ডাকসু নির্বাচন: সবাই আচরণবিধি ভাঙছে প্রশাসন শুধু দেখছে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনের জন্য গঠিত আচরণবিধি ভাঙছে সবাই। একের পর এক আচরণবিধি লঙ্ঘন করলেও কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেই প্রশাসনের। ‘সতর্ক করছি’ বলে দায় সারছেন সংশ্লিষ্টরা। আচরণবিধি লঙ্ঘনের মিছিলে ছাত্রলীগের সঙ্গে শামিল হয়েছে- ছাত্রদল ও বামজোট। তারাও ভঙ্গ করেছে আচরণবিধি। তবে আচরণবিধি লঙ্ঘনের সব মাত্রাই ছাড়িয়ে যাচ্ছে ছাত্রলীগ। প্রতিদিনই সংগঠনটির প্রার্থীরা আচরণবিধির বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছেন। গতকাল সন্ধ্যায় জানতে চাইলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও ডাকসুতে ভিপি প্রার্থী রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন কিছু কিছু আচরণবিধি লঙ্ঘনের কথা স্বীকারও করে নিয়েছেন।
তিনি বলেন, মহানগরের কিছু অতি উৎসাহী নেতাকর্মী আচরণবিধি লঙ্ঘন করছেন। আমি তাদের ডেকে সতর্ক করেছি। এছাড়া অন্য অভিযোগের বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না বলে দায় সেরেছেন। কিন্তু আগামীতে হবে না বলে জানিয়েছেন। অন্যদিকে আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রব্বানী বলেন, আচরণবিধি লঙ্ঘনের নানা অভিযোগ আসছে।
আমরা যখনই জানতে পারছি তখনই প্রার্থীকে ডেকে সতর্ক করছি। এ ধারা অব্যাহত থাকলে আমরা শাস্তি গ্রহণ করতে বাধ্য হবো। জানা গেছে, তফসিল ঘোষণার পর থেকেই দেয়ালে রঙিন পোস্টার ও লিফলেট সাঁটানো, ক্লাসরুমে প্রচারণা চালানো, মঞ্চ তৈরি করে প্রজেকশন মিটিং করা, সাইকেল র‌্যালি করা, মসজিদে মসজিদে ভোট চাওয়া, নির্ধারিত সময়ের পরও মাইকের ব্যবহার, লিফলেটে বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীর ছবির ব্যবহার, ভোটার না- এমন ব্যক্তিকে দিয়ে প্রচারণা চালানোসহ বিভিন্নভাবে আচরণবিধি বিরুদ্ধ কাজ করেছে ছাত্রলীগ। অন্যদিকে ছাত্রদল ক্যাম্পাসে ভোটার নয়, এমন ব্যক্তিকে দিয়ে মিছিল করে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছে। বামজোট ব্যান্ড পার্টির ব্যবহার করেছে নির্বাচনী প্রচারণায়। গত ১০ই জানুয়ারি ডাকসুর গঠনতন্ত্র সংশোধন কমিটি ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় সভা করে। সভার পরে ছাত্র সংগঠনগুলোর দেয়া প্রস্তাবনার আলোকে গঠন করা হয় আচরণবিধি।
যেখানে ছাত্রলীগের দেয়া প্রস্তাবনা বেশি গ্রহণ করা হয়েছে বলে বাম ছাত্র সংগঠনগুলো দাবি করেছে। অথচ ছাত্রলীগই নিজেদের দেয়া প্রস্তাবনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। একের পর এক আচরণবিধি লঙ্ঘন করে যাচ্ছে সংগঠনটি। অবশ্য এ নিয়ে তেমন মাথাব্যথাও নেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। চিফ রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক ড. এসএম মাহফুজুর রহমান জানান, আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়টি প্রক্টর দেখছেন। তিনি ব্যবস্থা নেবেন। আর প্রক্টর অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম রব্বানী জানান, তিনি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়ার পর প্রার্থীদের সর্তক করছেন। এদিকে আচরণবিধি লঙ্ঘনে সব থেকে বেশি অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। প্রতিদিনই সংগঠনটির নেতাকর্মীরা কোনো না কোনোভাবে আচরণবিধি লঙ্ঘন করছেন।
তফসিল ঘোষণার পর চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশের আগেই ক্যাম্পাসের বিভিন্ন দেয়ালে রঙিন পোস্টার সাঁটিয়ে ভোট চেয়েছেন ছাত্রলীগের হয়ে ভিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন। গত ১ই মার্চ দিবাগত রাতে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন দেয়ালে এসব পোস্টার টানানো হয়। অবশ্য রঙিন পোস্টারের বিষয়ে এক বিবৃতি দিয়ে ছাত্রলীগ দাবি করেছে, সংগঠনটির মহানগর পর্যায়ের কিছু অতি উৎসাহী নেতাকর্মী এমনটা করেছে। এর সঙ্গে শোভনের কোনো সম্পর্ক নেই। ৩রা মার্চ চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশের আগেই শোভন ক্যাম্পাসের বিভিন্ন পয়েন্টে ভোট চেয়ে ব্যানার টানিয়েছিলেন। যেটিও আচরণবিধির স্পষ্ট লঙ্ঘন।
এরপর চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশের পর ছাত্রলীগ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হলে প্যানেল পরিচিতি সভা করে। যেখানে রঙিন ব্যানারের ব্যবহার করেছে সংগঠনটি। এটিও আচরণবিধির স্পষ্ট লঙ্ঘন। এ বিষয়ে তখন চিফ রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক ড. এসএম মাহফুজুর রহমানের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘রঙিন কোনো কিছুই ব্যবহার করা যাবে না। এটা আচরণবিধির স্পষ্ট লঙ্ঘন। বিষয়টি প্রক্টর দেখবেন।’ ৫ই মার্চ কলা ভবনের বিভিন্ন শ্রেণি কক্ষে গিয়ে ভোট চেয়েছেন ছাত্রলীগের হয়ে ভিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনসহ কয়েকজন প্রার্থী। যেটি আচরণবিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। আবার ছাত্রলীগই ক্লাসরুম ক্যাম্পেইনের বিরোধিতা করে প্রস্তাবনা রেখেছিল।
আচরণবিধির ৫(চ) ধারা অনুযায়ী, ?পাঠদান ও পরীক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে এমন কোনো স্থানে (যেমন শ্রেণিকক্ষ, পাঠকক্ষ, পরীক্ষার হল ইত্যাদি) সভা/সমাবেশ বা নির্বাচনী প্রচারণা চালানো যাবে না। একই দিন স্যার এ এফ রহমান হলে ভিপি পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী ফাহিম রেজা শোভনের ব্যানার নামিয়ে ফেলার অভিযোগ উঠে ছাত্রলীগের ভিপি প্রার্থী আব্দুল আলিম খানের বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে শোভন হল রিটার্নিং কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন। ৬ই মার্চ অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে মঞ্চ বানিয়ে প্রজেকশন মিটিং করেছে ছাত্রলীগ মনোনীত প্যানেল। প্রজেকশন মিটিংয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্যানেলের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন উস্কানিমূলক মন্তব্য করেন ছাত্রলীগের প্রার্থীরা। যেটিও আচরণবিধির স্পষ্ট লঙ্ঘন।
কারণ আচরণবিধির ৭ ধারায় বলা হয়েছে-কোনো প্রার্থী বা তার পক্ষে কোনো ছাত্রসংগঠন, কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী গেইট, তোরণ, ঘের নির্মাণ, প্যান্ডেল, ক্যাম্প, শামিয়ানা, মঞ্চ স্থাপন ও আলোকসজ্জা করতে পারবেন না। ডাকসুর আচরণবিধির ৯(ক) অনুযায়ী অন্য প্রার্থীর বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক বক্তব্য দেয়ার নিষেধাজ্ঞা আছে। ৭ই মার্চ ক্যাম্পাসে সাইকেল র‌্যালি করে ভোট চেয়েছেন ছাত্রলীগ মনোনীত সদস্য প্রার্থী রাকিবুল ইসলাম ঐতিহ্য। নির্বাচনী আচরণবিধির ৩(ক) ধারায় বলা হয়েছে- কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী বা তার পক্ষে মনোনয়নপত্র জমাদান, মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার বা নির্বাচনী প্রচারণায় কোনো ধরনের যানবাহন, মোটরসাইকেল, রিকশা, ঘোড়ার গাড়ি, হাতি, ব্যান্ড পার্টি ইত্যাদি নিয়ে কোনোরূপ শোভাযাত্রা, শোডাউন বা মিছিল করা যাবে না।
এছাড়াও ভোটার নয়- এমন ব্যক্তিরা ছাত্রলীগের প্রার্থীদের পক্ষে ভোট চাইছেন। যেটি আচরণবিধির ৪(গ) ধারা অনুযায়ী স্পষ্ট লঙ্ঘন। ৭ই মার্চ কবি সুফিয়া কামাল হলে প্যানেল পরিচিত সভার মাইক রাত ১১টার পরও বাজিয়েছিল ছাত্রলীগ। যেটি আচরণবিধির ৫(জ) অনুযায়ী নিষিদ্ধ। ৮ই মার্চ কেন্দ্রীয় মসজিদসহ হল মসজিদগুলোতে ছাত্রলীগের প্যানেলের জন্য ভোট চান প্রার্থীরা। যেটি আচরণবিধির ৫(ছ) অনুযায়ী স্পষ্ট লঙ্ঘন। এছাড়াও গত কয়েক দিন ধরেই ক্যাম্পাসের বিভিন্ন দেয়ালে লিফলেট টানিয়েছে ছাত্রলীগ। যেটি আচরণবিধির স্পষ্ট লঙ্ঘন। ছাত্রলীগের সম্মিলিত শিক্ষার্থী সংসদের নামে শোভন-রাব্বানী-সাদ্দাম পরিষদের জন্য ভোট চেয়ে টি-শার্ট বানানো হয়েছে। যেসব টি-শার্টে শোভন-রাব্বানী-সাদ্দামের ছবিও রয়েছে। এসব টি-শার্ট ক্যাম্পাসের বিভিন্ন হলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের গায়ে শোভা পাচ্ছে। অথচ নির্বাচনী আচরণবিধির ৮(ঘ) ধারায় বলা হয়েছে- নির্বাচনী প্রচারণার জন্য কোনো প্রার্থীর ছবি বা তার পক্ষে প্রচারণামূলক কোনো বক্তব্য বা অন্য কারো ছবি বা প্রতীকের চিহ্ন সম্বলিত শার্ট, টি-শার্ট, জ্যাকেট, ফতুয়া বা কোনো ধরনের পোশাক ব্যবহার করা যাবে না।
আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছে ছাত্রদল ও বামজোটও: এদিকে শুধু ছাত্রলীগই নয়, আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছে ছাত্রদল ও বামজোটও। ছাত্রদল গত বুধবার ও বৃহস্পতিবার ক্যাম্পাসে মিছিল করেছে। যেটি আচরণবিধির স্পষ্ট লঙ্ঘন। এছাড়াও সংগঠনটি তাদের প্রার্থীদের পক্ষে ভোটার নয়- এমন ব্যক্তিকে দিয়েও প্রচারণা চালাচ্ছে। অন্যদিকে বামজোটের ভিপি প্রার্থী লিটন নন্দীও ক্যাম্পাসে ব্যান্ড পার্টির ব্যবহার করে আচরণবিধির লঙ্ঘন করেছেন। যদিও তিনি বিষয়টির অন্য ব্যাখ্যা দেন। তিনি বলেন, আমরা ব্যান্ড পার্টির ব্যবহার করিনি। আমরা প্রেরেড ড্রামের ছন্দে ছন্দে ভোট চেয়েছি। এটি আচরণবিধি লঙ্ঘন নয়। এর জন্য প্রয়োজনে আমরা প্রশাসনকে ব্যাখ্যা দেবে।
আচরণবিধি লঙ্ঘনের শাস্তি
আচরণবিধি লঙ্ঘনের শাস্তি হিসেবে ১৫(ক) ধারায় বলা হয়েছে- নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ করলে সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসার লিখিত অভিযোগ প্রাপ্তি ও তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এছাড়া সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসার প্রয়োজনবোধে স্বপ্রণোদিতভাবে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে পারবেন। ১৫(খ) ধারায় বলা হয়েছে- কোনো প্রার্থী বা তার পক্ষে কেউ নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ করলে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা জরিমানা, প্রার্থিতা বাতিল অথবা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার অথবা রাষ্ট্রীয়/বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী অন্য যে কোনো দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

No comments

Powered by Blogger.