প্রেমের জোয়ারে নেশার জগতে ওরা by মরিয়ম চম্পা

সুবর্ণা। যেমন নাম, তেমন তার রূপ। রাস্তায় বেরুলে হাজারো যুবক তার দিকে চেয়ে থাকতো। কেউ কেউ সাহস করে প্রেমের প্রস্তাব দিতো। তখন সুবর্ণা স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে পা দিয়েছে। তার জীবনে আসে রওনক নামের এক স্মার্ট বয়। সুবর্ণা প্রেমে পড়ে তার। কত সময় একসঙ্গে কাটিয়েছে তার হিসাব নেই। রওনক সিগারেট খেতো।
এক টান দুই টান করতে করতে সুবর্ণাও এক সময় চেইন স্মোকার হয়ে যায়। একটা সময় সিগারেটে যেন তার পোষায় না। রওনকের সঙ্গে শিসা, গাঁজা, হেরোইন, ফেনসিডিল অবশেষে ইয়াবার নেশায় আসক্ত হয়। একসময় রওনককে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেতে বন্ধুদের সহযোগিতায় গোপনে কাবিন করে।
এরপর শুরু হয় নতুন অশান্তি। মেয়ের অশান্তির ধকল সইতে না পেরে দুঃখ-কষ্টে বাবা মারা যান। এসবই সুবর্ণার মুখের কথা। খানিকটা বিরতি নিয়ে একটু পানি খেলো সুবর্ণা। পুরো সময়টাজুড়েই তার চোখ দুটোকে খুব অশান্ত মনে হয়েছিল। আবার বলতে থাকেন, বাবা মারা যাওয়ার পর রওনকের সঙ্গেও সম্পর্ক চুকে যায়।
এরপর তার মা দিশাহারা অবস্থায় মেয়েকে বিভিন্ন রিহ্যাব সেন্টারে ভর্তি করেন। লং টাইম রিহ্যাবে থাকার পর বাসায় গিয়ে সুযোগ পেলেই নেশায় বুঁদ হয়ে যায়। এভাবে ৭-৮টা রিহ্যাবে ট্রিটমেন্ট নিয়েছে সে। সর্বশেষ পান্থপথের ব্রেইন অ্যান্ড লাইফ হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়। দুই বোনের মধ্যে বড় সে। ছোটবোনও কিছুটা আসক্ত হলে টের পেয়ে মা তাকে বিয়ে দিয়ে দেন। মা-মেয়ের সংসারে ছেলে গার্ডিয়ান না থাকায় অনেকটা ডেসপারেট সুবর্ণা। নিজেদের বাসাভাড়া, দোকান ভাড়ার টাকা দিয়ে সুযোগ পেলেই নেশা করে। এখনো মাঝে মাঝে লেটনাইটে বাসায় ফিরে। কখনো কখনো বান্ধবীর বাসায় আছে বলে তিন-চার দিনেও বাসায় ফেরে না। এভাবেই চলছে দিন রাত্রি।
আরেক কাহিনী। নাম ময়না হলেও বাবা-মা আদর করে ময়না পাখি বলে ডাকতো। মা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। বাবা ল্যান্ড প্রপার্টি বেচাকেনার ব্যবসা করেন। এক ভাই এক বোনের মধ্যে ময়না ছোট। বড় ভাই ও বাবা-মায়ের অনেক আদরের ময়না হঠাৎ করেই যে খাঁচার বাইরের আদারের দিকে ঝুঁকবে ভুলেও বুঝতে পারেনি কেউ। অতি ব্যস্ততার কারণে বাবা-মা কেউই ময়নাকে সময় দিতে পারে না। ফলে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে পা রাখবে ঠিক এমন সময় রাহাত নামের কলেজপড়ুয়া কিশোরের সঙ্গে মন দেয়া-নেয়া হয় ময়নার। প্রেমিক রাহাতের অনুরোধে প্রথমে সখের বসে সিগারেটে আসক্ত হয়। মাঝে মধ্যে বন্ধুদের আয়োজনে ছোট-বড় বিভিন্ন ধরনের পার্টিতে অংশ নিতো। পরবর্তীকালে বন্ধুদের সঙ্গে রাত জেগে আড্ডা, দিনের বেলায় অনেক বেলা করে ঘুমানো।
এসব দেখে বাবা-মায়ের সন্দেহ হলে জানতে পারে, তাদের ময়না পাখি আধার খেতে শিখে গেছে। বাসার আধারে তার মন বসে না। অনেক চেষ্টার পর প্রেমিক রাহাতের সঙ্গে তার সম্পর্কটা চুকাতে পারলেও ইয়াবার নেশাটা চুকাতে পারেনি বাবা-মা। সুযোগ পেলেই বাসা থেকে পালিয়ে সাবেক প্রেমিক বা পরিচিত ইয়াবা পার্টনারদের সঙ্গে নেশা করে। একসময় খুব উশৃঙ্খল জীবনে জড়িয়ে সামাজিকভাবেও বিছিন্ন হয়ে পড়ে। এত চাপ সামলাতে না পেরে সম্প্রতি ময়না একটি মাদক নিরাময় কেন্দ্র থেকে বাসায় ফিরে বেডরুমে আত্মহত্যা করে।
ব্রাক্ষ্মণবাড়ীয়ার মেয়ে রুমকি। বাবা সরকারি কর্মকর্তা। মা হাসপাতালের নার্স। হঠাৎ কোনো একটা অসুস্থতাজনিত কারণে রুমকিকে তার মা ঘুমের ওষুধ খেতে দেন। এরপর একটি অপারেশনের সময় প্যাথেডিন ইনজেকশন দেয়া হয়। পরবর্তীকালে সে প্যাথেডিনটা কনটিনিউ করতে থাকে। গত ২০ বছর ধরে এমনটাই চলছে রুমকির। ল’য়ের শিক্ষার্থী রুমকি এরই মাঝে ভালোবেসে বিয়ে করেছে। কিন্তু সংসারের সুখ বেশি দিন তার কপালে জোটেনি।
রুমকির স্বামী যখন জানতে পারেন তার স্ত্রী মাদকাসক্ত তখন সে স্বেচ্ছায় স্ত্রীর কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন। তার ভাষায়, অন্ধ অক্ষমের সঙ্গে সংসার করা যায়, কিন্তু মাদকাসক্তের সঙ্গে নয়। পরবর্তীকালে বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকলেও নেশা ছাড়তে পারেনি রুমকি। বাবা-মা অবস্থাসম্পন্ন হওয়াতে হাত বাড়ালেই নেশার টাকা পেয়ে যেত। একইসঙ্গে ড্রাগ বা নেশা জাতীয় দ্রব্য অ্যাভেল্যাভেল হওয়াতে রুমকি দিনে দিনে নেশার প্রতি এতটাই বুঁদ হয়েছে যে বয়স ৪০-এর কোঠায় হলেও তরুণ মাদকাসক্তদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে নেশা করে সে। এক পর্যায়ে বাবা-মা দুজনেই হাল ছেড়ে দেন। এখন রুমকির ঠিকানা কালেভদ্রে বাবার বাড়ি এবং ঢাকা শহরের বিভিন্ন মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে। এভাবেই হয়তো চলতে থাকবে আমৃত।
ঢাকার নামকরা এক ইংলিশ মিডিয়ামের শিক্ষার্থী স্বর্ণা। ইতিমধ্যে বিদেশের শিক্ষার পাঠও চুকিয়েছে সে। বাবা বড় রাজনীতিবিদ। মা গৃহিণী। দুই ভাইবোনের মধ্যে স্বর্ণা ছোট। স্বর্ণার নেশার হাতে খড়ি সিগারেটের মধ্যদিয়ে। ছোটবেলায় বাবাকে সিগারেট খেতে দেখেই একসময় সিগারেটের প্রতি আসক্ত হয় স্বর্ণা। বাবার সঙ্গে প্রায় বিদেশ যাওয়ার সুবাদে সেখানকার ওয়েস্টার্ন কালচার মেইনটেন করা ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বাবার সামনে সিগারেট খেত।
আমুদে বাবা মৌন থেকেই অনেকটা সায় দিতেন সিগারেটের প্রতি। একসময় গাঁজা ধরে। তখনও বাবা খুব একটা কিছু বলতেন না। মা শাসন করতে চাইলেও বাবার প্রশ্রয়ে তেমন পেরে উঠতেন না। একসময় নেশার সর্বশেষ স্তরে পৌঁছায় স্বর্ণা। পরিবারের মাঝে থেকেও একা হয়ে পড়ে স্বর্ণা। ফলে নেশাটাকেই আপন করে ফেলে। পরবর্তীকালে পছন্দ করে এক ছেলেকে বিয়ে করে। সেও মাদকাসক্ত। স্বর্ণার কোলজুড়ে দুই ছেলে মেয়ে আসলেও স্বামী-স্ত্রী কেউই মাদকের জগত থেকে বের হতে পারেনি। অবশেষে তাদের ডিভোর্স হয়ে যায়। এখন ছেলে-মেয়ে নিয়ে বাবার বাসাতেই থাকে। সম্প্রতি সে মাদক কেনাবেচার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। প্রায়ই বন্ধুদের সঙ্গে বিদেশ ভ্রমণে যায় স্বর্ণা। মাঝে মাঝে রিহ্যাব সেন্টারে ট্রিটমেন্ট নিলেও বাইরে গিয়ে সব ভুলে যায়।
বাংলাদেশে এক নারী স্বামীর হাত ধরে কিভাবে ইয়াবায় আসক্ত হয়েছে সম্প্রতি এমনই একটি আলোচিত ঘটনা উঠে এসেছে বিবিসি বাংলায়। নারী জানায়, দ্বিতীয় স্বামীর মাধ্যমে ইয়াবার সঙ্গে আমার পরিচয়। সে একজন সরকারি কর্মকর্তা। সে আমাকে অনেক ভালোবাসতো। একদিন সে বাড়িতে অনেকগুলো ইয়াবা নিয়ে আসে। স্বামীর কাছে জানতে চায় ট্যাবলেটের মতো দেখতে এগুলো কী? তখন সে বলে, এটা খুব ভালো জিনিস। এখন এটা সবাই খায়, মেয়েরাও খায়।
আর তুমি তো আমার স্ত্রী। সুতরাং তুমিও আমার সঙ্গে খাবে। আমি মনে করলাম, যদি তার সঙ্গে বসে না খাই তাহলে হয়তো সে বাইরের মেয়েদের সঙ্গে গিয়ে খাওয়া শুরু করবে। তখন আমি তার সঙ্গে খাওয়া শুরু করি। এভাবে কয়েক মাস ধরে স্বামী-স্ত্রী মিলে বাড়িতে একসঙ্গে ইয়াবা খেতে থাকি। তিন মাস পর আমি খুব অসুস্থ হয়ে পড়ি। এত শুকিয়ে যাই, আমাকে ৮০ বছরের বৃদ্ধ মহিলার মতো দেখাতো। শরীর পুরোটা কালো হয়ে গিয়েছিল। আমার শরীরে অর্ধেক কাপড় থাকতো, অর্ধেক থাকতো না। আমি সারাক্ষণ মাথা আঁচড়াতাম। মনে হতো মাথায় শুধু উকুন।
যে-ই দেখতো সে-ই আমাকে পাগল মনে করতো। মা যখন আসতো তখন আমি তার সঙ্গে খুব খারাপ আচরণ করতে শুরু করি। খেতেও পারতাম না। কিছু মুখে দিলে সেটা রবারের মতো শক্ত লাগতো। তখন আমি খুব অসুস্থ। আমার মা একদিন ভাত মেখে আমাকে খাওয়াতে যাবেন, তখন আমার মনে হলো আমাকে তিনি কেঁচো খাওয়াচ্ছেন। কিছুক্ষণ পর আমি বমি করতে শুরু করি। তখন মা আমাকে তার বাসায় নিয়ে যায়। সেখানে আমাকে চিকিৎসা দেয়া হয়। স্বামীকে না জানিয়েও আমার চিকিৎসা চলতে থাকে। মায়ের বাসায় তিন বছরের মতো ছিলাম। তারপর নিজের বাসায় চলে যাই। তখন আবার স্বামী প্রত্যেক দিন ইয়াবা নিয়ে আসতে শুরু করে। প্রত্যেক রাতে ২০টা করে খেতো। সে নিজে নষ্ট, এবং তার নোংরামির শিকার হয়েছি আমিও। তারপর আমি আবারও ইয়াবাতে আসক্ত হয়ে পড়ি।
এ বিষয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. মো. ফারুক আলম বলেন, আগে ছেলেদের মধ্যে মাদকাসক্ত বেশি থাকলেও ইদানিং মেয়েদের মধ্যে এটা বেড়ে যাচ্ছে। মেয়েদের মাদকাসক্তের কয়েকটা ধরন রয়েছে। ফেনসিডিল ও হেরোইনের প্রতি আসক্ত কম। মেয়েদের মধ্যে বিড়ি, সিগারেট, ঘুমের ওষুধ, ইয়াবা খুব জনপ্রিয়। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে এগুলো খুব সহজলভ্য। মেয়েদের ইয়াবা গ্রহণের আর একটি বিশেষ কারণ হচ্ছে, তাদের ধারণা ইয়াবা খেলে স্লিম হওয়া যায়।
যেসব মেয়েরা ফিট থাকতে চায় তারা ইয়াবা খেয়ে খিদা কমায়। গত জুন মাসে দেশব্যাপী ১৯ হাজার ৮শ জনেরও বেশি ব্যক্তির ওপর একটি সার্ভে করা হয়। যেখানে ৩.৩৩% ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে মাদকাসক্ত। মেয়েদের মাদকাসক্ত থেকে ফেরাতে হলে সরকারি পদক্ষেপে এর সাপ্লাই বা সরবরাহ বন্ধ করতে হবে। তখন এটা এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে। পাশাপাশি বন্ধুদের সঙ্গে ফ্রেন্ডশিপ থাকবে কিন্তু আড্ডা দেয়া যাবে না। একই সঙ্গে পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় ও স্কুল-কলেজ পর্যায়ে মাদকের কুফল সম্পর্কে ছেলে-মেয়েকে কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে মাদকের ক্ষতিকর দিক বোঝাতে হবে। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ডিজি জামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রাথমিকভাবে একটি ভুল ধারণা থেকে অধিকাংশ নারী মাদক নিয়ে থাকেন। তারা ভাবেন মাদক নিলে তাদের সৌন্দর্য ও স্মার্টনেস বাড়ে। এভাবেই তারা প্রলুব্ধ হয়। আরেকটি অন্যতম কারণ হচ্ছে তার সঙ্গী। সঙ্গী মাদকাসক্ত হওয়ায় সেও খুব সহজেই মাদক ধরে ফেলে। এটা পুরুষ কিংবা অনেক সময় নারী সঙ্গীর দ্বারাও আসক্ত হতে পারেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নারীদের বিভিন্ন কারণে তৈরি হওয়া হতাশা থেকেও তারা মাদক গ্রহণ করে। সিগারেটকে নেশা জগতের প্রবেশ দ্বার বলা চলে। এটা নারী-পুরুষ সবার জন্য প্রযোজ্য।
সব ধূমপায়ী ড্রাগ এডিক্টেড নয়, কিন্তু দেখা যায় ৮০ জন ড্রাগ এডিক্টেডই ধূমপায়ী ছিল। অনেক সময় নারী শিক্ষার্থীরা রাত জেগে পড়াশোনা করতে ইয়াবা খেয়ে থাকে। কাজেই ইয়াবা বা যেকোনো নেশাই দিন শেষে তাদের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনে না, এই তথ্যটি সবাইকে জানাতে হবে। পাশাপাশি তাদের সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যোবোধের চর্চা করতে হবে। যেটা তাদের সব রকম হতাশা কাটিয়ে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে পারে।
তেজগাঁও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কনসালটেন্ট অফিসার ডা. মোহাম্মদ ইমামুল হক বলেন, আগে ছেলেরা মেয়েদের বন্ধু হতো আর এখন মেয়েরা ছেলেদের বন্ধু হয়। এখন ছেলেদের আগেই মেয়েরা হ্যান্ডসেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়। এরই নাম অতি আধুনিকতা। আর এই আধুনিকতা এখন মাদক পর্যন্ত গড়িয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.