গুণ্ডাতন্ত্র চলছে আমাকে গুলি করে মারা হোক: প্রতিরোধের ডাক ড. কামাল বি. চৌধুরী, ফখরুল, মান্নার

গণফোরাম সভাপতি ও সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেন বলেছেন, দেশে গণতন্ত্র নেই। দেশে গুণ্ডাতন্ত্র চলছে। লাঠিসোঁটা নিয়ে নিরীহ সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকে গুণ্ডামি ছাড়া আর কিইবা বলা যেতে পারে। এমন অন্যায় হামলাকে ব্যক্ত করার জন্য বাংলায় এর চেয়ে ভালো আর কোনো শব্দ কি আছে? আর পুলিশের পাশে এসব লাঠিয়াল কেন। পুলিশের পাশে থেকে কারা ছাত্রদের ওপর হামলা করেছে। তারা নাকি পুলিশকে সহায়তা দিচ্ছে। এতে তো পুলিশকেও অপমান করা হচ্ছে। আমরা পুলিশের পাশে গুণ্ডা দেখতে চাই না। আমরা গুণ্ডামুক্ত বাংলাদেশ চাই। গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবে উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজের ব্যানারে আয়োজিত সংহতি সমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন। ড. কামাল বলেন, আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেয়া হোক। গুলি করে মেরে ফেলুন আমাদেরকে। তাহলে অন্তত বলতে পারবো। গুণ্ডাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকে মারা গেছি। সৃষ্টিকর্তার বড় দান হলো বিবেক। দেশে তরুণ সমাজ আজ জাগ্রত হয়েছে। এটা আমাদের জন্য বড় শক্তি।
পুলিশ মহাপরিদর্শককে (আইজিপি) উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, আইজি সাহেব, আপনি সরকারের চাকর নন। রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালন করছেন। অফিসে আইজি-ডিআইজির পাশে চেয়ারে কেন গুণ্ডারা বসবে। পুলিশের পাশে সাদা পোশাকের গুণ্ডারা কেন সাধারণ মানুষের ওপর হামলা করবে। আপনি দায়িত্ব পালন করুন, নয়তো পদত্যাগ করুন।
সভাপতির বক্তব্যে জনস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, আমাদের সমস্যা কত গভীরে তা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি। দু’দিন আগে ধামরাইয়ে দুর্ঘটনায় ৫জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে ৪ জনই ছাত্র। গত ২৯শে জুলাই নিহত দু’ছাত্রের পরিবারকে ২০ লাখ টাকা করে দেয়া হয়েছে। এভাবে যদি দিতে যান গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত সাত সহস্রাধিক পরিবারকে দিতে লাগবে ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। দিন না তাদের সবাইকে। আর ১৬ লাখ ফিটনেসবিহীন গাড়িকে লাইসেন্স দেয়া শুরু করলে, দিনে ২০০ করে দিলে কত দিন লাগবে দেখুন। চলমান ছাত্র আন্দোলনকে সমর্থন দিয়ে তিনি বলেন, এখন বলা হচ্ছে ছাত্ররা স্কুলে ফিরে যাক। তা জবাব হতে পারে না। জবাব হতে পারে, রাষ্ট্রের মেরামত হোক।
ওই সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ছেলেরা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। এ আন্দোলন সবাইকে নাড়া দিয়েছে। জাতীয় ঐক্য ছাড়া এই ভয়ংকর সময় থেকে আমাদের মুক্তির উপায় নেই। ছেলেরা আমাদের সেই জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে। এখন আমরা রাজনীতিবিদরা সেই জায়গায় আসবো কিনা সিন্ধান্ত নেয়ার সময় এসেছে।
সমাবেশে সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বিকল্পধারার সভাপতি অধ্যাপক ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেছেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে পুরো জাতি উদ্বিগ্ন। শুধুমাত্র দেশপ্রেমেই শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমেছে। তারা ৯ দিন ধরে রাস্তায়। পুলিশের সহায়তায় সরকারি গুণ্ডাবাহিনী সাধারণ ছাত্রদের ওপর হামলা চালিয়েছে। দা-লাঠি নিয়ে তাদের ওপর আক্রমণ করছে। আমাদের সন্তানদের রক্তাক্ত করার অধিকার কারো নেই। গুণ্ডাদের নেই। এমন পরিস্থিতি দেখে আমাদের লজ্জা হয়।
তিনি আরো বলেন, যারাই এ আন্দোলনে সমর্থন দিচ্ছে তাদেরকে রাজনীতি করা হচ্ছে বলে অপবাদ দেয়া হচ্ছে। চট্টগ্রামের এক বিএনপি নেতার বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ তোলা হচ্ছে। রাজনীতি তো করবেই। দেশে কি রাজনীতি নিষিদ্ধ? এখন পুলিশ তোড়জোড় করে ট্রাফিক সপ্তাহ পালন করছে। পুলিশ আগে ঠিক করুক তাদের লাইসেন্স আছে কি না? এখন ১৪ দল ক্ষমতায়। অথচ তাদের মধ্যে ভারসাম্য নেই বলেই আওয়ামী লীগ যা ইচ্ছা তাই করছে।
সমাবেশে চলমান ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দীন আহমেদ বলেন, ছাত্রদের আন্দোলন অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত। ভাবতাম তরুণরা ফেসবুক নিয়ে ব্যস্ত। এখন দেখতে পাচ্ছি তারা সমস্যা নিয়েও সচেতন। তারাই আমাদের বাঁচাবে। কিন্তু এখন দেখছি তারা বঞ্চনার শিকার।
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ছাত্ররা লিখেছে ‘রাস্তা বন্ধ, রাষ্ট্রের মেরামত কাজ চলছে।’ কিন্তু জিগাতলায় ১০ থেকে ১৫ বছরের সেই শিশুদের ওপর হামলা করা হয়েছে। আমরা কী তাদের চিনি না? কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। তিন মাস আগে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়। ব্যবস্থা নেয়ার নামে তাদের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। একইভাবে তিন মাস পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রদের সঙ্গেও প্রতারণা করা হবে। কথা দিয়ে যদি কথা না রাখে, কাজ না করে তাহলে একযোগে নেমে পড়। এটা বিনা ভোটের সরকার। বিনা ভোটে ক্ষমতায় থাকতে দেব না। অধিকাংশ যানবাহনেরই ফিটনেস এবং গাড়ি ও চালকের লাইসেন্স নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহীম বলেন, জিগাতলায় ছাত্র ও সাংবাদিকদের ওপর যে আক্রমণ হয়েছে তা মেনে নেয়া যায় না। কারো অনুমতি নিয়ে তো আর আন্দোলন হয় না। অনুমতি তো দিবে না। অনুমতি নিয়ে তো পরিবর্তন আসবে না। হাইকোর্টের রায়েও তা আসবে না। লক্ষ্যবস্তু ঠিক রেখে, তার ওপর অবিচল থেকে এগিয়ে যেতে হবে।
সমাবেশ সঞ্চালন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক ড. আসিফ নজরুল। এ সময় তিনি বলেন, রাজপথ এখন মৃত্যু ফাঁদে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন ২০ জন মানুষ খুন হচ্ছে। স্বাভাবিক দুর্ঘটনা হলে তাকে মৃত্যু বলা যেত। কিন্তু গাড়ির লাইসেন্স না থাকা, ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকা, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, মাতাল হয়ে বেপরোয়াভাবে চালানোয় যে মৃত্যু, খুন ছাড়া তা আর কী। ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী, এমপি, পুলিশ ও সরকারি গাড়িতে লাইসেন্স নেই। ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী-এমপিরা তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি ও বিত্তবৈভবের জন্য নিয়ন্ত্রণহীন বাস রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছে।
তিনি আরো বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন আন্দোলনে তৃতীয়পক্ষ ঢুকে পড়েছে। এই তৃতীয়পক্ষ হলো ছাত্রলীগ-যুবলীগ। তিনি আরো বলেন, ছাত্ররা গাড়ির লাইসেন্স চেক করছে। এর মধ্য দিয়ে এই সরকারের ক্ষমতায় থাকার লাইসেন্স আছে কিনা সেই প্রশ্ন তুলেছে। দুর্নীতির লাইসেন্স আছে কিনা সেই প্রশ্ন তুলেছে। সবক্ষেত্রে বৈধতার প্রশ্ন তুলেছে তারা। তাদের আন্দোলনকে ফেসবুকে সমর্থন করলেও বলা হচ্ছে ষড়যন্ত্র। হচ্ছে ৫৭ ধারায় মামলা। ছাত্র ও কোটা আন্দোলন যারা করে তারা গুম-খুনের শিকার হয়। কিন্তু যারা হামলা, ব্যাংক লুট এসব করে তারা গুম হয় না।
সংহতি সমাবেশে ডাকসুর সাবেক ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ, জেএসডির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মালেক রতন, নাগরিক ঐক্যের উপদেষ্টা সাবেক এমপি এসএম আকরাম বক্তব্য রাখেন। বিকল্পধারার মহাসচিব মেজর আবদুল মান্নান, গণফোরামের অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরীও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

No comments

Powered by Blogger.