পশ্চিমে হেরোইন পাচারের নয়া মহাসড়ক by নাজনীন আখতার

পা ঝুলিয়ে কাঠের বাক্সের ওপর বসে ছিলেন আলিজিয়া স্মিট (আসল নাম নয়)। পেছনে সবজি আর ফলের ঝুড়ি। ক্রেতার পথ চেয়ে অপেক্ষা। ঝুড়ির সবজি ও ফল বিক্রি না হলে বেশ অসুবিধায় পড়বেন তিনি। সংসার চলবে না—সে সমস্যার চেয়ে অন্য সমস্যা নিয়েই তিনি বেশি চিন্তিত। ছয় বছর ধরে এই ‘সংকট’ তাড়া করে ফিরছে। তাই বিক্রি ভালো না হলে অর্থ আয়ে আজও বিকল্প পথ ধরতে হবে এই নারীকে।
দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনের উইনবার্গে যে জায়গায় বসে আলিজিয়া এসব ভাবছিলেন, এর কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক যুবক। ক্রেতার পাশাপাশি এই যুবকের জন্যও অপেক্ষা থাকে আলিজিয়ার। যুবকের সঙ্গে তাঁর কোনো প্রেমের সম্পর্ক নেই। ওই যুবক একজন হেরোইন সরবরাহকারী। সবজি ও ফল বিক্রির অর্থ থেকে প্রতিদিন ওই যুবকের কাছ থেকে হেরোইন কেনেন আলিজিয়া। ছয় বছর ধরে আলিজিয়া হেরোইন সেবন করেন। প্রতিদিন তাঁকে স্থানীয় মুদ্রায় ৩০ র‌্যান্ড (১ ডলার = ১৪ র‌্যান্ড) দিয়ে হেরোইন কিনতে হয়। যেদিন হেরোইন কেনার জন্য যথেষ্ট সবজি বা ফল বিক্রি করতে না পারেন, সেদিন সন্ধ্যায় যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করেন। তাঁর ভাষায়, ‘হেরোইন সবচেয়ে খারাপ জিনিস। প্রথম মাদক হিসেবে হেরোইন নিয়েছিলাম, আর পালাতে পারছি না।’
সাম্প্রতিক সময়ে আফ্রিকায় হেরোইন আসক্তির যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তা আগে কখনো ছিল না। আশি ও নব্বই দশকে জানজিবার বা শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের শহর জোহানেসবার্গের মতো পর্যটন স্থানগুলোতেই হেরোইনে আসক্ত লোকজনকে পাওয়া যেত। জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধবিষয়ক কার্যালয়ের (ইউএনওডিসি) তথ্য অনুসারে, ২০০৬ সালের পর অন্য যেকোনো মহাদেশের তুলনায় আফ্রিকায় হেরোইনে আসক্তি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। এই হেরোইন–বাণিজ্য ভয়াবহ ধ্বংস ডেকে আনছে। এটা শুধু জনস্বাস্থ্য নয়, রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলছে।
আফ্রিকায় হেরোইনের ব্যবহার বাড়ায় তা প্রভাব ফেলেছে বৈশ্বিক সরবরাহে। আফগানিস্তানের বেশ কিছু অঞ্চল তালেবানদের দখলে রয়েছে। সেখানে বিশ্বের ৮৫ শতাংশ হেরোইন উৎপাদিত হয়। আফগানিস্তানে হেরোইনের মূল উৎস পপি চাষ বেড়েছে। এক জাতের পপি থেকে উৎপাদন করা হয় আফিম।
ইউএনওডিসির তথ্য অনুসারে, ২০১৭ সালে আফিম উৎপাদন রেকর্ডসংখ্যক ৬৫ শতাংশ বেড়ে সাড়ে ১০ হাজার টন হয়েছে।
মেক্সিকো থেকে উদ্ধার করা ব্যাগভর্তি মাদকদ্রব্য। ছবি: রয়টার্স ফাইল
শুধু হেরোইনের উৎপাদন যে বেড়েছে তা নয়, আফ্রিকা হয়ে তা পাচারও হচ্ছে বিভিন্ন দিকে। আগে বলকান সড়কপথে ইরান, তুরস্ক ও দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ ঘুরে পশ্চিমে পৌঁছে যেত হেরোইন। এটাই পশ্চিমে হেরোইন পাচারের মূল পথ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। তবে এক দশক ধরে ওই পথে মাদক পাচার কঠিন হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে, সিরিয়া ও ইউরোপীয় দেশগুলোর যুদ্ধের কারণে শরণার্থী ঠেকাতে সীমান্ত এলাকা কড়া নজরদারিতে রেখেছে তুরস্ক। এ কারণে বেশির ভাগ হেরোইন পাচার এখন সরে গেছে ‘দক্ষিণাঞ্চলীয় রুটের’ দিকে।
এই পথে হেরোইন আফগানিস্তান থেকে পাকিস্তানের মাকরান উপকূলীয় এলাকায় নেওয়া হয়। আরব দেশের পালতোলা নৌকা স্থানীয়ভাবে যেগুলোকে ধৌস বলা হয়, সেগুলোয় করে পাচার করা হয় সেই হেরোইন। কোনো কোনো হেরোইন বড় জাহাজে কন্টেইনারে করেও পাচার করা হয়। ধৌস দক্ষিণ-পশ্চিমে ভারত মহাসাগর হয়ে সোমালিয়া, তানজানিয়া ও মোজাম্বিকের দিকে যায়। সেখান থেকে হেরোইন স্থলপথে দক্ষিণ আফ্রিকা এবং জলপথে বা আকাশপথে ইউরোপ, আমেরিকায় পাচার করা হয়।
কর্তৃপক্ষ এই পাচার রোধে প্রচণ্ডভাবে ব্যর্থ হয়েছে। ২০১০ সাল থেকে আরব সাগরে মার্কিন নেতৃত্বাধীন যৌথ নৌবাহিনী টহল দেয়। তবে এই বাহিনী মূলত সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে কাজ করে। মাদক পাচারকারীদের ধরা তাদের মূল কাজ নয়। মাদক ব্যবসার মাধ্যমে তালেবানদের অর্থায়ন হয়, সেই চিন্তা থেকে কখনো কখনো পাচারকারীদের ধরা হয়। তবে মাদক পাচারকারীদের গ্রেপ্তারে এই বাহিনীর কোনো বাধ্যবাধকতাও নেই। অন্যদিকে, আফ্রিকা ভূখণ্ডে পাচারকারীদের আটকের হার অনেক কম। কর্তৃপক্ষ ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার কারণে পাচারকারীদের ধরার চেষ্টাও করে না পুলিশ।
মাদকদ্রব্য উদ্ধারে মেক্সিকোর এক শহরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান। ছবি: রয়টার্স ফাইল
বলা হয়ে থাকে, মোজাম্বিকে কয়লার পর হেরোইন পাচারই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আয়ের উৎস। কারও কারও মতে, হেরোইন পাচারই সেখানে প্রধান আয়ের উৎস। তবে এ তথ্য যাচাই করা সত্যিই কঠিন। মোজাম্বিকে এ পাচার নিয়ন্ত্রণ করে প্রভাবশালী পরিবার। এর সঙ্গে শাসক দল মোজাম্বিক লিবারেশন ফ্রন্টের (ফ্রেলিমো) নেতাদের যোগসাজশ রয়েছে। মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িত একজন জানান, লেনদেন হয় চোরাকারবারি ও রাষ্ট্রের মধ্যে।
রাজনৈতিক অনুদান ও ব্যক্তিস্বার্থে ফ্রেলিমো পাচারকারীদের গ্রেপ্তার করা থেকে রক্ষা করে। শাসক দলটি পাচারকারীদের পণ্য আমদানি-রপ্তানির জন্য নাকালা বন্দরে নিরাপত্তাব্যবস্থা ঢিলেঢালা রাখে। সেখানে কী পণ্য আনা-নেওয়া হচ্ছে, তা ভালোভাবে দেখাও হয় না। ফ্রেলিমোর সরকারি ছাড়পত্র ব্যবহার করে একবার এক পাচারকারী শত শত মোটরসাইকেল আমদানি করেছিল। ওই সব মোটরসাইকেলের পেট্রল ট্যাংক হেরোইন প্যাকেট দিয়ে ভর্তি ছিল।
পাচারেরে এত সব ঘটনা ঘটলেও পাচারকারীদের গ্রেপ্তারে তেমন কোনো তৎপরতা নেই দেশটির সরকারের। দক্ষিণ আফ্রিকার অপরাধ-গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের অভিযোগ, মাদক পাচার নিয়ে তাঁদের করা তদন্ত মোজাম্বিকের কারণে বাধাগ্রস্ত হয়। হেরোইন পাচারসহ অবৈধ সব বাণিজ্যের কারণে দেশটির দক্ষিণে বিদ্রোহ গ্রুপগুলোর দাপট বেড়ে চলেছে।
মাদক ব্যবসা দক্ষিণ আফ্রিকাকেও একইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ভালো অবকাঠামো ও দুর্বল মুদ্রার কারণে জলপথে অন্য দেশে হেরোইন পাচারে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয় দেশটি। মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কেপটাউনে হত্যার ঘটনাও বেড়ে চলেছে। তবে শুধু পাচার নয়, দেশটির অভ্যন্তরও হেরোইনে সয়লাব হয়ে যাচ্ছে। একদল মাদক বিক্রেতা নানা কৌশলে নতুন নতুন ক্রেতা জোগাড়ে মাঠে সরব রয়েছে।
যাঁকে নিয়ে লেখাটি শুরু হয়েছিল, সেই আলিজিয়া স্মিট জানান, জুমা নামের ৩৫ বছর বয়সী তানজানীয় এক অভিবাসী তাঁকে হেরোইনে আসক্ত করেন। জুমা জানান, নতুনদের বিশেষ ছাড়ে ‘উদ্বোধনী প্যাকেজ’ দেওয়া হয়। বারবার কেনেন যাঁরা, তাঁরা পুরস্কৃত হন। প্রতি পাঁচটি গুটির জন্য ৩০ র‌্যান্ডের একটি প্যাকেট বিনা মূল্যে দেওয়া হয়। ‘বুস্টার প্যাক’-এর জন্য তিনি নেন ৫০০ র‌্যান্ড। এর থেকে ২৫০ র‌্যান্ড তাঁর লাভ থেকে যায়। তবে এসব বেচার জন্য ‘সুরক্ষা’ পেতে তাঁকে মাদকচক্রকে নিয়মিত ‘কর’ দিতে হয়।
তবে আগের স্বাভাবিক জীবনের জন্য বেশ আফসোস হয় জুমার। বললেন, মাদক বেচে যা আয় করেন, তা তিনি তানজানিয়ার আধা স্বায়ত্তশাসিত এলাকা জানজিবারে টেলিফোন খুঁটি মেরামত করেও পেতেন। তবে স্ত্রী ও দুই সন্তানের সংসারে ওই আয় যথেষ্ট না হওয়ায় কেপটাউনে চলে আসেন। বিরক্তি নিয়ে বললেন, ‘এই জীবন অনেক কঠিন, বস।’
ব্রায়ান নামের উগান্ডার এক যুবক জানান কীভাবে তিনি মাদক পাচারের চক্রে পড়েছিলেন। মাদক পাচারে জড়ানোর আগে উগান্ডার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পশু চিকিৎসা বিজ্ঞানে পড়াশোনা করছিলেন। পাঁচ হাজার ডলারের টোপে তিনি মাদক পাচারে রাজি হন। প্রথমবার তিনি তানজানিয়ার জানজিবার থেকে মাদক সংগ্রহ করেন। ব্রায়ান জানান, প্রতিটি ধাপে তাঁকে নতুন নতুন লোকের সঙ্গে দেখা করতে হয়েছিল, এক ধাপের লোক অন্য ধাপে যাওয়ার পথ বাতলে দিচ্ছিল। জানজিবারে স্টোন টাউন নামে একটি হোটেলের কক্ষে একজন আরব লোক তাঁকে এক কেজি মাদক দেন। মাসকিং টেপে খুব শক্তভাবে মোড়ানো একেকটি গুটি তিনি পানি দিয়ে গিলে নেন। ১৫ মিনিটে এমন ১০০টি গুটি তাঁকে গিলতে হয়। একটি গুটি মাসকিং টেপ ফেটে কোনোভাবে তাঁর দেহে ছড়িয়ে গেলে মৃত্যু অনিবার্য। অথচ তিনি এ সম্পর্কে সচেতনও ছিলেন না। তাঁর ভাষায়, টেপে মোড়ানো গুটি গিলে নিলে কোনো ক্ষতি হয় না।
ভারত মহাসাগরে কেনিয়ার নৌবাহিনী হেরোইন পাচারের অভিযোগে এই নৌকা আটক করেছিল। ছবি: রয়টার্স ফাইল
১০০ গুটি গিলে নেওয়ার পর ব্রায়ানকে পরবর্তী ধাপের কথা জানান ওই আরব লোক। এরপর ব্রায়ান টানা ৪৮ ঘণ্টা বাসযাত্রা করেন। তানজানিয়া থেকে উগান্ডা ফিরে আসতে তিনটি সীমান্ত পাড়ি দিতে হয় তাঁকে। তাঁর দেহ থেকে এক কেজি হেরোইন বের করে আনার পর তা আবার প্যাকেট করা হয় এবং অন্য পাচারকারীদের মারফতে আকাশপথে তা চলে যায় ইউরোপে।
দক্ষিণ আফ্রিকায় হেরোইন ব্যবহারকারীর প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে তেমন কোনো তথ্য নেই। প্রায় দুই দশক আগে এক হাজারের বেশি লোক মাদক নিরাময়ের চিকিৎসা নিয়েছে। তবে এটা ব্যবহারকারীদের একটি ভগ্নাংশ মাত্র। এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, ইনজেকশনের মাধ্যমে হেরোইন নিয়ে থাকে—এমন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৭৫ হাজার। অনেকে হেরোইন কাপড় ধোয়ার গুঁড়া সাবানের সঙ্গে বিষাক্ত ককটেল তৈরি করে সিগারেটের মতো ব্যবহার করে। ঘুমের ট্যাবলেট ও উত্তেজক মেথামফেটামাইনসের মাধ্যমেও ব্যবহার করে অনেকে। অনেকে বিপজ্জনক ‘ব্লুটুথিং’ পদ্ধতি প্রয়োগ করে। এর মাধ্যমে হেরোইনের ককটেল গ্রহণের পর এক মাদকাসক্ত অন্য মাদকাসক্তের দেহের রক্ত ইনজেকশনের মাধ্যমে বের করে নিজের দেহে প্রবেশ করায়। দেশটিতে এইচআইভির প্রকোপ থাকায় এই পদ্ধতি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কেপটাউনে ‘ক্যাম্প জয়’ নামের একটি মাদকাসক্ত নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র চালান ক্র্যাভেন অ্যানজেল। মাদক পাচারের কাজ করতে গিয়ে যাঁরা মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন, তাঁদের সেখানে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়। ক্র্যাভেন অ্যানজেল বলেন, হেরোইন এখন একটি অভিজাত মাদক হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাদকচক্রের একজন জানান, তাঁরা অনেকে মাদক নেন মাদক ব্যবসা নিয়ে সহিংস লড়াইয়ের স্মৃতি ভুলের যাওয়ার জন্য।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, মাদকদ্রব্য পাচারে দক্ষিণাঞ্চলের পথটি যত দিন সচল থাকবে, তত দিন মাদক সমস্যার সমাধান করা সহজ হবে না।
সূত্র: ইকোনমিস্ট, দ্য ডেইলি বিস্ট

No comments

Powered by Blogger.