেন ডাকসুর ভিপি নুরুল হক নুর।
ঘটনার তদন্তে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে হল প্রশাসন। এদিকে এসএম হলে ভিপি নুরসহ প্রতিবাদী ছাত্রীদের লাঞ্ছনার ঘটনাকে নাটক বলে মন্তব্য করেছেন ডাকসুর এজিএস ও ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন। জানা গেছে, গত ১১ই মার্চ অনুষ্ঠিত সলিমুল্লাহ মুসলিম হল সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্রভাবে জিএস পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চাওয়ার ক্ষোভ থেকে সোমবার রাতে হলটির আবাসিক শিক্ষার্থী ও উর্দু বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র ফরিদ হাসানকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে ছাত্রলীগ ও হল সংসদের নেতারা। মারধরের মাত্রা বেশি হওয়ায় তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় জখম হয়। জখম স্থানে সেলাই পড়ে ৩২টি। গুরুতর আহত ফরিদ হাসান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেলে চিকিৎসা নিয়েছেন। এ ঘটনার বিচার চেয়ে গত মঙ্গলবার বিকালে এসএম হলের প্রাধ্যক্ষকে স্মারকলিপি দিতে হলটিতে যান ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুরের নেতৃত্বে সমাজসেবা সম্পাদক আকতার হোসেন, শামসুন্নাহার হলের ভিপি শেখ তাসনীম আফরোজ ইমি, ছাত্র ফেডারেশনের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি উম্মে হাবিবা বেনজির, অরণি সেমন্তি খানসহ প্রায় ৫০-৬০ জন শিক্ষার্থী।
এ সময় তাদের ওপর দুই দফা হামলা চালায় হল শাখা ছাত্রলীগ ও হল সংসদের নেতারা। বৃষ্টির মতো ছুড়ে মারা হয় ডিম। মারধর করা হয় কয়েকজনকে। লাঞ্ছিত করা হয় ছাত্রীদের। ভিপি নুরসহ কয়েকজনকে হলের অভ্যন্তরে অবরুদ্ধ করে রাখা হয় প্রায় দেড় ঘণ্টা। এতে নেতৃত্ব দেন হল সংসদের ভিপি এমএম কামাল হোসেন ও জিএস জুলিয়াস সিজার তালুকদার। ঘটনার প্রতিবাদ ও হামলাকারীদের বিচারের দাবিতে ভিসি বাসভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করে ভিপি নুরুল হক নুরসহ বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। রাত পৌনে ৮টায় শুরু হওয়া এ অবস্থান কর্মসূচি চলে গতকাল সকাল ৯টা পর্যন্ত। আন্দোলনকারীদের দাবির মধ্যে ছিল এসএম হলের স্বতন্ত্র জিএস প্রার্থী মো. ফরিদ হাসানের ওপর হামলার বিচার দাবি, বিচার চাইতে গিয়ে ভিপি নুরসহ অন্যদের অবরুদ্ধ করে ডিম হামলা এবং মারধরকারী ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বিচার, একই সঙ্গে নারী লাঞ্ছনাকারী এসএম হল শাখার সভাপতি তাহসান আহমেদ রাসেল, সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান তাপস, হলের ভিপি কামাল হোসেন, জিএস জুলিয়াস সিজার তালুকদার, সাহিত্য সম্পাদক আকিব মোহাম্মদ ফুয়াদসহ অন্যদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা।
এদিকে ভিপি নুরসহ শিক্ষার্থীরা যখন অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন ঠিক তখন পাশে দাঁড়িয়ে উল্টো নুরকে হামলাকারী আখ্যা দিয়ে বিক্ষোভ করেন এসএম হলের ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এতেও নেতৃত্ব দেন হল সংসদের ভিপি কামাল ও জিএস জুলিয়াস সিজার। তারা বিভিন্ন ধরনের কটূক্তি করে ভিপি নুরসহ অবস্থান কর্মসূচি পালনকারী শিক্ষার্থীদের উত্তেজিত করার চেষ্টা করে। অন্যদিকে রাত সাড়ে ১২টার পর সেখানকার সব লাইট নিভিয়ে দেয়া হয়।
একপর্যায়ে রাত পৌনে ১টার দিকে ঘটনাস্থলে আসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রব্বানী। এ সময় ভিপি নুর বলেন, ‘লাইট নিভিয়ে আমাদের অত্যাচার-নির্যাতন করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।’ জবাবে প্রক্টর গোলাম রব্বানী বলেন, ‘এ ঘটনায় জড়িতদের বিচার হবে, এজন্য সবার সহযোগিতা দরকার।’ প্রক্টর অবস্থান কর্মসূচি শেষ করে শিক্ষার্থীদের চলে যেতে অনুরোধ করেন। কিন্তু তার কথায় আশ্বস্ত হতে পারেনি আন্দোলনকারীরা। তারা ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানকে ঘটনাস্থলে আসার দাবি করেন। কিন্তু প্রক্টর তাতে রাজি হননি। একপর্যায়ে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে রাত ২টার দিকে চলে যান প্রক্টর রব্বানী। এরপর সারারাত অবস্থান নেয় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। সকালে শামসুন্নাহার হলের ভিপি আফরোজ ইমি বলেন, রাতে আলো নেভানো হয়। এরপর প্রক্টর আসেন।
তখন আমাদের পাশে থাকা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের চলে যেতে বলি। কিন্তু তিনি তাদের চলে যাওয়ার কোনো নির্দেশ দেননি। প্রক্টর চলে যাওয়ার পর গভীর রাতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আবারো আমাদের ওপর ডিম ছুড়ে মারে। সকাল ৯টার দিকে ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান ঘটনাস্থলে এসে ভিপি নুরসহ বিক্ষুব্ধদের একটি সাদা মাইক্রোবাসে করে নিজ কার্যালয়ে নিয়ে যান। সেখানে প্রায় সোয়া ১ ঘণ্টা ধরে চলে আলোচনা। আলোচনা শেষে পূর্ব ঘোষিত বিক্ষোভ কর্মসূচি স্থগিত করে আন্দোলনকারীরা। সকাল সোয়া ১১টায় সন্ত্রাসবিরোধী রাজু স্মারক ভাস্কর্যের সামনে ভিপি নুরুল হক নুর নিজেদের কর্মসূচি স্থগিতের ঘোষণা দেন। এ সময় তিনি আগামী সোমবার পর্যন্ত প্রশাসন হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয় তা দেখার কথা জানান। বেঁধে দেয়া সময়ে হামলাকারীদের বিচার না হলে ফের কর্মসূচি দেয়ার ঘোষণা দেন।
নুর বলেন, ‘আমাদের সর্বোচ্চ অভিভাবক ডাকসুর সভাপতি (ভিসি)। তার পরেই ভিপির অবস্থান। সে জায়গা থেকে ভিসির সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনি আমাদের অভিযোগ শুনেছেন। আমরা বলেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হামলায় ছাত্রলীগ জড়িত থাকা সত্ত্বেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। মঙ্গলবারের ঘটনায় যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আগামী সোমবারের মধ্যেই আমরা দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে দেখতে চায়। যদি প্রশাসন ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয় তাহলে আমরা কঠোর কর্মসূচি দেবো।’ এ সময় তিনি কয়েকটি দাবি তুলে ধরেন। দাবিগুলো হলো- লাঞ্ছনাকারীদের বিচার করা, এবং হল থেকে সব বহিরাগত, অছাত্র এবং অবৈধদের বের করে দিতে হবে। ভিসি আমাদের এসব বিষয়ে সুষ্ঠু সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আমরাও তার কথার ওপর আস্থা রেখেছি।’ এ সময় সমাজসেবা সম্পাদক আক্তার হোসেন, শামসুন্নাহার হলের ভিপি শেখ তাসনীম আফরোজ ইমি, ছাত্র ফেডারেশনের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি উম্মে হাবিবা বেনজির, ডাকসুর ভিপি পদের স্বতন্ত্র প্রার্থী অরণি সেমন্তি খান, বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম-আহ্বায়ক ফারুক হোসেন ও রাশেদ খান প্রমুখ।
তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস ভিসির: শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা শেষে ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, ডাকসুর ভিপিসহ অন্যদের ওপর হামলা এবং ছাত্রী লাঞ্ছনার ঘটনার তদন্তপূর্বক বিচার করা হবে। তিনি বলেন, এ ঘটনায় হল প্রশাসন একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তদন্তপূর্বক দোষীদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটিয়ে কেউ যাতে অস্থিতিশীল পরিবেশ ঘটাতে না পারে সেজন্য সবার সহযোগিতা কামনা করছি। কেউ অন্যায় করে যাতে পার না পায় সে বিষয়টাও আমরা নিশ্চিত করবো। সবাই যেন নিজেদের দায়িত্বশীল জায়গাগুলো ভুলে না যায়। তিনি বলেন, এখন কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ আছে।
যেকোনো দাবি দাওয়া আদায়ে একটি দায়িত্বশীল জায়গা তৈরি হয়েছে। আন্দোলনকারীদের আমি বুঝিয়েছি, এখন যেকোনো আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন পর ডাকসু নির্বাচন হওয়াতে অনেকে তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে জানেন না। হল সংসদের নেতারাও বুঝেন না, তাদের কি করণীয়, কীভাবে করতে হবে। তাই ভাবছি যে একটি ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রামের আয়োজন করবো। যারা ডাকসুর সাবেক তাদের নিয়ে এসে একটা প্রোগ্রাম করবো। আর যেকোনো অন্যায়-অপরাধ ক্যাম্পাসে ঘটলে আমাদের একটি প্রক্রিয়া অবলম্বন করে তারপর সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হয়। এসএম হলের ঘটনার ক্ষেত্রেও তাই হবে।
ছাত্রীদের ওপর হামলার ঘটনাকে নাটক বললেন এজিএস সাদ্দাম: এদিকে মেয়েদের ওপর হামলার ঘটনাকে ‘নাটক’ ও ‘গুজব’ বলে মন্তব্য করেছেন ডাকসুর এজিএস ও ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন। গতকাল দুপুরে মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি করেন তিনি। সাদ্দাম বলেন, ছাত্রীদের ওপর হামলার প্রশ্নই আসে না। হামলার নাটক সাজিয়ে ছাত্রলীগের ভাবমূর্তি নষ্টের চেষ্টা করা হচ্ছে। গুজব পারদর্শীদাতার ওপর ভিত্তি করে তথাকথিত ভুঁইফোড় সংগঠনের উদ্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, এগুলো আকাশ কুসুম অভিযোগ।
গত মঙ্গলবার আপনারা দেখেছেন সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু ভিডিও সয়লাব হয়েছে। সেখানে দেখবেন প্রভোস্টের সঙ্গে কথোপকথনে সে স্বীকার করেছে তার ভুল ছিল, তাদের প্রক্রিয়া ভুল ছিল। সাদ্দাম আরো বলেন, বাইরে এসে সে (নুর) সাংবাদিকদের বলেছে কোনো নারী শিক্ষার্থী সেখানে যায়নি। ভেতরে আমরা ছবি দেখেছি। আবার প্রভোস্ট অফিসে যখন যায় তখন ছাত্রী নিয়ে যায়। পরে সে বলে তার সঙ্গে ছাত্রী ছিল না। তার বক্তব্যে দোদুল্যমানতা রয়েছে। আমরা কোনো অবস্থাতেই এটা প্রত্যাশা করি না। ডাকসুর ভিপি নুরুল হক নুর তার জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য এসএম হলে গিয়েছিলেন বলেও মন্তব্য করেন সাদ্দাম। এ সময় তিনি নুরকে আরো দায়িত্বশীল আচরণ করার আহ্বান জানান।

No comments

Powered by Blogger.